হোসেন সোহেল:
নারীদের পিরিয়ড বা মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত ন্যাপকিন ব্যবহারের আদ্যপান্ত নিয়ে একটি TVC বা বিজ্ঞাপন নির্মিত হবে।
সেতো ভালো কথা, হক কথা! অথচ সেই বিজ্ঞাপন হলো না।
কারণ এই বিজ্ঞাপন করতে উচ্চমার্গীয় সুপারস্টার দরকার, কিন্তু ক্লায়েন্টের (ইনভেস্টর) চাহিদা মোতাবেক এমন সুপার মডেল পাওয়া গেলো না। স্টার মডেলরা এসব নোংরা ন্যাপকিনের মতো বিজ্ঞাপন করতে রাজী নন। তারা তা জানিয়ে দিয়েছেন।
আমার এক নির্মাতা বন্ধু আক্ষেপ করে তার ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন। নারীদের সাড়া না পাবার কারণে একটি বিজ্ঞাপন আটকে গেলো। বিজ্ঞাপনটি নারীদের মাসিকে ব্যবহৃত ন্যাপকিন সম্পর্কিত। তার উত্তরে আমি বলেছিলাম, নতুনদের উপুর্যপরি সুযোগ দিতে, আর পুরাতনদের উপুর্যপরি রুহ আফজার শরবত খাওয়াতে।
নারীরা নারীদের পিছু টানে, অন্যদিকে রক্ত মোছার কাপড় নাই!
এখানে একটা ছোট্ট গল্প মনে পড়ে গেল। আপনারাও মিলিয়ে দেখতে পারেন।
বরাবরের মতো পাহাড়ে আমার যাতায়াত অনেক আগে থেকে। আমি পাহাড়ে যাই প্রকৃতির পাশাপাশি প্রতিবেশও দেখার জন্য। এমন আগ্রহ অনেক আগের।
এরকমই একবার যাচ্ছি বান্দরবান হয়ে থানচি এরপর তিন্দু, ছোট মোদক, বড় মদক এরপর বেশ দূর পেরিয়ে যুগিরাংপাড়া। নয় মাসের একটি ফেলোশিপ নিয়ে পায়ে হেঁটে দিন পাঁচেক সময় লেগেছিলো সেই পাড়ায় পৌঁছাতে।
পাঁচদিন পর সেই পাড়াতে পৌঁছাতে পারি। সন্ধ্যা নামে পাহাড়ের গায়ে। উচুঁ পাহাড়ের ঝিঁ ঝিঁ শব্দ কানে বাজে। মাঝে তাদের আতিথেয়তার দুচুয়ানি। এরপর ঘুম। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া, আবার সেই ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখি তখনও ভোর। পাহাড়ের পবিত্র ভোর আর সূর্য উঠবে বলে সব মিলিয়ে ঝিঁঝিঁর তালে তাল মেলাতে টং ঘরের বাইরে গিয়ে ঘুরি-ফিরি নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে।
দিনশেষে পাহাড় আর সাগরের কাছে যেন আমার সব আবদার। যাই হোক সে তো নিজের কথা। এরপর আধো অন্ধকারে ঝিরি ঝর্ণা পেরিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে আবারও সেই পাড়াতেই প্রবেশ। যুগিরাং পাড়ার ৩৮ পরিবারের টং ঘরের আশে-পাশে আমার পদচারণা। পাড়াবাসীর দু’একজন ছাড়া কারও ঘুম ভাঙ্গেনি।
এভাবে ভোরের আলো পাহাড়ের গা ধরে দুলে দুলে পরিচ্ছন্ন হতে থাকে। দুর্গমে বসবাসরত পাহাড়ি মানুষের পাড়াতে অলি গলি দিয়ে যখন ঘুরছি, তখন চোখে পড়ে সাত হাত উচ্চতায় একটি টং ঘর। সাত হাত নিচে শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত করা আলগা মাটিতে সে টং এর নিচে ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ। অনেক ফোঁটার রক্তে আমি ভাবি, গত রাতে মুরগি বা কোন রক্তবাহিত প্রাণীর আমিষের জোগান দেয়া হয়েছিল কি?
এরপরও মনে বার বার প্রশ্ন, দুর্গম পাহাড়ের মানুষ মাগরিবের আগেই রাতের খাওয়া শেষ করে। সারারাত কোনো খাবার নেই, তাহলে কালচে পড়া এই রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় কেন ঝরে?
আবারও ফিরে যাই সে টং ঘরের কাছে। সেখানে যেতেই দেখি, নিস্তব্ধ পাহাড়ে রক্তের ফোঁটা মাটি ভেদ করে টুপ করে পড়ে, কিন্তুু কানে আসে না। অথচ বোঝা যায়, এই শব্দ যেন কারও কানে না যায়, এমনই ব্যবস্থা।
আমার সহযাত্রী এক বন্ধু, সে ত্রিপুরা সম্প্রদায়। পাহাড়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে সে ভোরে উঠে, হোক যতোই দুচুয়ানি। টং ঘরের রক্তপাতের যোগ-বিয়োগের হিসেব মেলাতে না পেরে এবার সেই বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম।
বন্ধুকে সব খুলে বললাম। সে জানায়, গত রাতে ৩৮ পরিবার কী খেয়েছে, তা তার জানা। তাহলে তো এমন রক্তের ফোঁটা টং ঘরের বাঁশের পাটাতন বেয়ে ঝরে পড়ার কথা নয়!
এবার ত্রিপুরা বন্ধুটি সন্ধানে যায় রক্ত ঝরা টং ঘরের অভ্যন্তরে।
ফিরে এসে ত্রিপুরা দাদা বলেন, ঘরের কোণে একটি তরুণী বসে আছে। তেমন কোনো বিষয় না, মেয়েটির মাসিক হয়েছে। জামা কাপড় নেই বলে ঘরের এক কোণে বসে আছে। যতোদিন তার মাসিকের রক্ত বন্ধ না হবে, সে পর্যন্ত দিনরাত ঘরের কোণে এভাবেই থাকবে।
আমি তাকে বলি, এ কেমন কথা! তার ন্যাপকিন না থাক, কাপড় তো আছে। দাদা উত্তরে জানায়, তার তো পরার কাপড়ই আছে দুইটা। পুরাতন ন্যাকড়া নতুন কাপড় থেকেই তো হয় দাদা!
গল্পটা আপাতত এখানেই শেষ হয়! সেই থেকে মাথার ভেতর গেথে আছে সেই গল্পটা, নারী জীবনের গল্প। এমন অসংখ্য গল্প আমার দেখা।
কাজেই বলতে চাই স্টার সেই মডেল দিদিদের, যারা শরমে নিজের মাসিক বা পিরিয়ডে নিজেদের ন্যাপকিন বা প্যাডের বিজ্ঞাপন করেন না, তাহলে কবে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের পুরাতন কাপড় ছাড়িয়ে নতুন তো দূরের কথা, ন্যাপকিন পরাবেন? কিভাবে মা বোনদের উন্নয়ন করবেন?