সাজু বিশ্বাস:
ঢাকা নিউমার্কেটের ওড়নার দোকানে ঢুকেছিল একটি মেয়ে। দরেদামে পছন্দের ওড়নাটি কেনার ব্যাপারে দোকানির সাথে বনিবনা হয় নাই, মেয়েটি একটু মন খারাপ করেই ফিরে যাচ্ছে,বাজেট কম থাকায় নিজের পছন্দের জিনিষ কিনতে পারছে না, এতে যে কারোরই মন খারাপ হবার কথা। মেয়েটি দাম কমানোর চেষ্টা করেছিল, নিজের কাছে যা পয়সা আছে তার মধ্যেই দোকানি রাজি হলে সে ওড়নাটি কিনে নিতে পারতো। মেয়েটি মুখ কালো করে দোকান থেকে উঠে পড়লো। তাকে সামনের আরো দুটি দোকান দেখতে হবে। কেউ না কেউ তো কিছু অল্প লাভে এই জিনিষটি বিক্রি করবেই,—- সবাই তো আর কড়া কড়া লাভে জিনিষ বিক্রি করে না!
সামান্য আর পঞ্চাশ টাকা কম হলেই মেয়েটি তার বাজেটে ওড়নাটি নিতে পারবে। মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে দোকান ছেড়ে পা বাড়িয়েছে, দোকানি যখনি পুরোপুরি নিশ্চিত হল যে মেয়েটি আর ওড়নাটি কিনবে না, তখন সে মেয়েটিকে হেনস্থা করার একটি উপায় সামনে পেয়ে গেল। সে সুর করে বলতে লাগলো, আপা, নিবেন না, আসেন দিয়ে দিই………. অনেক বড় আছে,….. আসেন দিয়ে দিই “।
বাংলাদেশের মেয়েরা শরীরে একটু বড় হবার পরই পথেঘাটে এই ধরনের শব্দ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়। মেয়েটি তৎক্ষনাত দোকানির এই বাজে ব্যবহারের প্রতিবাদ করতে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আশেপাশের দোকানিরা এমনকি রাস্তার পথচারী পুরুষদলও তেড়ে এলো। — মাইয়া মানুষ, এত তেজ কিসের? যাও ঘরে যাও।
মেয়েটি অপমানে জ্বলতে লাগলো। সে হাল ছাড়লো না। সে থানার দিকে এগুলো। অনেক জল গড়ানোর পর সেই দোকানিকে পুলিশে ধরিয়ে তার নামে একটি মামলা করতে পেরেছিল মেয়েটি। সেই মামলার কী আপডেট আছে, আদৌ বিচার হবে কিনা,—- এখবর জানি না আর।
কিন্তু একটা কথা জানি, হরহামেশাই এই কাহিনী ঘটে পথেঘাটে। বুড়ো লোক, মুখে দাঁড়ি আছে, সামনের ভীড়ে কোন তরুণী মেয়ে দেখলে তার গা ঘেঁষার জন্য এগিয়ে আসে। কাছ দিয়ে দ্রুত চলে যাবার সময় আচমকা মেয়েটির বুকের কাছে কুনুই দিয়ে একটা খোঁচা দিতে পারলেই তার স্বর্গসুখ হয়। এই বুড়োই কোন তরুনীর বাবা বা দাদা, — তিনকাল পার করে এককালে এসে ঠেকেছে!
নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানের সামনে ভীড়ের মধ্যে হাঁটা যায়।সেখানের বেশিরভাগই ছাত্র। যার যার কাজে সে সে দৌড়োচ্ছে। হঠাৎ যদি কোন ছেলের সাথে কোন মেয়ের ভুল করে প্রচন্ড ধাক্কা লেগে যায়,— দুইজনেই মুখোমুখি সরি বলতে বলতে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করে। কিন্তু নীলক্ষেত পার হলে ঠিক একটু সামনে সিনেমা হলের লাগোয়া যে ওভারব্রিজ, তার নিচের চিত্র ভয়ঙ্কর। কিছু ইয়ঙ এবং আধবুড়ো পুরুষ জটলা পাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো একলা মেয়ে একটু ভুল করে একবার সেই ভিড়ে যদি পড়ে যায়, তার পুচ্ছদেশ বক্ষদেশ যেখানে যে যেমনে পারে হাত চালিয়ে দেয়। এই লোকগুলো কেউ একলা নয়। এরা ভিড়ের মধ্যেই থাকে, এবং দারুণ হাসি হাসি পরিতৃপ্ত চেহারা! এরাও আমাদেরই কারোর ভাই – বন্ধু- আত্মীয়স্বজন হয়।
এরা সবাই আমাদের দেশেরই মানুষ।
একদম খুব খারাপ পর্যায়ে অথবা প্রাণনাশ অথবা মৃত্যুশঙ্কা পর্যন্ত না পৌঁছালে যৌন নির্যাতন বাংলাদেশে জানাজানি হয় খুব কম। প্রতিদিন যে কয়টা ঘটনা পত্রিকায় আসে, প্রতিদিন ঘটে তার চেয়ে কয়েক হাজারগুণ বেশি। আমাদের
উচ্চবর্গীয় মানবতাবাদীরা তা হয়তো আন্দাজও করতে পারে না। কেউ কেউ ভাবে, কাজের মেয়ের শরীর তার মালিকের অধিকার… কাজেই সে রেইপ হতেই পারে।
কেউ কেউ ভাবে, মেয়ে কেন একলা বাজারে যায়, কাজেই সে খারাপ অবস্থার শিকার হতেই পারে। গার্মেন্টসে কাজ করে যে মেয়ে, তার আবার ইজ্জৎ কিয়ের! কেউ কেউ আবার ভাবেন, দেহব্যবসা যার পেশা, সে রাস্তার গাড়ির মধ্যে দিনে-দুপুরে হইলেও তেমন অসুবিধা নাই।… খালি বিনা বিচারে কারো গায়ে হাত দিলেই দোষ! পুলিশ আগে বিবেচনা করে ক্রাইম সিন ঘোষণা করবে, তারপর অনুমোদিত পত্রিকা সেই ক্রাইম সিন পাব্লিশ করবে।
… ইহা মানবতাবাদ।
কী সেই মাকালফল!
