তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো

ফাহমিদা বারী বিপু:

এক:
ক্লাস নিয়ে এসেই তড়িঘড়ি হাতের টুকটাক কাজগুলো সেরে নিচ্ছিলো সায়রা বানু। আজ একটু আগেভাগে বাসায় যেতে পারলে ভালো হয়। আগামীকাল বাসায় একটা ছোটখাট খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। খুব বেশি কেউ নয়, কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন আর অল্প কিছু বন্ধুবান্ধব। ছেলেটা মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। এতোটুকু আয়োজন না করতে পারলে ওকে বঞ্চিত করা হয়।

বাপ মরা ছেলে। ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে থাকার কথা ছিল যার, তাকেই কখনো কাছে পায়নি। আদিবের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখনই এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় ওর জীবনের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা হারিয়ে যায়। পিতৃহারা হয় সে। কতটুকুই বা বয়স তখন ছেলেটার! ঐটুকুন বয়সে এটাই তো সে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি, কী খোয়া গেল জীবন থেকে।
ছেলেটাকে একটা মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন দেওয়ার জন্য সায়রা দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেছে। তার স্বামী যখন মারা যায়, তখন সায়রা বেসরকারি একটা কলেজে ছিল। বেতন পেত একেবারেই নামমাত্র। ঐটুকু মোটে বেতন দিয়ে, ছেলেকে নিয়ে কীভাবে একা একা সবকিছু সামাল দিয়ে চলবে, সেই চিন্তায় তার সারারাত ঘুম আসতো না।
তখনই যেন সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চাইলেন। স্বামীর সরকারি কলেজে চাকরিটা হয়ে গেল তার। একই শূন্য পদে। ইউনিভার্সিটিতে তাদের দুজনের সাবজেক্ট একই হওয়াতে সুবিধা হয়েছিল।

মনে মনে সবার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করে সায়রা। পৃথিবীতে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছেন। ছোট একটা শিশু নিয়ে তাকে যাতে একেবারে পানিতে পরে যেতে না হয়, সেজন্য অনেকেই সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন। তার হয়ে কতৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। এসব বন্ধুরা আত্মীয়ের চেয়েও বড় আত্মীয়তার বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করেছিলেন। তাদের কারো ঋণ কোনোদিন শোধ করবার নয়।

সেই ভয়াবহ দুর্যোগের মুহূর্তে সে অসম্ভব খাটনি খেটেছে। চাকরিটা যে শুধু তার অবস্থার সুযোগ হিসেবেই সে পায়নি, বরং তার নিজের যোগ্যতাও যে কিছু কম নয়…এটা প্রমাণ করার জন্য তাকে চাকরিতে অনেক বেশি সময় দিতে হয়েছে। ঠিক সেই সময়টাতে, যখন তার সন্তানের তাকে প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।

তার সন্তান আদিব…পিতা আর মাতার সাহচর্য আর নিবিঢ় পরিচর্যা ছাড়াই অগোচরে বেড়ে উঠেছে। সায়রার মা এগিয়ে এসে আদিবের দেখাশোনার দায়িত্ব কাঁধে না তুলে নিলে সে একা একা কীভাবে সামলাতো, সত্যিই জানে না।
দুঃসময় পার হয়েছে। আজ এই এতদিন বাদে শীতে কাতর জীবনে তারা মা ছেলে একটুখানি রৌদ্রের দেখা পেয়েছে। আদিবকে সে সময় দিতে পারেননি। ওর লেখাপড়ার পেছনে লেগে থাকতে পারেনি…যেভাবে আর দশটা মা লেগে থাকে। আদিব একা একাই স্কুলে গিয়েছে, হোমওয়ার্ক করেছে। বছরে দু’বার তার হাতে নিজের মার্কশীটটা তুলে দিয়ে বলেছে,
‘ইস, দেখেছো একটুর জন্য এবারেও ফার্স্ট হওয়াটা মিস হয়ে গেল! দেখ, পরেরবার আর মিস হবে না।’
সায়রা ছলছল চোখে সস্নেহে তাকিয়ে থেকেছে সন্তানের দিকে। মনে মনে ভেবেছে, ছেলেটা কবে এত বড় হয়ে গেল? কই, সে তো একটুও টের পেল না!

আদিবের রেজাল্ট এসেছে এসএসসি’র। সায়রা স্বপ্নেও যা ভাবেনি তাই হয়েছে! ছেলে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। রেজাল্ট পেয়ে অবশ্য আদিবের মুখে হাসি ছিল না। মুখ গোমড়া করে বলেছে,
‘আমাদের ক্লাসের এক থেকে বত্রিশ রোল পর্যন্ত সবাই এ প্লাস পেয়েছে। কারো কারো হয়ত গোল্ডেন ছুটেছে, এই যা! এই রেজাল্টে এত খুশি হওয়ার কী আছে?’
খুশি হয়েছে মার্কশিট হাতে পাওয়ার পরে। ওর মার্কস বোর্ডের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে চলে এসেছে। অবশেষে খুশিতে দাঁত বের হয়েছে আদিবের। মুখে বলেছে,
‘হ্যাঁ, এইবার খুশি হওয়া যেতেই পারে!’

তো, এমন ছেলের জন্য একটু আধটু উদযাপন না করাটাও অন্যায় হিসেবে ধরা যেতেই পারে!
ছেলেটা ওর বাবার মতোই হয়েছে। খুব লেগে থাকতে পারে যেকোনো কিছুতে। কেন যেন হার মানতে রাজি নয় কখনোই। আর বাবার মতো মেধাটা তো আছেই!
ওর বাবা আদিলের রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। কিন্তু পলিটিক্যাল কারণে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করতে পারেনি। পেছনের একজনকে টিচার হিসেবে নিয়ে ওকে বাদ দিয়েছে।
সেই ক্ষোভ অনেকদিন ভুলতে পারেনি আদিল। ভুলতে না পারারই কথা। মেধা আর কষ্টের যখন স্বীকৃতি মেলে না, তখন সেই দাগার আঘাত বড় বেশি লাগে মনে।
আজ সায়রা বানুর বড় আনন্দের দিন। কেন যেন মনে বিশ্বাস জন্মেছে, আদিব সেই স্বীকৃতিটাকে ঠিকই ছিনিয়ে আনবে। অনেক কষ্ট এতদিন অযাচিতভাবে তাদের ভাগে এসে জড়ো হয়েছে। এবার থেকে সামনে শুধু আনন্দের পাল্লা ভারী হবার দিন।

একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তাদের ছোট্ট সুখের সংসারটি ছারখার হয়ে গেছে আদিলের মৃত্যুর পরে।
ছোটখাট মান-অভিমান, ঝগড়া… মন কষাকষি কোন সংসারে না হয়? ওদের সংসারেও সেসবের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু সুখও ছিল অফুরান। সেই সুখের পায়রা ওড়া দিনগুলো কই যেন হারিয়ে গেছে!
আজ কতদিন হলো এই সংসারে দীর্ঘশ্বাসেরা চিরস্থায়ী আসন গেড়েছে!
কিন্তু অনেক হয়েছে, আর না! এবার সব মন খারাপকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পালা।

দুই:

