“রুবিনা”

সুমিত রায়:

“স্যার, ভালো আছেন?”

কে যেন! … চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। ভীষণ চেনা মুখ, তবু মনে করতে পারছি না।

“ভুলে গেলেন স্যার! আমি রুবিনা!”

ও তাই তো! রুবিনা! সেই ছোট্ট প্রাণোচ্ছল মেয়েটি, স্কুলের মধ্যে খালি ছুটে ছুটে বেড়াতো। চোখেমুখে সবসময় এক দীপ্তিময় হাসি ফুটে থাকতো। আমাকে দেখলেই বলতো, “ও স্যার, আমাদের কম্পিউটার শেখাবেন না?” ওর ঐ শিশুসুলভ উদ্দীপনায় আমি মাঝে মাঝেই ইংরেজি মাস্টার থেকে কম্পিউটার মাস্টারে রূপান্তরিত হতাম।

কম্পিউটার রুমে আমাকে বসে থাকতে দেখলেই ছুটে আসতো, “স্যার, আপনার পাশের কম্পিউটারটা একটু চালাবো?” তারপর আমার স্বল্প বিদ্যায় শেখানো পড়া ঝালিয়ে নিতো – এম. এস. ওয়ার্ড খুলে “রুবিনা খাতুন, ক্লাস নাইন, সেকশন বি, রোল নং ০৩” এইসব অনাবিলভাবে লিখে যেত; নয়তো পেইন্ট খুলে একটা কুঁড়েঘর আর গাছ এঁকে রং দিয়ে ফিল করতো।

আবার যখন অবসর সময়ে স্টাফ রুমে বসে থাকতাম, তখন সুযোগ বুঝে আমাকে দিয়ে ইংরেজি গ্রামার খাতা চেক করিয়ে নিত। তারপর একদিন মেয়েটি হঠাৎ মিলিয়ে গেল! ক্লাস নাইনের ঘরে নাম ডাকতে ডাকতে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “রুবিনা অনেকদিন আসছে না কেন রে?” কয়েকটা মেয়ে খিল খিল করে হেসে বলে উঠলো, “স্যার, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ, চিনতে পারবো না কেন?” মুখে বললাম ঠিকই, কিন্তু স্কুলের সেই দীপ্তিময় মেয়েটির সাথে আমি যেন এই রুবিনাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। কোলে একটি ফুটফুটে শিশুকে আঁকড়ে ধরে চকচকে রঙের শাড়ি পরা রুবিনা আমার দিকে হাস্য বদনে চেয়ে আছে। মনে মনে হয়তো প্রত্যাশা করছে আমি জিজ্ঞেস করবো, “কীরে কেমন আছিস? শ্বশুরবাড়ি কেমন লাগছে? মেয়ে কবে হলো? ওমা! কী ফুটফুটে হয়েছে রে তোর মেয়েটা! যত্ন নিস। মন দিয়ে সংসার কর।”

কিন্তু আমি সেরকম কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। উজ্জ্বল রঙের শাড়ির আড়ালে ওর চোখেমুখে হারিয়ে যাওয়া সেই দীপ্তিটা অতি প্রকটভাবে আমার নজরকে বিদ্ধ করছিল। বর্ণহীন, শীর্ণকায়, চোখের কোণে কালি পড়ে যাওয়া অবয়বটির মধ্যে যেন আমি হাজার বছরের বঞ্চনার ইতিহাসটিকে প্রত্যক্ষ করছিলাম। হাজার বছরের নারীত্বের বলিদানের জীবন্ত দলিলটাকে পরখ করতে করতে যেন মূক হয়ে গেলাম।

কী জিজ্ঞেস করবো — “ভালো আছিস”? রুবিনা কি সত্যিই জানে সে কেমন আছে! জিজ্ঞেস করলে হয়তো হাস্য বদনে উত্তর দেবে, “ভালো আছি, স্যার”। কিন্তু ওর এই আপাত ভালো থাকার মধ্যে যে অসংখ্য নির্মম না ভালো থাকা, যেগুলি আমার চোখে প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে, তার থেকে বড় উত্তর তো আর কিছু হয় না। ওর চোখের তলায় কালির আঁচড়ে, কুঁচকে আসা চামড়ার মোচড়ে যে অপ্রাপ্তি, অপুষ্টি, অনাদর, অবহেলা, শোষণ, গোপন জান্তব নিপীড়নের যে গভীর ক্ষতের ইতিহাস রচিত হয়ে আছে তাকে নিরীক্ষণ করা এই সমাজের পক্ষে দুঃসাধ্য।

কিছুই বলবো না তা তো হয় না। কথা শেষ করতে হলেও কথা বলা প্রয়োজন। তাই বললাম, “তোর মেয়ের নাম কী?”

“ফারজা্না। আমাদের ইস্কুলেই ভরতি করে দেব, স্যার। আপনি পড়াবেন”।

ছোট্ট ফুটফুটে মায়ের বুক আঁকড়ে থাকা ভবিষ্যতের রুবিনার দিকে একবার তাকালাম।

“এবার চলি, বুঝলি। স্কুলের টাইম হয়ে গেছে।” বলেই জো্রে পা চালালাম।

“দোয়া করবেন, স্যার!” পেছন থেকে আবার স্বর ভেসে আসলো।

কী দোয়া করবো! আদর্শ মা, আদর্শ স্ত্রী, না আদর্শ বউমা, কী হওয়ার দোয়া করবো! ভাবতে ভাবতে স্কুল এসে গেল। এই প্রথম রুবিনার সাথে আমার দেখা হলো, যেদিন ও আমার কাছে আর কম্পিউটার শেখার বায়না করলো না!

এটেন্ডেন্স রেজিস্টার নিয়ে নাইনের ঘরে ঢুকে রোল কল করে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম। আজকের তারিখটা লিখতে গিয়ে একবার থমকে গেলাম, তারপর লিখলাম – ৮-ই মার্চ, ২০১৭।

সুমিত রায়,
কল্যাণী, নদীয়া।
Email: [email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.