সাজ্জাদ হোসেন:
‘‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’’
প্রিয় কবিগুরু, তোমার দেওয়া এই অভিশাপ বাণী নিয়েই আজকের এই চিঠি।
তোমার যুগে তুমিও বোধ করি আমাদের মতোই অসহায় ছিলে, দুর্বল ছিলে ভীষণ! অভিশাপ তো অসহায়েরই অবলম্বন। চোখের সামনে জাজ্বল্যমান অন্যায় দেখেও প্রতিহত করতে পারোনি। পারোনি প্রতিকার নিশ্চিত করতে। গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদও করতে পারোনি। তীরবেঁধা পাখির মতো ছটফটই করতে পেরেছো বড়জোর। তাই কি বিড়বিড় উচ্চারণে আশ্রয় নিয়েছিলে এই অভিশাপের? চারপাশের অভিজ্ঞতায় আজ আমার তা-ই বদ্ধমূল ধারণা। নিজ হাতে যারা অন্যায় প্রতিহত করতে পারে, তারা কি অভিশাপের আশ্রয় নেয়?
বেয়াদবি নিয়ো না, তুমি খুব বোকা ছিলে। মহাভারতের যুগ শেষ হয়েছে হাজার-সহস্রাধিক বছর আগে। সে যুগে তোমার জন্ম হলেও একটা কথা ছিল। বরদান বা অভিশাপ দুটোই তখন ছিল অব্যর্থ। কিন্তু উদ্ভ্রান্ত এ গণরাজ্যে আজ অভিশাপের কানাকড়ি দাম নেই, নেই কণা পরিমাণ কার্যকারিতা। নেই অনেক আগে থেকেই। এখানে বরং দুষ্টের দমনে পর্যায়ক্রমে অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে রগ কাটার ছুরি, নরদেহকে কুপিয়ে নোনা ইলিশ বানানোর রামদা, চাপাতি, কাটা রাইফেল ইত্যাদি, ইত্যাদি। ভারতবর্ষে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে যেভাবে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন পরমেশ্বর ভগবান। কখনো বা হরি হয়ে, কখনো বা রাম হয়ে, কৃষ্ণ হয়ে, গৌরাঙ্গ হয়ে। যেভাবে এসেছে মৎস্য অবতার, কুর্ম অবতার, বরাহ অবতার ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কবি, তোমাকে জানাচ্ছি, অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্রের সর্বশেষ অবতারের নাম ‘হাতুড়ি’। তোমার যুগে হাতুড়ি নামক যন্ত্রটির ব্যবহার হয়তো গৃহ নির্মাণ, আসবাব নির্মাণ ইত্যাদি কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। ছিল সমাজতন্ত্রী লেনিনের যুগেও। যে কারণে এটি ছিল শ্রমজীবী-মেহনতী ঘামঝরা মানুষের রুটিরুজির প্রতীক। আজ তুমি নেই, লেনিনও গত হয়েছে সেই ৯৪ বছর আগে। হাতুড়ি এখন আবির্ভূত হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন রূপে, নতুন তরিকায়। অনায়াসে বহনযোগ্য এ অস্ত্র এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সঠিক জায়গায়, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক দুষ্ট নিধনে। তার সামনে তোমার ‘দুষ্ট’ অভিসম্পাত (১৬+২)= ১৮ আনা নিরর্থক, নিষ্কর্মা, নিষ্ফল। বিশ্বাস না হলে আস, দেখে যাও। ভালো করে এক্স-রে করাও তোমার রচিত সেই পদের, সেই চরণের। খোলা চোখেই ফিল্মে দেখতে পাবে ভেতরের হাড় ভেঙ্গে কী ভয়ানকভাবেই না আলাদা হয়ে গেছে!
কবিগুরু, অন্যায় যে করে, কে তাকে দাহ করবে? কোন সে ঘৃণা? কার সে ঘৃণা? তবে কি সে অন্ধ, বধির? নাকি সে তোমার অভিশাপের মতোই অকর্মা?
গুরুদেব, তুমি ক্ষমা চাও। অবশ জাতিকে অভিশাপ নির্ভর অপয়া পথের অনুসারী হতে প্রেরণা দিয়ে যে অন্যায় করে গেছো, তার জন্য নতজানু হয়ে বসো, ক্ষমা চাও করজোড়ে, কায়মনোবাক্যে। তুমি ক্ষমা চাও ‘হাতুড়ি অবতার’ দেখে যেতে পাওনি বলে।
আক্ষেপ হয়, কবিশ্রেষ্ঠ হয়েও সঠিক বাণীটি দিয়ে যেতে পারোনি।
যদি লিখে যেতে….
‘অন্যায়ের প্রতিবাদ যে করে আর
অন্যায়কারীকে যে ধরে
সে যেন যাদুরাজের কলকাঠিতে মরে।’
তাহলে সেটি কেবল যুগ-উপযোগীই হতো না, যুগ-উত্তীর্ণও হতো, হতো যুগ-যৌবনা।
[শুক্রবার, ৬ জুলাই ২০১৮, রায়েরবাজার, ঢাকা]