তাড়াতাড়ি বের হওয়ার সব আয়োজন শেষ করেও বের হতে পারলো না সায়রা।
স্টুডেন্টদের পরীক্ষার খাতাগুলো প্রিন্সিপ্যাল স্যারের হাতে জমা দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত আলমারির ড্রয়ারটাতে চাবি ঢোকাতে যেতেই বেজে উঠলো মোবাইলটা।
অপরিচিত নাম্বার। সাধারণতঃ অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলে রিসিভ করে না সায়রা।
এখন তো কিছুটা কমেছে, আদিলের মৃত্যুর পরে একটা সময় ছিল যখন সে মনে মনে ঠিক করেছিল যে, বোরখা ধরবে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে একজন মহিলা একা থাকছে, এটা যেন বিরাট এক সুযোগ!
সেই মহিলাকে উত্যক্ত করা, একটু আধটু খোঁচা মারা, রাত বিরেতে ফোন করে আজগুবি আলাপ জুড়ে দেওয়া…সবাই যেন এসবকিছু করার লাইসেন্স পেয়ে যায়। মহিলা একা থাকে, স্বামী নেই…অতএব সে একরকম সবার সম্পত্তি!
সেই সময় থেকেই অপরিচিত নাম্বারে ফোন এলে আর রিসিভ করে না সায়রা। অভ্যেসটা এখনো বহাল আছে। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। সে গা করলো না। ড্রয়ার তালাবন্ধ করে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরুনোর উপক্রম করলো। মোবাইলটা সেই মূহুর্তে আরও একবার বেজে উঠলো।

হাতে নিয়ে দেখলো, সেই একই নাম্বার। ফোন ধরছে না দেখে আশেপাশে দু’একজন অবাক হয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। বোঝা গেল, ধরতে হবে। তা না হলে বাজতেই থাকবে।
আর তাছাড়া…দেখাই যাক না! বয়স হয়েছে, পায়ের নীচে মাটির ভীত শক্ত হয়েছে। এখন আর এত ভয় পাওয়ার কী আছে? উল্টাপাল্টা কিছু বললে সোজা পুলিশের ভয় দেখাবে সে।

ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশে গম্ভীর অথচ ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্বরে কেউ একজন বলে উঠলেন,
‘হ্যালো, আমার নাম রাফিয়া খাতুন। আপনি…মানে তুমি কি সায়রা বানু?’
অবাক হলো সায়রা। এই নামে কাউকে চেনে না সে। অপরিচিত একজন তাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে? বিস্ময় লুকিয়ে জবাব দিল,
‘জ্বী , আমি সায়রা বানু। কিন্তু আপনাকে তো!…’
ভদ্রমহিলার গলার স্বরে কেমন যেন একটা বিষণ্নতা মিশে আছে। খুব ধীরে ধীরে বললেন,
‘হ্যাঁ, আমাকে তুমি চিনতে পারবে না। আমি তোমাকে তুমি করে বলে ফেলেছি। কিছু মনে করো না। আসলে এতো ছোট তুমি বয়সে…আপনি বলতে পারলাম না!
আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম তোমার সাথে। কিছুক্ষণ সময় হবে তোমার? আর টেলিফোনে সব কথা বলা যায় না। যদি একটু সামনাসামনি কথা বলা যেত…তাহলে ভালো হতো।’
সায়রা মনে মনে ব্যাপক বিরক্ত হলো। আজকের দিনেই এই ঝামেলার মানে হয় কোনো?
কোথায় এখন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে আয়োজন শুরু করবে! তা না… কত কাজ বাকি এখনো! এখন পর্যন্ত বাজার ঘাটও করা হয়নি। আদিবকে কিছুই বলেনি দাওয়াতের ব্যাপারে। ওকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাইছিল মনে মনে। ভালো কিছু গিফটও কিনবে ছেলেটার জন্য। ভাবছিল দামী দেখে একটা শার্ট কিনে দেবে। তেমন কোনো সাধ আহলাদই তো মেটাতে পারেনি ছেলেটার!
এর মধ্যে এ কী উটকো জ্বালাতন?

সায়রা রাখ ঢাক না করে একটু চাঁছাছোলা গলাতেই বললো,
‘ইয়ে…কিছু মনে করবেন না। আসলে বাসায় একটু জরুরি কাজ ছিল। আজকে আমার একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলে ভালো হতো। আর তাছাড়া আমি বুঝতে পারছি না আমাকে কী দরকার আপনার। আপনি না হয় আপনার ঠিকানাটা আমাকে বলুন। আমি পরে একসময় আপনার সাথে দেখা করবো।’
ভদ্রমহিলা একটুও বিচলিত না হয়ে একই সুরে বললেন,
‘আমি যা বলতে চাইছি তোমাকে…তা শোনার চেয়ে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোমার থাকতে পারে না।’
সায়রা চমকে উঠলো ভদ্রমহিলার কথায়। বাক্যটির মাঝে এমন কিছু ছিল, সে আর কথা বাড়াতে পারলো না। চুপচাপ ঠিকানা লিখে নিয়ে বললো,
‘আচ্ছা, আমি আসছি।’
‘হুম, এসো। আমি অপেক্ষা করে আছি তোমার জন্য।’

