নিজেরে হারায়ে খুঁজি

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন:

সেদিন বিকেলে গেলাম আমার এক বোনের বাসায়। ঢুকে থ। সারা বাসা নিস্তব্ধ। সবাই ব্যস্ত যার যার মোবাইল নিয়ে। বোন ওর বান্ধবীদের সাথে করছে গ্রুপ চ্যাটিং। বর ইউটিউবে দেখছে নাটক। ছেলে খেলছে ভিডিও গেম। আর মেয়ে বন্ধুদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে লিখছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। যার যার জগতে সবাই ভীষণ ব্যস্ত। সবার চোখ স্ক্রিনে। আমি যে বাসায় ঢুকলাম কেউ খেয়ালই করেনি। দরজা খুলে দেয় বাসার সাহায্যকারী মেয়েটা।

সুপ্রিয় পাঠক, এ আমাদের প্রতিদিনের চেনা ঘটনা। চেনা দৃশ্য। আমাদের অনেকেরই বাসায় এ ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে আজকাল! প্রায় সব বাসার প্রতিটি সদস্য আজ ভয়াবহ ভাবে আসক্ত  হয়ে পড়েছে ভারচুয়াল  জগতে!  আমি আপনি সবাই আজ পড়েছি ফেসবুক প্রেমে। আমরা প্রতিনিয়ত  ঘুরছি এ পেজ থেকে অন্য পেজে! গােলক ধাঁধার মতাে! ভুলে যাচছি কথা বলা। প্রাণখুলে হাসা! দিন দিন হয়ে উঠছি আত্মকেন্দ্রিক। স্বার্থপর। সবাই যার যার মতো তৈরি করছি নিজস্ব জগত। সে জগতে নেই সবার প্রবেশের অধিকার। মা জানেন না ছেলের ভাবনা। ছেলে ভাবে, বাবা অনেক দূরের। বোন, ভাই আর করে না ছেলেবেলার মতো খুনসুটি। আহ্লাদ আবদার সব অনুভূতি যেন আজ যান্ত্রিকতায় পরিণত হচ্ছে। সেখানে নেই কোনো প্রাণোচ্ছ্বলতা। যা কিছুর প্রকাশ সব যেন শুধুই ফেসবুকে।

এক বন্ধুর জন্মদিন। ও সকাল থেকে অপেক্ষা করছে বর উইশ করবে। দিন গড়িয়ে বিকেল নামে। বর কিছুই বলে না। অনেকটা অভিমান করে বন্ধুটি বললো- তুমি আমাকে উইশ করলে না তো! বর অবাক! করেছি তো। ফেসবুকে দেখোনি। বন্ধু ফেসবুক খুলে দেখে সেখানে শুধু লেখা এইচবিডি (হ্যাপি বার্থ ডে)। ও হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছিলো না।
কি ফর্মাল হয়ে যাচ্ছে আমাদের মধুর সর্ম্পকগুলো। জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকী, উৎসবের শুভকামনা আজ পড়ে নিতে হয় ফেসবুকে। মুখে কেউ বলে না। আবেগে জড়িয়ে ধরে আজকাল আর কেউ বলে না শুভ জন্মদিন, ভালো থেকো। পাঠায় না গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ঈদ বা জন্মদিনের কার্ড। আসে না চমকে দেয়ার মতো গিফট।

স্বামী স্ত্রী, ছেলে মেয়ে বোন ভাই সবাই সবার জগত নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। যোগাযোগ হয় তাদের ফেসবুকে। অনেকেরই পারিবারিক গল্প হয় না আগের মতো। আবেগ অনুভূতি স্নেহ নিয়ে অনেকেই হয়তো আর ভাবেন না। সবার আগ্রহের জায়গা আজ অন্যদের দিকে। ফেসবুকের দিকে। অন্যের পরিবারের হাসি মুখের ছবি, আড্ডার ছবি, নানা সাজের, নানা ঢংয়ের ছবি দেখে দেখে সবাই হোন মুগ্ধ। কেউ কেউ হোন আবার বিভ্রান্ত। কেউ বা হোন ইর্ষান্বিত। নিজেকে সুখী নয়, অন্য পরিবারের সুখ দেখে গোপনে ফেলেন দীর্ঘশ্বাস। ভাবেন আহা! কীসব সুখী পরিবার! আসলেও কি তারা সবাই সুখী ? জানা হয় না। তবে এর প্রভাব পড়ে নিজ পরিবারে। মনে সুখ খুঁজতে গিয়ে ঘরে ঘরে বাড়ে ঝগড়া, হতাশা ভাংচুর। আর তখন অন্যের পরিবারের মানুষগুলোকে যারা ভাবেন, আহা কী স্মার্ট! কী সুন্দর!! তারা তখন নিজের পরিবারকে মনে করেন ম্যাড়ম্যাড়ে, পানসে। ঠিক তখনই সর্ম্পকের সমীকরণে বাড়তে থাকে জটিলতা।

সুপ্রিয় পাঠক,
ভার্চুয়ালের চাকচিক্যময় ভুবনে ঢুকে অনেক মানুষ আজ নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলছেন। নিজেকে মহান আর ভালো দেখানোর জন্য কেউ কেউ পরিবারের মানুষদের উপেক্ষা করে বেশি গুরুত্ব দিচছেন ফেসবুক বন্ধুদের। বাহবা কুড়ানোর লোভে সেখানে লেখা হয়  বড় বড় কথা। শেয়ার করা হয় নানা মনীষীদের বাণী। যা তিনি নিজেই হয়তো মানেন না। উপদেশের নানা মূল্যবান বাণী বাড়তে থাকে পেজজুড়ে।

এক পরিচিত ভদ্রলোকের কথা জানি তিনি ঘরের কাজে স্ত্রীকে কখনোই সহায়তা করেন না। খাবার খেয়ে প্লেটটা পর্যন্ত টেবিলে রেখে দেন। ভাবেন এসব নারীদের কাজ। অথচ সেই তিনি ফেসবুকে নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী, পুরুষদের নারীর কাজে সহায়তা, বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে এমন সব পোস্টে সবার আগে লাইক দেন। বিষয়টি নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি না করি কিন্তু আমার লাইক দেখে অন্যরা তাদের স্ত্রীকে সাহায্য করতে পারেন।

ফেসবুক অনেক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের যেমন কাছে নিয়ে এসেছে, তেমনি অনেক কাছের মানুষদের করেছে দূর। এ যেন নিজেকে গহিন  সমুদ্রে হারিয়ে ফেলে আবার নিজেকেই খুজতে বেরিয়ে যাওয়া!  ফেসবুক বন্ধুরা অবশ্যই কাছের, কিন্তু পরিবারকে বঞ্চিত করে নিশ্চয় নয়! এক সহকর্মী গল্প করছিলেন, ঈদের দিন তারা বেড়াতে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখেন পরিবারের শিশুদের নিয়ে বেড়াতে এসে অনেকে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। চ্যাটিং করছে তারা বন্ধুদের সাথে!  ছোট বাচ্চারা অসহায় হয়ে দেখছে বাবা-মা’র কাণ্ড কারখানা। কী শিখছে ওরা?

পথে বাসে ট্রেনে অফিসে আড্ডায় মানুষের চোখ আজ শুধু মোবাইলের স্ক্রিনে। পাশাপাশি বসে স্ত্রী দেয় এক স্ট্যাটাস। স্বামী দেয় আরেকটা। কেউ কারো মনের খবর জানেন না। অনেকে আবার গোপনীয়তা রাখার জন্য পরিবারের সদস্যদের বন্ধুলিস্টে রাখেন না। ফলে দিনে দিনে বাড়ে দূরত্ব। চলে যায় সময়!

রাত জেগে কিংবা গভীর রাতে আনাগোনা বাড়ে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের পেজে। লাইকের ঝড় উঠে পেজে পেজে। কত মানুষ পোস্টে লাইক দিলো, লাভ চিহ্ন দিলো, কি মন্তব্য লিখলো তা দেখার জন্য ক্রেজি হয়ে যায় অনেকে। অনেকে আবার ফোন দিয়েও বলেন পোস্টে লাইক দিতে।
অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহারের ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক আজ নষ্ট হতে বসেছে। মানুষ চিনছে না সত্যিকার মানুষের মুখ। পরিবারের মধুর সর্ম্পকগুলো ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর। তিরিক্ষি মেজাজ, রাগ হতাশা, পরকীয়া বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন। নষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস, ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।

পাশের রুমে অসুস্থ মা। তার সেবা না করে মার জন্য ফেসবুকে দোয়া চায় ছেলেমেয়েরা। সবাই লেখেন নানা মন্তব্য। অথচ সেসময় যদি মা’র কপালে ছেলেমেয়েরা ছোঁয়াতাে হাত, আনন্দে মার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তো দু’ফোটা জল। ভালোবাসার এই স্পর্শেই অনেকটা হয়তো ভালো হয়ে যেতেন মা। তাই শুধু ভার্চুয়াল জগতে আবেগ না দেখিয়ে বাস্তবেও আবেগ দেখান। মনখারাপ করা বিকেলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস না দিয়ে কােনাে বন্ধুকে বলুন না আপনার মনখারাপের কথা। তার সাথে চলে যান কোনো নদীর ধারে কিংবা বটের ছায়ায়।

ফেসবুক ব্যবহার করুন। তাতে নিজের অনুভূতি জানান। তবে সবার আগে তা শেয়ার করুন পরিবারের মানুষদের সাথে। তাদের বলুন আপনার ছোটবেলা, কৈশোর কিংবা বড়বেলার গল্প। শুনুন মনোযোগ দিয়ে বাড়ির সবচে’ ছোট শিশুটির কথাও। স্কুল কলেজে কিংবা অফিসে বাড়ির কাজে মজার মজার ঘটনাগুলো বলুন ঘরে আড্ডা দিতে দিতে। সবার একসাথে বসা এ মেলবন্ধন সম্পর্কের গভীরতা বাড়িয়ে দেবে বহুগুন। জীবন মনে হবে মধুর। সুন্দর। অন্য কোনখানে সুখ না খুঁজে নিজেকে খুঁজে পাবেন এসব সম্পর্কের মাঝেই। ফেসবুকের আসক্তি থেকে নিজেকে না সরালে ধীরে ধীরে একদিন ক্ষীণ হবে সম্পর্কের সুঁতো। প্রতিদিনের ভালোবাসার চেনা সব শব্দ একদিন  হয়ে যাবে যেন দূরের শোনা কোনো গল্প। তাই ফেসবুকে বেশি সময় না থেকে সময় দিন প্রিয়মানুষদের। ভালবাসার চােখে তাকান তাদের দিকে।

একুশে টেলিভিশন
[email protected]

শেয়ার করুন: