কামরুন নাহার:
মহীরুহ ছোট গাছগুলোকে ছায়া দেয় ঠিকই, কিন্তু তার আড়ালে ছোট গাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে না। অমিতাভ বচ্চনের সন্তান হয়েও অভিষেক বচ্চন অমিতাভকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি, কারণ অমিতাভ হচ্ছেন মহীরুহ, আর তার ছায়ায় অভিষেকের বেড়ে ওঠা এবং সেটাকে ছাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
এক ঘরের দুই সুপারস্টারকে ভারতের সিনেমার দর্শক যুগপৎ নেয়নি; তাই অভিষেক অমিতাভের পুত্র হিসেবেই বেঁচে আছেন, সুপারস্টার হিসেবে নয়।
কাপুর পরিবারের রাজ কাপুর তাঁর সময়ে একাই রাজত্ব করেছেন। তাঁর থেকে সাত বছরের ছোট তাঁর ভাই শাম্মি কাপুর এবং ১৪ বছরের ছোট শশী কাপুরও সুনাম কুড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বলা বাহুল্য সেটা রাজ কাপুরকে ছাড়িয়ে যাবার মতো নয়। পরবর্তীতে ঋষি আর রনধীর কাপুর যখন প্রায় একসাথে ফিল্মে এলেন, তখন দর্শকনন্দিত শুধু ঋষি কাপুরই হয়েছেন। মানুষ এখনও তাঁকেই চেনে এবং এখনও তিনি ছবিতে অভিনয় করেন।
কারিনা কাপুর যখন ফিল্মে আসেন, কারিশমা তখন মোটামুটি শেষের দিকে (বলিউডের নায়িকাদের বয়স কচুপাতায় পানির মতো)। যার কারণে ‘কাকে রেখে কাকে নেবো’ অবস্থায় দর্শককে পড়তে হয়নি। রনবীর কাপুরও সেই সময়ই ফিল্মে এসেছেন যখন ঋষি কাপুর আর কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজ করেন না। তাই দর্শক তাকে লুফে নিলো।
অনিল কাপুরের তুমুল জনপ্রিয়তার আড়ালে তার ছোট ভাই সঞ্জয় কাপুরকে অনেকে চিনলোই না। অনিলের ছেলে হর্ষবর্ধন কাপুরকে আজও অনেকে চেনে না (যদিও সে নতুন), সেটা অনিলের দর্শকপ্রিয়তার কারণেই। বনির ছেলে অর্জুন কাপুর কিছুটা নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছে অনিলের ছেলে না হয়ে ভাস্তে হবার কারণে। অনিল-হর্ষবর্ধন এর অবস্থা অমিতাভ-অভিষেকের মতো অর্থাৎ মহীরুহের আড়ালে ছোট গাছ। বেচারা বাটে পড়ে গেলো। ঋষি -রনবীরের এই অবস্থা হয়নি, কারণ ঋষি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন না। আর অনিল কাপুর এখনও পর্দা কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন হাঁটুর বয়সী নায়িকাদের সাথে যেমনটা কেন্দ্রীয় চরিত্রে এখনও দাপটের সাথে অভিনয় করেন অমিতাভ।
সালমান খানদের তিন ভাইদের মধ্যে একমাত্র সালমানকেই দর্শক নিয়েছে; বাকি দুজনের অবস্থা আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলার মতোই, যদিও দুই ভাই আরবাজ আর সোহেলকে প্রতিষ্ঠিত করাতে সালমান কম চেষ্টা করেননি। মিঠুনের ছেলে মিম্মু আজও স্ট্রাগল করছে মিঠুনের দর্শকপ্রিয়তার সামনে। ঋত্বিকের সাথে তার বাবার তুলনাই চলে না, কারণ রাকেশ রোশান ওই মাপের অভিনেতা ছিলেন না।
একই অবস্থা হয়েছে তুষার কাপুরের বেলাতেও। স্টার কিড হওয়াতে তার বাবার সাথে তার তুলনাটা চলেই আসে, আর সেখানে সুদর্শন ও স্টার বাবার সন্তান হিসেবে তুষারকে দর্শক নেয়নি। জ্যাকি শ্রফের বাজার একেবারেই নেই, তাই টাইগারের গর্জন করা সহজ হয়েছে (যদিও গর্জনের শব্দ খুব বেশিদূর এখনও না গেলেও সম্ভাবনা আছে বিপুল)।
