“জেনারেশন গ্যাপ”

দিনা ফেরদৌস:

আমেরিকায় আসার পর আত্মীয়-স্বজন ছাড়া বাইরের যে মেয়েটির সাথে ভালো খাতির হয়, সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট আর বিবাহিত। বিবাহিত বলেই এই বয়সেই সে ছোট-বড় সবার ভাবী হয় তাদের ফ্ল্যাটে। তো, এই রকমের এক ভাবীর সাথে তার বেশ খাতির থাকলেও হঠাৎ খেয়াল হলো, সেই ভাবীর দেখা মিলছে না বহুদিন। ভাবীর কলেজে পড়ুয়া দুই ছেলেমেয়ে আছে। ভাবীকে আমার পরিচিত সেই মেয়েটির ভালো লাগার কারণ হলো, ভাবী বিদেশের মাটিতে থেকেও চলেন নিজ দেশের কালচার মেনে। ছেলেমেয়েদের খুব কন্ট্রোলে রাখেন। পোশাক-আশাক, চাল-চলনে খুব নজর রাখেন। ভাবীর বিশ্বাস, এই বিদেশের মাটিতে ছেলেমেয়েকে বেশি স্বাধীনতা দিলে, এদের আর ধরে রাখা যাবে না। ভাবী সবসময় বলেন, বিদেশে বাচ্চা কীভাবে মানুষ করতে হয় আমি জানি, আর আমার বাচ্চাদের এমন শিক্ষা দিয়েছি যে, আমার কথার উপরে কোন কথাই বলে না।

আমার পরিচিত মেয়েটিও খেয়াল করেছে, তাদের বিল্ডিংএ এই বয়সের অন্য ছেলেমেয়েরা যেমন চলাফেরা করে, পোশাক পরে, ভাবীর ছেলেমেয়েরা ঠিক তার বিপরীত। আর ভারীর বেশিরভাগ কথাবার্তা-ই হচ্ছে, তার ছেলেমেয়ে পড়াশুনায় অনেক ভালো, ধর্ম-কর্ম করে ঠিকঠাক মতো, সঙ্গে আছে অন্যদের সাথে তার ছেলেমেয়ের তুলনা, আর তার নিজের প্রশংসা- ছেলেমেয়ে কীভাবে মানুষ করতে হয় তা তিনি জানেন।

ফ্ল্যাটের আরেক ভাবীর সাথে সাক্ষাতে আমার পরিচিত মেয়েটি জানতে পারে, ভাবী আর তার মেয়ের মধ্যে কী নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছে কিছুদিন আগে। মেয়েটিকে একদিন ঘরে বন্দি করেও রেখেছিলেন। তারপর কী একটা পুলিশি ঝামেলা হয়েছে, মেয়েটি ঘর থেকে চলেও গেছে কোথায়। দু’দিন পরে সে জানতে পারে, ভাবীর মেয়ের কালো একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বেশ আগে থেকেই। আর এখন সে ওই ছেলেটির সাথে থাকে।

সবাই যখন ঘটনাটা জানে, তখন ভাবীও আর লুকিয়ে নেই। সবার সাথে আগের মতোই দেখা হয়, কথা হয় খুব কম। ভাবীর দুঃখ এখন একটাই, এই বয়সের ছেলেমেয়ে একটু আধটু প্রেম করবেই, আর আর বিদেশের মাটিতে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য বিদেশি ছেলেমেয়েই উত্তম। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিদেশি ছেলেই যদি মেয়ে পছন্দ করবে তো কালো কেন, একটি সাদা ছেলেকেই পছন্দ করতে পারতো। তাহলে অন্তত সবাইকে দেখানো যেতো।

আমাকে পরিচিত মেয়েটি যখন ঘটনাটা বললো, বললাম, সেই মেয়েটি প্রেম করতে গেছে, মায়ের প্রেস্টিজ রক্ষা করতে যায়নি। আমার পরিচিত মেয়েটির সুর এইবার ভিন্ন। বললো, বুঝলেন আপু; নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এতো বেশি কথা বলতে নেই। সবারই ছেলেমেয়ে আছে, কোন মা-বাপ খারাপ চায় বলুন? রশি বেশি টানলে ছিঁড়ে যায়, সবাই তাই বলছে এখন। বললাম, হুঁম।

আমি নিজে খেয়াল করেছি; আমার মেয়ে যখন আমার সাথে খেলা করে, মাঝে মাঝে বলে, নাউ আই অ্যাম মামী, অ্যান্ড ইউ আর মাই বেবি। যতক্ষণ তার খেলা চলবে, সে আমাকে সুইটি সুইটি বলে সম্বোধন করবে। স্কুল, কলেজে পড়ুয়া আমাদের বাচ্চারা প্রতিদিন ঘরের বাইরে যাচ্ছে। সারাদিন বলতে গেলে আলাদা এনভায়রনমেন্টে থাকছে। ওই পরিবেশ থেকেই গ্রহণ করছে বেশি। আর স্কুল কলেজের পরিবেশটা অনেক মোলায়েম। কথায় কথায় শিখছে যেখানে সরি, থ্যাংকু, ভালো কোন কিছুর প্রশংসা, সেখানে ঘরে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ মেনে নেয়া যে কী কঠিন, তা আমাদের বাচ্চারা ফিল করে ঠিকই।

এক সময় যখন দেখে আর মেনে নেয়া যাচ্ছে না, তখন বাচ্চারা বিগড়ে যায় (বিগড়ে যাওয়া বলছি এই কারণে যে, তাদের ভালো লাগার মতো জীবনের সাথে তাল মিলাতে না পারাকে আমরা বিগড়ে যাওয়াই বলি)। অথচ নিয়ন্ত্রণে নেই কিছুই আমাদের। আমরা বাবা-মায়েরা দেশ থেকে মগজে করে নিয়ে আসা দুই জেনারেশন আগের চিন্তা-ভাবনা যখন এই জেনারেশনের ঘাড়ে চাপাতে যাই, তখন হিতে বিপরীত হয়। যেখানে তাদের মতো করে তাদের বুঝালে অনেক সহজ হয়।

দেশ থেকে অনেকেই খুব খুশি হয়ে বিদেশে আসেন। বিদেশের এই ভালো, ওই ভালো বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলেন, কিন্তু চলতে গিয়ে টাশকি খান তখনই, যখন তাল মিলাতে পারেন না। সব দেশেরই আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। আর যে দেশে আমরা বসবাস করি, সেই দেশের সংস্কৃতি মানি বা না মানি জানা থাকা উচিত আমাদের সকলের। জানা না থাকার ফলেই মা-বাপ আর বিদেশে বেড়ে উঠা বাচ্চাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে জেনারেশন গ্যাপ।

সমাধান যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। এই জেনারেশনের আমরা যারা আসছি তারা সবাই কম-বেশি পড়ালেখা জানা। ফলে চলার মতো ইংরেজি আমরা সবাই জানি কম-বেশ। তারপরও আমি মনে করি যে দেশেই যাই না কেন, সেই দেশের ল্যাংগুয়েজ এবং কালচারের উপর কোন কোর্সে ভর্তি হওয়াটা জরুরি।

কিছুদিন আগে কার একটা লেখার মন্তব্যে দেখলাম লিখেছেন; “ওড়নাটা হচ্ছে বাংলাদেশের কালচারের অংশ, বিদেশিরা আমাদের দেশে আসলে ওড়না গায়ে জড়ায়, আমাদের তো জড়ানোই উচিত”। আমার নিজের দেশের মেয়েরা যেখানে ওড়না পরেও নিরাপদ না, সেখানে বিদেশিরা কালচার রক্ষা করতে না ভয়ে লাগায়, সে তর্কে আমি যাবো না। বিদেশিরা এই দিক দিয়ে অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করে, তাদের দেশে এসে কে কী পরবে না পরবে, তা নিয়ে তাদের মাথা-ব্যথা নেই।

আমি যখন প্রথম আমেরিকা আসি, আমার বর আমাকে সেই “আমেরিকান নেটিভ ল্যাংগুয়েজ ও কালচারের” ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানেই পরিচয় হয় সেই ছোট বোনটির সাথে, যে প্রতিবেশি ভাবীর গল্প বলেছিল। পরিবার থেকে যেখানে শিখে আসছি; সবকিছুতে ডান হাত আগে বাড়িয়ে দিতে হয়, বড়দের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসতে নেই, মুরুব্বিদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে নেই। ক্লাসে এসে শিখলাম ডান হাত, বাম হাত কোন ব্যাপার না, পায়ের উপর পা তুলে বসতে কোন সমস্যা নেই, তবে পায়ের উপর পা তোলে নাচানো অভদ্রতা, এখানে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয়; তা না হলে যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে, তিনি মনে করেন তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না, ভ্যানিটি ব্যাগ পাশের চেয়ারে না রেখে নিচে রাখা, হাসি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা, এসবই মেনে চলা হয়।

আমাদের দেশে হেসে তাকালে খবর আছে। ভেবে বসবে অন্য কোন আমন্ত্রণ। কেউ খাওয়ার সময়, রান্নায় বা শপিং এর সময় ফোন করলে, কথা বলে যদি বিদায় নিয়ে হয়; স্বাভাবিকভাবেই বলা হয় এনজয় ইয়র ফুড, কুকিং, শপিং। একবার দেশে এক মামার সাথে কথা হচ্ছিল, বলছিলেন তিনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। উত্তরে বলেছিলাম, এনজয় ইয়র টাইম মামা। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, কীভাবে আর এনজয় করি, তোর মামীর তো শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি এনজয় বলতে ওই একটাই বোঝেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এক দেশের কালচার মগজে নিয়ে, অন্য দেশে খাপ খাওয়াতে গিয়ে এইসব বাবা, মায়েরা কতোটা বিভ্রান্ত।

আমরা যারা মা, বাবা হয়েছি তাদের কাছে সবকিছুর আগে নিজের সন্তান। সেই সন্তানদের ভালো থাকার মধ্যে যদি বাবা, মায়ের ভালো থাকা থেকে থাকে তো তাদেরকে আমাদের বুঝতে হবে। আর না বুঝলে প্রকাশ্যে হোক, বা লুকিয়ে কান্নাটা নিজের জন্যই থাকবে।

শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশে ঘরে ঘরে মা, বাবারা এর সাফার করছেন। কাজী অফিসে খোঁজ নিলে জানা যায়, টিনেজ ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে বিয়ে আর ডিভোর্সের খবর। বাবা, মা জানেন না কিছুই। আর জানবেন ক্যামনে? তিনারা তো সন্তানদের তো কড়া শাসনে গড়ে তুলতে ব্যস্ত। কিছু একটা ঘটার পর বলেন এটা না হয়ে, ওটা হলে মেনে নিতাম। পরে বলে যখন লাভ নেই, কতটুকু মেনে নিবার সাহস রাখেন, তা তাদের সন্তানদেরও জানা দরকার। সন্তানরা কী কী করতে পারবে না, তার একখান বিশাল তালিকা নিয়ে বড় হয়। বড় হওয়ার পর নিজেদের সুবিধা মতো তালিকা বানায়। পরিবারকে না জানিয়ে নিয়ম ভাঙ্গে ঠিকই। লুকিয়ে করতে যেয়ে ভুলটাই করে বেশি। অনেকে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়, অনেকে এইখান থেকে ফায়দা নেয়।

অনেক মামলা হয়, খুন হয়, পুলিশ, উকিলদের ব্যবসা হয়। যাদের নামে মামলা হয়, আর যারা মামলা করেন তারাও কোন না কোন মা-বাবার-ই সন্তান। হয় অনেক কিছু, হচ্ছে, আর বাবা, মায়েরা এখন থেকে সতর্ক না হলে আরও হবে।

সন্তানদের সাথে সাথে মা,বাবারও নিজেদের আপডেট করার প্রয়োজন আছে। ঘটনা ঘটার পর মেনে নিতেই তো হচ্ছে। অন্যেরা কে কী ভাববে সেই চিন্তা বাদ দিন। অন্যেরা আজ সমালোচনা করবে, কাল ভুলে যাবে, পরশু আবার কেউ মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু সাফারটা আজীবন ব্যক্তি আর তার পরিবারকেই বহন করে যেতে হবে।

এই লেখা পড়েও অনেকে উল্টা-পাল্টা মন্তব্য করবে জানি। একশো জনের মধ্যে থেকে যদি একজনও সঠিক মেসেজ পায় আর নিজেরে শোধরায়, ফলে যদি একটি পরিবার রক্ষা পায় তো আমার লিখা সফল বলে মনে করবো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.