সব চিন্তাভাবনা শিকেয় তুলে সায়রা ছুটলো ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করতে। একবার মনে হচ্ছিলো, বাসায় ফিরে আদিবকে সাথে করে নিয়ে যাবে। নিরাপত্তারও একটা বিষয় আছে। আজকাল কাউকে বিশ্বাস করার জো নেই। কে যে কী ফাঁদ পেতে বসে আছে…কেউ বলতে পারে না।
নিজেই নিজের সিদ্ধান্তে অবাক হচ্ছে সে। চেনা নেই, জানা নেই…একজন যেতে বললো আর সে রওয়ানা দিয়ে দিল! অন্যসময় হলে এটা সে কখনোই করতো না। কিন্তু আজ কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই কাজটা করে ফেললো।
ভদ্রমহিলা যেই হোন না কেন, এমনি এমনি তাকে যেতে বলছেন না। নিশ্চয়ই খুব জরুরি কিছু বলার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে।
ঠিকানাটা খুব দূরের কোনো জায়গার নয়। রিক্সা নিয়ে মাত্র কুড়ি মিনিটেই পৌঁছে গেল সায়রা।
এক তলা বাড়ি। চারপাশে বেশ অনেকখানি খালি জায়গা। ঢাকা শহরে বিল্ডার্সদের দৌলতে বর্তমানে এমন বাড়ির সন্ধান পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ।
লোহার গেটটাকে সরিয়ে বাড়িটাতে ঢুকতে ঢুকতে সায়রার কেন জানি খুব অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো। মনে হতে লাগলো…এই বাড়িটাতে সে এসেছে। কবে এসেছে সেটা মনে করতে পারছে না। কিন্তু কখনো যে এসেছে এই ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত।
এমনকি বাড়ির দরজার গায়ে খোদাই করে লেখা ‘স্বাগতম’ শব্দটিও তার মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগলো।
সে এসেছে…এই বাড়িতে সে নিশ্চয়ই এসেছে…

তিন:
প্রায় পনেরো মিনিট যাবত ড্রইংরুমে বসে আছে সায়রা।
কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিয়ে তার মালকিনকে ডাকতে সেই যে ভেতরে গেছে, আর কারো দেখাই মেলেনি তারপরে থেকে। সায়রা বিরক্ত মুখে বারকয়েক হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েছে। এক ঘণ্টার মধ্যে এখান থেকে বের হতে না পারলে তাকে আগামীকালের প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করতে হবে। কী একটা লজ্জার বিষয় হলো!

ড্রইংরুম থেকে ভেতরের ঘরে যাওয়ার দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছে সে। নাহ্‌, দরজার পর্দা নড়েচড়ে ওঠার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সায়রা। আর দশ মিনিট দেখবে সে। তারপরেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যাবে। কেউ মজা করলো কী না কে জানে!

