গর্ভপাত নিয়ে ইউরোপে নারী সংগ্রাম

লিপি মাহজাবিন আহমেদ:

ইউরোপের আাড়াই হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অনেক বছর সময় নিয়ে আজকে তারা সভ্যতার এই স্তরে পৌঁছেছে। ইউরোপে শত বছর আগেও ধর্মযুদ্ধ, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ, উপনিবেশবাদী লুন্ঠন ছিল নিয়মিত ব্যাপার। ইউরোপীয় মূল্যবোধ বা সম অধিকার যাই বলা যাক না কেন, এই অবস্থায় পৌঁছাতে ইউরোপীয়দের অনেক সময় লেগেছে। তবু কি তারা পুরোপুরি মানবিক, মুক্তমনা, সম অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলোর ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে! না, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তারা তা পারেনি।

ইউরোপের দেশে দেশে এখন রক্ষণশীল বর্ণবাদী দলগুলির সমর্থক বেড়ে যাচ্ছে এবং তারা বিপুলসংখ্যক ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসছে। তারা নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ধর্মকে রক্ষা করবার দোহাই দিয়ে শরণার্থী ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। নিজ দেশে তারা ধর্মকে সামনে এনে সেটাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে।

এমনই এক সময় গত ২৫ মে আয়ারল্যান্ডে নারীদের গর্ভপাত আইন শিথিল করা নিয়ে একটি গণভোট হয়ে গেল। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৩ সাল থেকে আয়ারল্যান্ডের শাসনতন্ত্রে গর্ভপাত আইনের বিষয়গুলিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। এমনকি আয়ারল্যান্ডের চিকিৎসক সংগঠন এক ঘোষণায় জানিয়েছিল যে কোনো চিকিৎসক কোনো নারীর গর্ভপাত ঘটালে বা সহযোগিতা করলে তার পেশাগত লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

২০১৩ সালে আয়ারল্যান্ডে একজন ভারতীয় দন্ত্য চিকিৎসক সবিতা হালাপ্পানভার গর্ভবতী অবস্থায়, গর্ভের ভ্রূণটি নষ্ট হয়ে গেলেও আইনের কড়াকড়ি ও জটিলতার কারণে নষ্ট ভ্রূণটি গর্ভপাত করাতে অসমর্থ হোন। পরে এই ভারতীয় দন্ত্য চিকিৎসক গ্যালওয়ে শহরের একটি ক্লিনিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেন। আইনের কারণে এই অসহায় মৃত্যু নিয়ে আয়ারল্যান্ডে তখন প্রচুর সমালোচনা হয়। এই নারী বিরোধী আইন বাতিল বা শিথিল করবার দাবিতে আয়ারল্যান্ডে নারীবাদী ও প্রগতিশীল মানুষেরা প্রতিবাদমুখী হয়ে উঠেন। দীর্ঘ আন্দোলনের পর আইরিশ সরকার কোনো নারীর গর্ভবতী অবস্থায় জীবন শঙ্কা দেখা দিলে গর্ভপাতের অনুমতির আইন করেন। তবে ধর্ষণ ও অন্য কোনো কারণে গর্ভবতী হলে সেই গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

গত ২৫ মে আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত বিষয়ক আইন সংক্রান্ত ভোটে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটার আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বা গর্ভপাত নিয়ে কড়াকড়ি আইন বাতিলের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন, আর ৩০ শতাংশ দিয়েছেন ‘না’ ভোট।

প্রত্যাশা করা হচ্ছে এই গণভোটের ফলে আইরিশ আইন প্রণেতারা নতুন আইন প্রণয়ন করবেন। গর্ভধারণের প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যে এবং মায়ের জীবনের ঝুঁকি থাকলে বা ভ্রূণ রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হবে।

শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, কিছুদিন আগে সুইডেনেও একটি আইন পাস করা হয়েছে, যাতে বলা হচ্ছে পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া যৌনসঙ্গমকে ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে। সুইডেনের এই আইন নিয়ে নানা রকম আলোচনা হচ্ছে এবং জার্মানিতেও এই গর্ভপাতবিষয়ক আইনটি দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১১ সালে সংশোধিত হয়েছিল।

বিগত দুইশত বছর থেকে ইউরোপীয়রা সভ্যতা, সম অধিকার প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অনেক কথা বললেও তাদের তথাকথিত সভ্যতাতে অনেক অসভ্যতা ও গলদ রয়ে গেছে।

শেয়ার করুন: