ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট পেরিয়ে: ধর্ষণ প্রতিরোধে সমাজের দায়ভার

ইরফানুর রহমান রাফিন:

প্রাপ্তবয়স্ক যে লোকটা ধর্ষণ করছে, মাথায় রাখা দরকার, সেও একটা নিষ্পাপ শিশু হিসেবেই একদিন এই পৃথিবীতে এসেছিলো। সে যে বড়ো হতে হতে অমানুষ হয়ে উঠলো, এতে একদিকে যেমন তার নিজের দায় আছে, অন্যদিকে যে-সমাজে সে বাস করে সে-সমাজেরও দায় আছে। স্ট্রাকচার-এজেন্সি সম্পর্কটা জটিল, শুধুই স্ট্রাকচারকে দায়ী করা যায় না বটেই, কিন্তু এজেন্সিও আবার একটা স্ট্রাকচারের মধ্যেই তৈরি হয়।

ধর্ষকের শাস্তি চাই। প্রচলিত আইনেই চাই। আবার প্রচলিত আইনও স্বর্গীয়, অপরিবর্তনীয় কিছু না। প্রাচীন ইহুদি সমাজ যেভাবে ধর্ষণকে ডিফাইন করতো, অপরাধীকে শাস্তি দিতো, আজকে একুশ শতকে এসে সেভাবে ধর্ষণকে ডিফাইন করা হয় না এবং শাস্তি দেয়ার ধরণেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। এক নদীতে দুইবার গোসল করা যায় না। কেউ একজন বলেছিলেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ডিনায়াল নামে একটা সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো, হলোকাস্ট স্কলার প্রফেসর দেবোরাহ লিপস্ট্যাডের জীবনের সত্য কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। হলোকাস্ট ডিনায়ার ডেভিড আয়ারভিং লিপস্ট্যাডের লেখা একটা বইয়ের ব্যাপারে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটেনের আদালতে মামলা করেছিলেন, কারণ আয়ারভিং জানতেন, ব্রিটেনের বিচার ব্যবস্থার একটা রিডিকিউলাস বৈশিষ্ট্য আছে। বিচারের ক্ষেত্রে ‘Innocent until proven guilty’ নীতি অনুসরণ করাটাকে স্বাভাবিক মনে করা হলেও ব্রিটেনে লিবেলের ক্ষেত্রে ‘Guilty until proven innocent’ নীতি অনুসরণ করা হয়, অর্থাৎ অপরাধী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্তেরই নিরপরাধ নন সেখানে, নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের দায় অভিযুক্তেরই!

শেষ পর্যন্ত লিপস্ট্যাড এই আইনি যুদ্ধে জেতেন। যা-হোক, এই উদাহরণটা টানলাম, অন্য একটা কারণে। বাংলাদেশের সাইবারস্পেস ব্রিটিশ আদালতগুলোর মতো হয়ে গেছে, কারো বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হলেই ধরে নেয়া হচ্ছে সে অপরাধী, বিচারের আগেই রায় ঘোষণা করে দিচ্ছেন কেউ কেউ।

সাইবার স্পেসের এই একইসাথে জাজ, জুরি ও এক্সিকিউশনারের ভূমিকা পালন করা ব্যক্তিরা অভিযুক্ত ধর্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলতে চান, তার লিঙ্গ কেটে নিতে চান, তার সাথে নির্দয় আচরণের পক্ষপাতী। যারা আরেকটু সাবধানী, তারা অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারটুকু দিতে রাজি, তবে অপরাধ প্রমাণ হলে এসব শাস্তির পক্ষপাতী। যে-সমাজ ধর্ষক তৈরিতে আংশিকভাবে হলেও ভূমিকা রাখলো সেটাকে কি শাস্তি দেয়া যায় কিনা, আর দেয়া গেলে কী শাস্তি দেয়া যায়, এই নিয়ে এদের কারো কোনো মাথাব্যথা নাই।

আমি নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি, আপনার বাপ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে, আপনি অবশ্যই চাইবেন অভিযুক্ত অন্ততপক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ পান। অপরাধ প্রমাণিত হলেও আপনি সর্বোচ্চ প্রচলিত আইনে আপনার বাপ-ভাইয়ের শাস্তি হোক সেটা মেনে নেবেন, কিন্তু পিটিয়ে মেরে ফেলা সমর্থন করবেন না, লিঙ্গ কর্তন করা সমর্থন করবেন না। এটা অবশ্য কারো দোষও না, জৈবিকভাবে কারণেই লোকে কাছের মানুষদের ব্যাপারে দুর্বল থাকে, আপনার বায়োলজির ওপরে তো আর আপনার হাত নাই।

কিন্তু নিজের বাপ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে নমনীয়তা দেখাবেন, তার একশোভাগের একভাগও যদি অন্যের বিরুদ্ধে না দেখান, তাহলে আপনার প্রতিবাদের মোরাল গ্রাউণ্ড নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।

প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক।

অপরাধ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা রিভিজিট করা জরুরি। পানিশমেন্টের প্রয়োজন আছে। কিন্তু শুধুই শাস্তিতে সমাজ অপরাধমুক্ত হয় না।

