রেখেছো বাঙাল করে, মানুষ করোনি

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে অফিসে ফিরেই দেখি অফিসের অবস্থা অনেকটা যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থার মতো। তাকে শুধু বৈরী পরিবেশ বললে কম বলা হবে। একদিকে ছয় মাসের ছোট শিশুটিকে ডে কেয়ারে ফেলে এসে অফিস করা, অন্যদিকে অফিসের পুরুষ আর নারীরা (এদের নারীই বলছি কারণ তারা নারী হবার যোগ্যতা রাখে না) কীভাবে আমার সাথে ঝামেলা পাকাচ্ছে সেই নাটক দেখা। কাজ করার ফুরসত কই?

বুঝতে কষ্ট হলো না এইচআরডি থেকে ইঙ্গিত পেয়ে অফিসের জুনিয়র-সিনিয়র মিলে আমার সাথে এরূপ আচরণ শুরু করেছে। বাংলাদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এখানেই অক্ষমতা। কর্মি হিসেবে নতুন মা তাদের অপছন্দের তালিকায় প্রথম।
অন্যদিকে বাঙালী পরিবারের চিরায়ত সমস্যা। নতুন মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরিবারের কেউ চিন্তিত নন। ফলে পরিবার থেকে কোনরূপ মানসিক সহযোগিতার আশা করাও বোকামি।

প্রায় তিন বছর এভাবেই চোখ নাক মুখ বন্ধ করেই ঘরে এবং অফিসে কাজ করে গেলাম আর পাশাপাশি পিএইচডি-র জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার প্রস্তুতি নিলাম। পিএইচডি-র যাত্রাও যে খুব মসৃণ ছিল তা নয়। আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী, যাদের কিনা স্কলারশিপ ছাড়া উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখাও পাপ, তাদের সকলের রাস্তাই যে অপ্রত্যাশিত পর্যায়ের বন্ধুর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক-একটা আবেদনপত্রের কাজ শেষ করতে কখন কখন তিন থেকে ছয় মাসও লেগে গেছে। সেই হিসেবে তিন বছরে সব মিলিয়ে ছয়টা আবেদনও করতে পারিনি।

অন্যদিকে মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। দেশ ছাড়তে হলে তার স্কুল শুরু হবার আগেই ছাড়া উত্তম। প্রতিদিনই এসব দু:শ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। নানাবিধ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙতো। তবে দেশের বেগতিক নাগরিক সুবিধা আর চাকরিক্ষেত্রে নারীর অসহায়ত্ব দেখে, হয় দেশ ছাড়বো না হয় চাকরি পরিবর্তন করবো এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেইসময়ে। কিন্তু কোনটা আগে?

পিএইচডি প্রপোজাল নিয়ে যখন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কথা চলছিল, বুঝতে পারছিলাম আমার আশা আছে। তাই তখনই ধুপ করে চাকরি পরিবর্তন করতে চাইলাম না। কিন্তু স্বনামধন্য এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করার পরিবেশ দিনে দিনে খারাপ হতে থাকলো। দুর্নীতি, অন্যায়, অস্বচ্ছতা, দেখে দম বন্ধ হবার অবস্থা।

বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টের হেড চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। ভালো ভালো অভিজ্ঞ শিক্ষকরা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে নামেমাত্র ভিসি আর প্রো-ভিসি বসে বসে মাছি তাড়াতে ব্যস্ত। খারাপ লাগতো দেখে যখন শুনতাম এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির করার জন্য কেউ কেউ এককালে সরকারি চাকরি ছেড়ে এসেছিলেন। অনেকেই নিচু স্বরে, দুঃখ করে তাদের হতাশার কথা বলতেন আমার কাছে। তাদের মতো আমিও নিরুপায়, তাদের গল্প শোনা ছাড়া তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না, এখনও নাই। চোখের সামনে দেখেছি কীভাবে ক্ষমতার বলে উচ্চপদস্থ পুরুষগুলো অল্প বয়সী সহকর্মীদের বিরক্ত করছে। সাথে তাদের চ্যালাপেলারাও মজা লুটছে। কিন্তু না অফিসের ভিতরে এসব থামাবার কোন পলিসি আছে, না রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন সহায়তা পাবার আশা আছে। তাই সবাই নিশ্চুপ।

ভাবলাম কতদিন চুপ করে থাকবো, দেশ ছাড়ার আগে শেষ চেষ্টা করে যাই। অন্ততঃ দেখে যাই এর মূল কোথায়। তাই কিছু সিনিয়র নারী, যাদের চিন্তা ভাবনা একটু অন্যরকম তাদের সাথে দেখা করা শুরু করলাম, কথা বলা শুরু করলাম, জানালাম জুনিয়রদের সাথে কী হচ্ছে। যেই প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং হলো ‘নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা’, সেই প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ার বেড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের অবস্থা কী?