আবার প্রাচীন যুগ আর রেনেসাঁয় ফিরে যাই। সক্রেটিসের আগে যারা ধর্মীয় রীতিনীতি ছাড়াই স্রেফ যুক্তি আর চিন্তার সাহায্যে পুরাণের ব্যাখা করতেন, তারা ছিলেন মানবতাবাদী। রেনেসাঁয় যারা ধর্মের সাহায্য ছাড়াই জীবন ও জগতকে ব্যাখা করতেন, তারা ছিলেন মানবতাবাদী।
এখন যারা আদালতে প্রমাণের আগেই নির্যাতন কোন নির্যাতন নয় বলেন, তারাই কি মানবতাবাদী! মানে, আপনি হয়তো দেখলেন, কোন লোক একটি মেয়ের সাথে চরম অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করছে, বাদ দিন, ধরুন আপনি দেখলেন মেয়েটির বা শিশুটির…সে ছেলেশিশুও হতে পারে … প্রায় প্রাণসংশয় অবস্থা… আপনি মনে মনে বলবেন, দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে! তারপর আপনি ফোনে পুলিশ ডাকবেন। লোকটিকে কিন্তু কিচ্ছুটি বলা যাবে না! কারণ আমাদের আদালত না বলা পর্যন্ত চোখের বিশ্বাস নেই! এরপরে পুলিশ এলো, লোকটি এই ফাঁকে কাজকম্মো সেরে সরে পড়তে না পারলে পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করলো! ভেরি আনস্মার্ট বয়! আপনি মনে মনে বললেন, লে হালুয়া! এইবার ঠ্যালা সামলা!
আপনার কাছে লোকটির কুকর্মের ছবিও আছে, আপনি মানবতাবাদী ইতিমধ্যে অপরাধের ছবি তুলে নিয়েছেন। কিন্তু আপনি তা আর লোকদের বলবেন না। মানবতাবাদ বিরাট ধর্ম্ম! পুলিশের পিছন পিছন মিডিয়াও এসে গেছে। আপনি যুধিষ্ঠিরের মতো সেই প্রমাণ কপি তাদের হাতে দিবেন। বলা যায় না, ক্রাইমসিনের নায়ক যদি দামি প্লেয়ার হয়, সে মিডিয়ার সামনে বিরাট টাকায় অংক রেখে দিল! আপনার রেকর্ড প্লে করার সময় ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন আর অন্জু ঘোষের নাচ বেরিয়ে এলো! সাব্বাশ বেটা! এখনো লোকটাকে অপরাধী বলা যাচ্ছে না। সামনে আদালত আছে। এইবার লোকটিকে আদালতে আনা হলো, মেয়েটিকে বা শিশুটিকে বলা হলো, — তুমি যে রেইপ হইছো, প্রমাণ দেও? তুমি সেখানে কি উদ্দেশ্যে গেছিলা ওইটা আগে বলো?”
এইবারও আপনি মানবতাবাদী এগিয়ে এলেন। আপনি বলতে লাগলেন, — ধর্মাবতার, আমি নিজে সাক্ষী। এই ভিকটিম নিরাপরাধ। লোকই দোষী। গুড! গুড জব। আপনার এই সাক্ষ্যে লোকটির মৃত্যুদণ্ড হলো। আদালতই শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু আপনি তো মানবতাবাদী! আপনি সমস্ত মানুষের জন্য! আপনি এইবার চ্যাঁচাতে থাকলেন, —” নো….হ্! মৃত্যুদণ্ড শাস্তি দেয় বর্বর দেশের লোকেরা। আমরা তো সভ্য জাতি। এমনকি কাউকে শারীরিক আঘাত করারও কারো রাইট নাই, মানুষের শাস্তি হওয়া উচিৎ অর্থদণ্ড এবং কারাদণ্ড”।
ব্যস, খেল খতম। এদিকে কুদ্দুস নামক অপরাধীর এমন একটা গুরুতর অপরাধ করার পরও তেমন কিছু হলো না দেখে করিম, কানাই নামক আরো শ্বাপদের পাল হামলে পড়লো রাস্তাঘাটে। আর আপনি মানবতাবাদী দুনিয়ার তাবত সভ্য দেশের রেফারেন্স খুঁজতে খুঁজতে ‘ফর্মুলা নাইন’ নামে এক বিখ্যাত বই-ই লিখে ফেললেন!
কোন ইয়াবা ব্যবসায়ী, কোন রাজনৈতিক চরমপন্থি আর কোন যৌন নির্যাতনকারী যে এক নয়, এতোটুকু বিচারবোধ কবে মানুষের হবে তা কে জানে!