মানবিকও হয় না।

অরুন্ধতী রায় একবার একটা সুন্দর কথা লিখেছিলেন। যে-সমাজে এতো বেশি মানুষ Terrorist হয়ে উঠছে, সেই সমাজের ভিতেই কোনো সমস্যা আছে। মানবিক সমাজে এতো লোক বেলাইনে যায় না।

সারাক্ষণ শাস্তিপ্রদানে আগ্রহী সমাজ নিজেই ধর্ষকামী সমাজ। সে ধর্ষককে সামাজিকভাবে ধর্ষণ করতে চায় মাত্র। এটা ন্যায়বিচার না।

একটা ডিফেন্সলেস মানুষকে, সে যতো খারাপই হোক না কেনো, অসংখ্য মানুষ দল বেঁধে পেটাচ্ছে এটা কোনো মানবিক কাজ হতে পারে না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সৈনিককে হত্যা করা এরচে অনেক বেশি মানবিক, কারণ সে-ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সৈনিকের হাতে একটি অস্ত্র থাকে। কিন্তু যার নিজেকে রক্ষা করার উপায় নেই, তাকে পিটিয়ে হত্যা করা পৃথিবীর ঘৃণ্যতম কাজ, ধর্ষণের সমতুল্য অপরাধ।

লিঙ্গ কর্তনের চিন্তাটাও দর্শনগতভাবেই একটা ভুল চিন্তা। ধর্ষণের ক্ষেত্রে লিঙ্গ স্রেফ একটা টুল, ধর্ষণ লিঙ্গের কারণে হয় না, হয় ধর্ষকামী মস্তিষ্ক আর মনের কারণে। সেই মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করবে আর মন কী ভাববে সেটাও আবার অনেকটাই সামাজিক নির্মাণ, পুরোটা নয়, অনেকটা। ধর্ষকের মস্তিষ্ক কেটে বের করার কল্পনাও করতে পারি না, আর মনের হদিস বিজ্ঞানীরা আজো পান নাই, তাঁরা বায়োলজিকাল এলগরিদম পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছেন মাত্র। আমার ধারণা ভবিষ্যতে লিঙ্গ দিয়ে কেউ ধর্ষণ করবে না, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বাজারে রেপ ডিভাইস কিনতে পাওয়া যাবে। একটা মেয়েকে বা ছেলেকে ধর্ষণ করার জন্য ধরে আনা হবে, তারপর তার ব্রেইনের সাথে সেই ডিভাইস কানেক্ট করা হবে, তারপর ডিভাইসটা চালু করা হবে যাতে মেয়েটা বা ছেলেটার মধ্যে রেপড হওয়ার ফিলিংস হয়। অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় মেয়েটা বা ছেলেটা যখন চোখ মুখ কুঁচকাবে, সেটা দেখে যে সুখ পাবে ধর্ষক, সেটাকেই সে ধর্ষণ করা হিসেবে দেখবে।

এই মুহূর্তে মেয়েরা ধর্ষণ করতে পারেন না। বা, ধর্ষণকে আমরা এই সময়ে যেভাবে ডিফাইন করি, তাতে কোনো মেয়ের পক্ষে ধর্ষক হওয়া সম্ভব হয় না। আমরা ধরেই নেই, পুরুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেক্স করা সম্ভব না, ফলে কোনো মেয়ে জোর করতে পারে না।

তখন কিন্তু পারবে। অনেক মেয়েও বাজার থেকে রেপ ডিভাইস কিনবে। এবং, আমার আশেপাশে যেই পরিমাণ ধর্ষকামী মেয়ে দেখি, আমার মনে হয় না তাদের সংখ্যাটা খুব কম হবে।

আমরা যদি আসলেই এমন ভবিষ্যৎ না চাই, চাই ধর্ষণ না থাকুক বা এতোটা কমে আসুক যে ঘটলে সেটাকে ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা হিসেবে দেখা হবে, তাহলে আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অভ্যস্ত চিন্তাগুলো আস্তে আস্তে পাল্টাতে হবে। সোশাল ক্রাইমের কোনো পার্সোনাল সমাধান থাকে না। প্রতিটা মানুষের মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সে নারী পুরুষ শিশু ট্রান্সজেন্ডার কুইর যেই হোক, এই বোধ প্রতিটি শিশুর মধ্যে ছোটোবেলা থেকেই তৈরি করতে হবে।

এই মানবিক মর্যাদার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ শরীরের সার্বভৌমত্ব, কারো স্পষ্ট মৌখিক সম্মতি ছাড়া তার সাথে সেক্স করাই ধর্ষণ, এটাও একটা বয়সের পর সব মানুষের বাচ্চাকে বোঝাতে হবে। সব দায় বাপ-মার ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ নাই, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ-ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে ধর্ষণ হয়তো শূন্যের কোঠায় নামবে না, কিছু লোক হয়তো এ-সব শিক্ষা নেবে না, তারা অমানুষই হবে। কিন্তু, ধর্ষণ প্রতিরোধে গণপিটুনি বা লিঙ্গ কর্তনের চেয়ে এগুলো অনেক বেশি কার্যকর হবে, এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচয়ঃ

ইরফানুর রহমান রাফিন – গবেষণা সহযোগী, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার-এইচডিআরসি। তার সাথে যোগাযোগঃ [email protected]। তার ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/irfanurrahmanrafinofficial/ এবং ওয়েবসাইট http://irfanurrahmanrafin.net/

শেয়ার করুন: