শরিফা তাসমীম (টুলটুলী):
ট্রেন থেকে নামবো, হুট করে সামান্য কাশিতে মুখের মধ্যে থু থু, কিন্তু ফেলি কই? এখানে তো কাউকে প্রকাশ্যে যেখানে সেখানে থু থু ফেলতে দেখি না। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, একবার ভাবলাম গাছের গোঁড়ায় টুপ করে থুথুটা ফেলে দিই, আবার মনে হলো কেউ যদি দেখে ফেলে! ১০ মিনিট হেঁটে বাসায় আসার পর বেসিনে থুথুটা ফেললাম। দেশে থাকলে নির্ঘাত একাজ করতাম না। লোকে হয় দেখে শিখে, না হয়তো ঠেকে শিখে। আমাদের দেশে এসব দেখে শেখার যেহেতু অপশন কম, তাই ভালোভাবে বাঁচার জন্য ঠেকে শিখাটা জরুরি। কেন? বলছি।
মিরপুর ১০ নম্বরে যে বাসাটায় সংসার শুরু করেছিলাম, ওখানে ছিলাম এখানে আসার আগের দিন পর্যন্ত। সাড়ে চারতলা বাসাটা ছিল তিন রাস্তার মোড়ে। মোড়ের ঠিক মাথায় ছিল একটা বাঁশঝাড়। ছয় বছর ছিলাম বাসাটাতে। সকাল-বিকাল পাখির কিচিরমিচির ডাক ছিল আমাদের নিত্যদিনের ভালোলাগার অনুষঙ্গ। ওই সময়ে আমাদের বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন যারাই বেড়াতে আসতেন, অবশ্যই একবার বাহ্ বলতেন। সামনে পিছনে কোন বহুতল ভবনও ছিল না …আলো হাওয়ায় লুটোপুটি খাওয়া বাসা ছিল।
হুট করে বাসার সামনে একটা বহুতল ভবন আর দুইটা পোশাক কারখানা নির্মাণ করা হলো, মুহূর্তে মানুষ এক লাফে চারগুণ হয়ে গেল সকাল-সন্ধ্যার চলার পথে। ২০০৮ সালে যে রাস্তায় এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেও পানি জমতো না, ২০১০ সালে সেখানে আধাঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে হাঁটু পানি !
কারখানা ছুটি হওয়ার পরে মাথায় মাথায় ঠোকা খাওয়ার মতো মানুষের ভিড় শুরু হলো। জায়গায় জায়গায় মুদি দোকান। চিপস, সিগারেটের প্যাকেট খাওয়া শেষ তো ছুঁড়ে ফেলি রাস্তায়, কীসের ডাস্টবিন! ডাস্টবিনের চাইতে ১০ হাত দূরে ফেলে রাখি আমরা ময়লা। সামান্য বাতাস আর একটু বৃষ্টিতে খুব সহজে আটকে ফেলতে পারে এসব প্যাকেট পয়:নিষ্কাশন অথবা ড্রেনের মুখ ।
ঢাকার প্রায় সবগুলো মহল্লার ভেতরে দুপাশের বহুতল ভবনের নিচ দিয়ে হেঁটে যাবেন, দেখবেন প্রায় স্থানেই রাতে ব্যবহার করা মোজা রাস্তায় পড়ে আছে, মানে প্লাস্টিকের আর কী! স্বল্প আয়ের মানুষেরা বস্তিতে ছোট ঘরে থাকে, হয়তো জীবনের ঘানি টানতে গিয়ে এসব ছোট ছোট সচেতনতা তাদের মাথায় আসে না, কিন্তু ভালো ফ্ল্যাটে থাকা শিক্ষিত, সচেতন মানুষগুলো এতো নির্বোধ হয়!
ছোট ছোট অসচেতনতায় বড় বড় অঘটন ঘটে। ময়লাগুলো রিসাইকেল করতে হলে প্রথমে সবগুলো ময়লাকে আগে তো ডাস্টবিন পর্যন্ত আসতে দিতে হবে। ময়লা তো ডাস্টবিন পর্যন্ত আসার আগেই ড্রেনে ঢুকে যায়।
পানি নিষ্কাশনের পথটা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় বন্ধ হওয়ার জন্য ছোট-বড় মাঝারিভাবে অনেকেই অথবা সবাই দায়ী, অথচ আমরা শহরের মেয়রদেরকে গালি দিয়ে মেয়রের ফোরটিন জেনারেশন উদ্ধার করছি। শহরের মেয়রেরা যদি বড় জায়গায় থেকে বৃহৎ পদক্ষেপ না নিতে পারেন, সেটা তার অপারগতা। আর আমরা যদি সাধারণ জায়গায় থেকে ছোট পদক্ষেপে সফল হতে পারি, তবে সেটা আমাদের সফলতা।
মেয়র আমাদের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, দায়বদ্ধ, কিন্তু আমরা আমাদের কাছে, আমাদের সন্তানদের ভালো রাখার কাছে দায়বদ্ধ। দরকারটা আমাদের বেশি। দেশ বসবাসের উপযুক্ত না হলে সব মেয়রই প্রথমে ছেলেমেয়ে উন্নত দেশে পাঠান, পরে ফোরটিন জেনারেশনের সবাই উন্নত দেশে পাড়ি জমানোর ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু আমরা সাধারণেরা তা পারি না, তাই আমাদের ভাবনাটা আমাদেরই আগে ভাবা জরুরি।
এখানে ভিক্টোরিয়া পার্ক প্রাইমারি স্কুলের প্রিন্সিপাল দেখতে হেবি,বয়স্ক, তবে খুব স্মার্ট মহিলা। কিন্তু সকালে স্কুলের সামনে গার্জিয়ানদের গাড়িগুলো যাতে অনেকক্ষণ পার্কিংয়ে না থাকে, অথবা এলোপাথাড়িভাবে না থাকে, তার জন্য তিনি নিজেই প্রায় প্রতিটা দিন সকালে স্কুলের সামনে ট্রাফিকের ভূমিকায় থাকেন। স্কুলের কোথাও ময়লা পড়ে থাকা দেখলে নিজেই ডাস্টবিনে ফেলেন। আর আমাদের দেশে হেডমাস্টারের চকচকা বার্নিশ করা চেয়ার শতবার পিয়নদেরকে পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে হয়।
আমরা সহজ কাজটা সহজে করতে পারি না। যেচে সেধে কথা বলা মানুষকে আমরা কম দামি মনে করি, আর ভাব ধরে থাকা মানুষেরা আমাদের কাছে পূজনীয়।
সে যাই হোক ধান ভানতে আর শিবের গীত না গাই। আটপৌরে, সাধারণ, পুতুপুতু করা ভিতু মানুষ আমি। জ্ঞানের পরিধি এখনো বিন্দুতে বৃত্ত, সে তো অনেক বড় ব্যাপার। এই এক বিন্দু জ্ঞান দিয়েই মনে হয়, হয়তো ইচ্ছা করলে আর সচেতনতা বাড়ালে অনেক সফলতাই সম্ভব, নচেৎ আলাদীনের চেরাগের দৈত্য এসেও আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
ভালো থাকুক আমাদের ভালো থাকার ভালো কাজের ইচ্ছা শক্তিগুলো। দূর হোক দুর্ভোগ ,অপরিচ্ছন্নতা, রোগ, দুর্যোগ আর জলাবদ্ধতা।