দশ মিনিট সময় পার করতে হবে। সে ড্রইংরুমের শোভা দেখার কাজে মন দিলো।
ঘরটিতে বেশ একটা অযত্নের ছাপ আছে। সোফাসেটের যথেষ্ট বেহাল দশা। হাতলে ধুলোর আস্তরণ জমেছে। একটি কুশনের গায়ে হলুদের ছোপ ছোপ দাগ। আশ্চর্য! কেউ পরিষ্কার করে না নাকি!
সোফার টেবিলের নিচে একটা ছোট ফটো এ্যালবাম। সায়রা হাত বাড়িয়ে নিল সেটি। দশ মিনিটের কেবল দু’মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে।
ফটো এ্যালবামটির পুরোটা জুড়েই একটি মেয়ের ছবি। ছবিগুলো তোলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। মেয়েটির কিশোরী বয়স থেকে শুরু করে তরুণী বয়সের ছবি রয়েছে ধাপে ধাপে। মুখটি খুব স্নিগ্ধ, মায়াভরা। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে মেয়েটিকে! কোথায় দেখেছে…কোথায় দেখেছে! কেন মনে পড়ছে না? সায়রার মাথার মধ্যে চিনচিনে ব্যথার একটা অনুভূতি হতে লাগলো।
এই বাসাটাতে আসার পরে থেকেই তার এমন লাগছে কেন? কীসের পরিচয় তার এই বাসাটির সাথে?
‘ও আমার মেয়ে, যুঁথিকা।’
গলার স্বরে চমকে সামনে তাকালো সায়রা। সাদা শাড়ি পরিহিতা একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রমহিলা কখন যেন প্রবেশ করেছেন ঘরে। বয়স পঁয়ষট্টির আশেপাশে। ভদ্রমহিলার পুরো মুখে গভীর বিষাদের ছায়া।
সায়রা ফটো এ্যালবাম নামিয়ে রেখে সালাম দিলো। ভদ্রমহিলা নিচু স্বরে প্রতিউত্তর দিলেন। তারপরে খুব ধীর, শান্ত গলায় বললেন,
‘ওর ব্যপারে বলার জন্যই তোমাকে আজ ডাকলাম। কিছু মনে করো না। আমার নিজেরই হয়তো উচিত ছিল তোমার কাছে যাওয়া। কিন্তু…বয়স হয়ে গেছে তো! কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তেমন একটা যাইও না কোথাও। তবু তুমি না আসলে আমিই যেতাম। আমার কথা শুনেই চলে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’
সায়রা চুপ করে রইলো।

ভদ্রমহিলা বলতে থাকলেন,
‘যুঁথিকা…আমার মেয়ে…মারা গেছে। এই মাসের পঁচিশ তারিখে মারা গেছে ও।’
সায়রা হিসেব করে দেখলো ঠিক এক সপ্তাহ আগেই মেয়েটি মারা গেছে। ওর মন ভারাক্রান্ত হলো। ভদ্রমহিলার বিষাদের কারণ এবারে স্পষ্ট হলো ওর কাছে। যদিও এখনো বুঝতে পারছে না, কী বলতে ওকে ডেকেছেন তিনি।

‘…না, অসুবিধা নেই। আমি ঠিক আছি। আমার মেয়ে হয়তো কিছুদিন আগে মারা গেছে। কিন্তু আজ এগারোটি বছর ধরে আমি তো ওকে তিলে তিলে মরেই যেতে দেখছি। মা হয়েও মনে মনে ভেবেছি, এই কষ্ট সহ্য করার চেয়ে ওর বুঝি মৃত্যুই ভালো!
যুঁথিকা প্যারালাইজড ছিল। ওর শরীরের নিচের অংশ একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছিল। ২০০৬ সালের পনেরই সেপ্টেম্বরে ওর একটা ট্রেন এক্সিডেণ্ট হয়। ভয়াবহ এক্সিডেন্ট। ট্রেনের সামনের বেশ ক’টি বগি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাইনের বাইরে চলে যায়। অনেক লোক মারা যায়। যুঁথিকা প্রাণে বেঁচে যায় ঠিকই…কিন্তু… বাকি জীবনটা অসাড় মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে বেঁচে থাকার জন্যই বুঝি প্রাণটা ফিরে পায় সে…।’