কেঁচো খুঁড়তে যেয়ে সাপ বের হলো। জানতে পারলাম, পুরুষ কলিগদের এরূপ নোংরামি নতুন নয়, দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সম্প্রতি বেড়েছে এবং প্রকাশ পাচ্ছে। তবে এর সাথে জড়িত আছেন নারীরাও। সবচেয়ে বেশি শোচনীয় অবস্থা প্রতিষ্ঠানের এইচআরডি বলে যে অক্ষম ইউনিটটি আছে, সেটির। তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কাজটি করেন। আর যদি কেউ এদের এসকল অন্যায়–দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চায়, তবে তাদের মুখ বন্ধ করার যাবতীয় ব্যবস্থাও তারাই গ্রহণ করেন। এইচআরডি মানে যে সেখানকার সকলেই এই দুর্নীতির সাথে জড়িত, তা নয়। গুটিকয়েক কর্মি, যারা সরাসরি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে এরূপ অপকর্ম করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের এরকম গোমর জেনে যাবার পর আপনার চাকরি আর নিরাপদ থাকে না। বিশেষ করে আপনি যখন সংখ্যালঘুদের দলে। তবে এতো সব তথ্য বের করার জন্য অনেকের সাথে কথা বলতে হয়েছিল, দলীয় আলোচনায় বসতে হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে লাভ যেটা হয়েছে সেটা হলো, সত্য উদ্ঘাটনের দক্ষতা অর্জন হয়েছে, পাশাপাশি নিজের পিএইচডি প্রপোজালটা আরো নিখুঁত হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের বা রাষ্ট্রের কোন উপকার হয়নি। কারণ রাষ্ট্রের কার কাছে, কীভাবে আপনি জানাবেন এতোসব দুর্নীতির কথা? কিংবা উক্ত প্রতিষ্ঠানের কে-ই বা আপনার কথা শুনবে? যদি একটি প্রগতিশীল সমাজের প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান হতো তবু কিছু আশা করা যায়।
আশা করা যায়, আমার এই কাজের ফলাফল নিয়ে পলিসি উন্নয়নের কাজ করে একটা চমৎকার কর্মপরিবেশ তৈরির প্রয়াস হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আমি সেরূপ কোন আশা রাখি না। তাই যখন দেশ ছাড়ার সকল প্রস্তুতি নেয়া শেষ, স্কলারশিপ, পিএইচডি ভর্তির কাগজ, ভিসা সব হাতে চলে এসেছে তখন শিক্ষা ছুটি চাইলে অযথা হুমকি ধামকি দিয়ে আমাকে চাকরি ছাড়তে বলা হয়। সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?

শুধু একটাই দুঃখ, সাধারণ মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে কিংবা শিক্ষা বিক্রি করে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো আমার দেশের গরীব ও মধ্যবিত্ত জনগণের কাছ থেকে তাদের কষ্টের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশের ছবি বেঁচে নিজেদের পকেট ভরছে। সেখানেই তারা থেমে থাকেনি। দেশের মানুষের অধিকার মেরে, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার লক্ষ্যে বড় বড় গল্প তৈরি করে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার নিয়ে এসে দেশের মানুষের মুখে ঝামাও ঘষে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক নেতা কর্মিদের নিয়ে তবু সমালোচনা হয়, কখনো কখনো বিচারও হয়। কিন্তু এই সকল দ্বিমুখী শ্বাপদের ছোবল থেকে দেশের মানুষের কোন মুক্তি নাই। দেশের মানুষ ঝামাঘষা হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাদেরকে ভগবানের পর্যায়ে নিয়ে যায়। তখন আমার একটা কথাই বার বার বলতে ইচ্ছে হয়, “হায়রে বিশ কোটি মানুষের মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙ্গাল করে, মানুষ করোনি”।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.