কাজল নায়িকা হিসেবে সুপারহিট, কারণ তিনি যখন নায়িকা, তার মা তনুজা তারও বহু আগে কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজ করা ছেড়েছেন, বলা চলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই একরকম ছেড়েছেন। যদিও তনুজা সুপারহিট প্রথম সারির নায়িকা ছিলেন না। তাই মায়ের সাথে তুলনার ফল কাজলকে হতে হয়নি। কাজলের পাশাপাশি রানীও আসন গেড়েছেন বলিউডে তারা আপন বোন না হয়ে মাসতুতো বোন হওয়াতে। আপন বোন হলে চিত্রটা শিল্পা আর শমিতা শেঠীর মতো হয়ে যেতো, যেমনটা হয়েছে টুইঙ্কেল আর রিঙ্কী খান্নার বেলায়ও।
এশা দেওলের অবস্থাও কাজলের মতোই, তবে সুন্দরী মায়ের মেয়ে হিসেবে এশা পিছিয়ে পড়েছেন, এবং অভিনেত্রী হিসেবে এখনও তার মায়ের যে গ্রহণযোগ্যতা আছে, সেটা এশাকে কিছুটা হলেও (পুরোটা নয়) বাটে ফেলেছে বৈকি! যুগপৎ ইন্ডাস্ট্রিতে থাকা দুই দেউল ভাইয়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে সানি দেউল হিট। সানি জনপ্রিয়তায় বাবা ধর্মেন্দ্রকেও ছাড়িয়েছেন, আর ববির হিট ছবির সংখ্যা হাতে গোনা। মূল কথা বলিউডের দর্শক এক পরিবারের দুইজনকে একই সাথে গ্রহণ করেনি। কারণ স্টার কিড হলে বাবার সাথে ছেলের আর মায়ের সাথে মেয়ের তুলনাটা চলেই আসে এবং সেটা তারা করেছে।
সনম কাপুর কিছুটা জায়গা করে নিতে পেরেছে সেটা বাবার কারণেই বাবার মেয়ে হিসেবে; কারণ মেয়ে বলে তাকে বাবার সাথে তুলনা করা হয় না, যেটা হর্ষবর্ধনকে অবধারিতভাবেই করা হয়। আবার মা না হয়ে চাচী হবার কারণে সনমের তুলনাটা শ্রীদেবীর সাথেও হয়নি। সনম রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু বাটে পড়তে যাচ্ছিলেন জাহ্ণবী কাপুর। ঠিক যে অবস্থাটা অমিতাভ- অভিষেকের, সেটারই পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছিলো শ্রীদেবী–জাহ্ণবীর বেলায়।
আটচল্লিশে কাম ব্যাক করেও শ্রীদেবী হিট ছবি উপহার দিয়েছিলেন। ইংলিশ ভিংলিশ দিয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন এবং ঠিক তারই ধারাবাহিকতায় বনি কাপুর প্রডিউস করলেন মম। মম বাম্পার হিট না হলেও পুঁজি তুলে আনা ছবি, যেখানে শ্রীদেবীর অভিনয় বরাবরের মতই অসাধারণ এবং তাঁর সামনে বাকিরা তুলামূলক ম্লান ছিলেন। অর্থাৎ শ্রীদেবী সেই নায়িকা ছিলেন, যাকে মাথায় রেখে পরিচালকরা ৫৪তেও চরিত্র সৃষ্টি করতেন।
দক্ষিণেও মাতাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর অভিনীত পুলি মুভিটি পুঁজি তুলে এনেছে, এবং তার চেয়েও বড় কথা এই বয়সেও পর্দায় তিনি শ্রুতিকে টেক্কা দিয়েছেন অভিনয় ও সাজ পোশাকে। মোট কথা, যেখানে শ্রীদেবী ছিলেন, সেখানে প্রযোজক- পরিচালকদের আলাদাভাবে ভাবতেই হতো সবকিছু নিয়ে। কারণ শ্রীদেবী মানেই সিনেমা হিট আর হিট না হলেও পুঁজি উঠে আসবেই। তো, এমন একজন নায়িকার/অভিনেত্রীর মেয়ে হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখাটা তাঁর মেয়ে জাহ্ণবীর জন্য ছিলো বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ এই বয়সেও শ্রীদেবী ফ্যাশন, সাজসজ্জায় নিজের মেয়েকে ছাপিয়ে যেতেন। শুধুমাত্র শ্রীদেবীর মেয়ে বলেই জাহ্ণবী ছবি মুক্তির আগেই এতো আলোচিত।
এটা যতোটা না জাহ্ণবীর নিজের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি মা শ্রীদেবীর কারণে। স্টার কিড হিসেবে ছবি মুক্তির আগেই জাহ্ণবী যতোটা আলোচিত, আর কোনো স্টার কিডই তা হয়নি। মজার বিষয় হলো, এতো কিছুর পরও ৫৪তেও শ্রীদেবী যেভাবে সবার সার্চে (ইউটিউব ও অন্যান্য) ছিলেন, আলোচনায় ছিলেন, ততোটা তাঁর মেয়ে জাহ্ণবী ছিলো না। শ্রীদেবী বেঁচে থাকলে প্রতি মুহূর্তে জাহ্ণবীর তুলনা তাঁর সাথে হতো এবং দেখতে মায়ের মতো হলেও মাকে সে কতোটা ছাড়িয়ে যেতে পারতো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ওই যে মহীরুহের নিচে ছোট গাছগুলো ছায়াই পায়, কিন্তু বাড়তে পারে না। জাহ্ণবীর অবস্থাটা মহীরুহ মায়ের ছায়ায় তাই হতো, আর এটা কাপুর পরিবারও জানতো।
শ্রীদেবীর না থাকা সবচেয়ে বেশি লাভজনক হবে এই কাপুরদের জন্যই। শ্রীদেবীর অবস্থানটা ছিলো রাজার হাতি মরলেও লাখ টাকার মতো। বয়স হয়ে গেলেও অভিনয় আর সৌন্দর্য দিয়ে ছবি উতরে দেবার মতো ক্ষমতা যে তিনি রাখতেন, এটা সবাই জানতেন। আর সেখানে জাহ্ণবীকে ‘ক্যাশ করা’ কঠিন হয়ে যেতো।
কারণ আগেই বলেছি, এক পরিবার থেকে যুগপৎ দুজন সুপারহিটের ইতিহাস বলিউডে নেই। আর সেখানে চ্যালেঞ্জে নিঃসন্দেহে হারতো জাহ্ণবী কাপুর। সনম কাপুর বিয়ে করে ফেলেছেন, আর তাই এইটুকু বলাই যায়, মাঝারি হিট সনম কাপুর অন্তত জাহ্ণবীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসার আর যোগ্যতা রাখে না। আর মূল প্লেয়ার শ্রীদেবী তো মাঠেই (পৃথিবীতে) নেই। জাহ্ণবীর মাঠ ফাঁকা।
যোগ্যতায় না হোক, সহানুভূতির কারণে হলেও দর্শক তার ছবি দেখতে থিয়েটারে যাবে। অর্থাৎ অনিল আর শ্রীদেবীকে বাদে বহুদিন পরে কাপুর পরিবারে কাউকে ‘ক্যাশ’ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বা সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যভাবে ভাবলে কাপুর বংশধরদের মধ্য থেকে অনিলের পরে জাহ্ণবীই আছে, যার বলিউডে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে কাপুর পরিবার, যেটা শ্রীদেবীর উপস্থিতিতে কঠিন ছিলো বৈকি!
ব্যবসায়ীরা দিনশেষে লাভ লোকসানের হিসাব করে, সম্পর্কের বা মানবিকতার নয়। আর সেই ব্যবসার শেয়ার বাজারে কাপুর পরিবারের বউ শ্রীদেবী ছিলেন সবচেয়ে দামী শেয়ার, যার মূল্য পতনে সুনাম, খ্যাতি আর লাভের বাজারে জাহ্ণবী নামের পরবর্তী শেয়ারের বাজার দখলের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আজ মনে হয় শ্রীদেবীকে বিয়ে করাটাও বনি কাপুরের শেয়ার বাজারে পুঁজি খাটানোর মতোই ছিলো!
সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)