সায়রার হৃদস্পন্দন যেন মূহুর্তের জন্য থেমে যায়। এই এক্সিডেণ্টেই ও ওর স্বামীকে হারিয়েছে। ভদ্রমহিলার মেয়েও একই এক্সিডেণ্টে প্যারালাইজড হয়েছে…! দুটো ঘটনার মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কি?
ভদ্রমহিলা সায়রার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। যেন স্থির চোখে ওর চোখের ভাষা পড়তে চাইছেন। বেশ কিছুক্ষণ চোখে চোখে কথা হলো তাদের মধ্যে। ভদ্রমহিলাই প্রথমে বলে উঠলেন,
‘তুমি কি আমার মেয়েকে কখনো দেখেছো?’
‘জি…আমি তো আসলে ঠিক…বুঝতে পারছি না। খুব চেনা লাগছে যদিও…’
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ভদ্রমহিলা। ক্লান্ত সুরে কেমন যেন টেনে টেনে বললেন,
‘একজন মা হয়ে নিজের সন্তানের এমন গল্প শোনানোর জন্য কোনো মাই প্রস্তুত থাকেন না। তবু কিছু কিছু মায়ের ভাগ্যটাই এমন মন্দ হয়। সন্তানের এমন গল্প মুখ ফুটে বলার আগে সব মায়েরই যেন…’
এটুকু বলেই তিনি হঠাৎ নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। ডুকরে কেঁদে উঠলেন আঁচলে মুখ গুঁজে।
সায়রা একেবারে অপ্রস্তুত। সে এখনো পুরোপুরি অন্ধকারে। কী গল্প শোনাতে চলেছেন ভদ্রমহিলা তাকে?
‘আমার মেয়ে যুঁথিকা’র সাথে তোমার স্বামী আদিলের অবৈধ সম্পর্ক ছিল।’
সায়রার পায়ের নিচটা ভীষণভাবে দুলে উঠলো। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলো,
‘কী যা তা বলছেন আপনি!’

সায়রা অনুভব করলো ওর মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে। কানের পাশটা জ্বলছে রীতিমতো। প্রচণ্ড রেগে গেলে এমনটা হয় ওর। সামনে যে একজন মায়ের বয়সী মানুষ বসে আছেন সেই ব্যাপারে সায়রা এখন পুরোপুরি অজ্ঞ। ভদ্রমহিলা কিন্তু সায়রার আচরণে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি যেন জানতেন এমনটাই হবে…এমনটাই যে হওয়ার কথা!
‘যদি এই কথাটি মিথ্যে হতো, তাহলে তোমার মতো আমিও সবচেয়ে সুখি হতাম। কিন্তু তা হওয়ার নয়!
যুঁথিকা একটা এনজিওতে চাকরি করতো। সেই এনজিও তে চাকরির সুবাদে ওকে বিভিন্ন ট্যুর করতে হতো। একবার ওকে শহরের কলেজগুলোতে কিছু জরিপ করার জন্য যেতে হয়।

তোমার স্বামী আদিলের ওপরে দায়িত্ব পড়ে যুঁথিকাকে সাহায্য করার। দায়িত্বটা অন্য যেকোনো শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকার ওপরেই পড়তে পারতো। কিন্তু… তাহলে হয়তো গল্পটা এরকম হতো না।
ওদের মধ্যে এই কাজের হালকা সূত্র ধরেই একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আদিল মাঝেমাঝেই যুঁথিকা’র অফিসে যেতে শুরু করে। দুজনের মধ্যে যাকে বলে…প্রেম ভালোবাসা…সেই রকমই একটা কিছু তৈরি হয়।’
সায়রার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদও করতে পারছে না। এসব কী বলছেন ভদ্রমহিলা! কই, এমন কিছু তো সে কোনদিন শোনেনি!
ভদ্রমহিলা কিন্তু থামছেন না। সায়রার প্রতিক্রিয়া নিয়েও তিনি ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাকে যেন গল্প শেষ করার তাড়নায় পেয়েছে। ভয়ংকর এক গল্প!
‘আমি প্রথম ওদের ব্যাপারটা জানতে পারি যুঁথিকার এক বান্ধবীর কাছ থেকে। ওরা জানতো আদিল বিবাহিত, এক সন্তানের জনক। সে যুঁথিকাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল, পারেনি। আমি যাতে ওকে বোঝাই, সেজন্যই আমাকে সবকথা বলে দেয় সে।

আমি অনেক চেষ্টা করি। যাকে বলে সর্বাত্মক চেষ্টা। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরে এই মেয়েটিই ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন। আমি ওকে এই রকম একটা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে দেখে আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করি।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। যুঁথিকা মনে করতো, আদিল তাকে বিয়ে করবে। আদিল নাকি তাকে সেইরকম প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল।
তোমার আর তোমার সন্তানের কথাও জুঁথিকা জানতো। আদিল নাকি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ওর কাছে চলে আসবে, এমনটাই ওকে বুঝিয়েছে।
আমি বুঝতে পারলাম, যুঁথিকাকে ফেরানোর সাধ্য আমার নেই। আমি আদিলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম।’
মূহুর্তের নীরবতা। কিছুক্ষণের একটা দম নিলেন ভদ্রমহিলা।
সায়রা শুনছে।
সে আজ শ্রোতা মাত্র। এর বেশি আর কিছুই করার নেই তার।

চার:
‘আমি আদিলের সাথে কথা বলি। আদিল জানায়, সে যুঁথিকাকে বিয়ে করতে চায়। তাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চায়। অন্য কোথাও চলে গিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চায়।
আমি ওকে ওর স্ত্রী আর সন্তানের কথা বলি। সে জানায়, পুরনো জীবনে সে নাকি হাঁপিয়ে উঠেছে। সে তার সংসার জীবনে সুখী নয়…ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি বুঝতে পারি, কাউকেই ফেরাতে পারবো না। তখন আমি তোমার সাথে যোগাযোগেরও চেষ্টা শুরু করি। সেটা মনে হয়, ওরা কোনভাবে বুঝতে পেরে যায়।
তারপরে আমার অজ্ঞাতেই ওরা বিয়ে করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই শহর ছাড়ারও চিন্তাভাবনা শুরু করে ওরা। আদিল রাজশাহী কলেজে বদলির চেষ্টা করছিল। আর যুঁথিকাও রাজশাহীর জোনাল অফিসে নিজের বদলী করিয়ে নেয়। এভাবেই আঁটঘাঁট বেঁধে নামে দু’জনে।
পনেরই সেপ্টেম্বরের ট্রেনে চেপেই ওরা রওয়ানা দিয়েছিল। যুঁথিকা’র ঘরে বিছানার ওপরে রাখা চিঠি পড়ে সবকিছু জানতে পারি আমি।
কিন্তু…ভবিতব্যকে কে কবে ঠেকাতে পেরেছে!
ওদের ট্রেন এক্সিডেন্ট হয়। হতাহতদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারপরে…যুঁথিকা আবার ফিরে আসে আমার কাছে।
বাকি জীবনটা বিছানায় শুয়েই কাটিয়ে দেয় যুঁথিকা। নিষ্ক্রিয়, চুপচাপ…পঙ্গুত্বের জীবন।
তোমার জীবনটা অথর্ব করে দেওয়ার খেলায় মেতেছিল, সৃষ্টিকর্তা তাই ওর জীবনটাকেই অথর্ব বানিয়ে ছেড়েছেন।’
সায়রা চুপ করে শুনছিল এতোক্ষণ। এবারে মুখ খুললো,
‘এতদিন পরে এসব কেন বলতে গেলেন আমাকে? আমার কী প্রয়োজন ছিল এসব জানার?’
‘আমি জানি তোমার কোনো প্রয়োজন নেই সায়রা। আসলে প্রয়োজনটা আমারই ছিল। আমি আমার মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই তোমার কাছে।
আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো তোমার স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টা জানো। একেবারেই যে কিছু জানো না, এটা আসলে আমি বুঝতে পারিনি।
যুঁথিকাকে যখন একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি, তখন বুঝতে পেরেছি এসব ওর প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া আর কিছু নয়। তাই মা হয়ে সন্তানের কষ্টে কষ্ট পেলেও মনে মনে স্বস্তি পেয়েছি এই ভেবে…ওর পাপের কিছুটা হয়ত ও এই দুনিয়াতেই খণ্ডন করে গেল!
কিন্তু আমি জানি, তুমি ক্ষমা না করলে আমার মেয়েটা কখনোই পুরোপুরি ক্ষমা পাবে না।
তুমি কি পারবে মা… আমার পাপী এই মেয়েটাকে ক্ষমা করতে?’
ভদ্রমহিলা আবার কাঁদতে শুরু করেছেন।
সায়রা উঠে দাঁড়ালো। একটাও কথা না বলে পা টেনে টেনে বেরিয়ে এলো বাইরে।
আর বাইরে বের হয়েই ওর মনে পড়ে গেল… কবে সে এসেছে এই বাড়িটাতে।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। আদিলের মৃত্যুর বছরেরই ঘটনা। আদিল, আর সায়রা সেদিন বেড়াতে বেরিয়েছিল আদিবকে নিয়ে। হঠাৎ আদিল একটা ফুলের দোকানে গিয়ে কিছু ফুল কেনে। তারপরে বলে,
‘আরে, আমার কলেজের এক কলিগের বাসা এখানে! আজ তার জন্মদিন। চল, একটু শুভেচ্ছা জানিয়ে আসি।’
সায়রা একটু আপত্তি জানিয়ছিল, ‘চিনি না…জানি না!’ কিন্তু আদিল শোনেনি কিছু। সেদিনই এসেছিল এই বাসায়। দরজা খুলেছিল যুঁথিকাই। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। আদিল সহাস্যে বলেছিল,
‘সেদিন কলেজে বললেন না, আজ আপনার জন্মদিন! দেখুন, ঠিক মনে রেখেছি…!’
ওরা বসেনি সেদিন। শুধু বাসার সামনে থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েই ফিরে গিয়েছিল। সায়রার একটু অবাক লেগেছিল ঠিকই, তবে খুব বেশিক্ষণ মাথায় ছিল না ব্যাপারটা।
সহকর্মী, শুভেচ্ছা তো জানাতেই পারে!
সায়রার মাথাটা এখনো কেমন যেন স্থবির হয়ে আছে।
ওর নিজের জীবনে তো কোন অতৃপ্তি ছিল না! আদিল এতোখানি অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে ছিল ওর সাথে? সায়রাকে বললে ও নিজেই তো সরে যেতে পারতো আদিলের জীবন থেকে। এভাবে নিজেকে প্রতারিত করে বেঁচে থাকার কী মানে হয়?
কোনো এক উপন্যাসে পড়া একটি লাইন আচমকাই মনে পড়ে গেল সায়রার,
‘বিছানার চেনা মানুষ, অচেনা সে অন্তরে…’

বাসায় ফিরে মনে হলো এখনো সময় আছে। একবার বাজারে যাওয়া যাক। আদিবের এই খুশির দিনটাকে ওর অবশ্যই উদযাপন করতে হবে।
বাজার করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে সায়রা। আদিব এই অসময়ে মাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়। বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার মা? তুমি এই সময়ে রান্না করতে বসেছো কেন?’
‘এত ভালো রেজাল্ট করলি! একটু খাওয়াবো না কাউকে?’

আদিব বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। তারপরে বলে,
‘মা, তুমি কি ভুলে গেছ এটা কী মাস? সেপ্টেম্বর! বাবা এই মাসে মারা গিয়েছে মা। আমি এই মাসে আমার রেজাল্টের খুশি উদযাপন করবো? তুমি কীভাবে ভাবলে!’
সায়রা আদিবের কথা শুনে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে বলে,
‘আর কোনদিন ভুলবো না রে। দেখিস, সব জমা রেখে দিব মনের মধ্যে…’
আর মনে মনে বলে,
‘সে ভুলে ভুলুক…কোটি মন্বন্তরে…আমি ভুলিব না…আমি কভু ভুলিব না…’।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.