কবরেও পুরুষতান্ত্রিকতা!

ইসাবেল রোজ:

এবার দেশে গিয়ে মাকে যখন কবরে শুইয়ে রেখে আসলাম, একটা অদ্ভুত ব্যপার চোখে পড়লো। একটা বিষয় নিয়ে খটকা লাগলো মনে। যখন মাকে কবরে শোয়ানো হয়েছিল, তখন আমি যেতে পারিনি। আমার শরীর বিদ্রোহ করেছিল। আমি পৌঁছানোর আগেই মা চলে গিয়েছিলেন। মা যেহেতু ক্যান্সারের রোগী ছিলেন, একটা মানসিক প্রস্তুতি আমি নিয়ে ছিলাম মনে মনে। কিন্তু এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল যে মাকে বিদায় দেয়ার সময়টুকু পেলাম না। আমি লন্ডন থেকে জার্নি করে শুধু মায়ের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছি। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

যেটা বলছিলাম, মাকে কবরে শুইয়ে রাখতে আমি যেতে পারিনি। পরের দিন সকালেই ছুটে চলে গিয়েছি মায়ের কবরে।
বাংলাদেশে এই প্রথম আমি কোন কবরস্থানে ঘুরে ফিরে দেখেছি। এর আগে দেশের কোন কবরস্থানে যাওয়া হয়নি আমার। যতদূর জানি মেয়েদের কবরস্থানে যাওয়াটা খুব ভালো চোখে দেখা হয় না।

আমি ধর্ম বুঝি কম। ধর্মীয় দৃষ্টি থেকে মেয়েদের কবরস্থানে যাওয়া নিষেধ বলে শুনেছি। জানি না এটা সত্য নাকি শুধুই এক ফতোয়া। যাই হোক। মায়ের কবরের আশে পাশে কবরগুলো দেখছিলাম এবং নাম পড়ছিলাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যতগুলো পুরুষের কবর ছিল, সেখানে প্রত্যেকটি কবরে মৃত ব্যক্তির নাম ,জন্ম ও মৃত্যুর তারিখের সাথে তাদের পিতা মাতার নাম ও উল্লেখ করা ছিল।

কিন্তু প্রতিটি নারীর কবরে নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখের পরই শুধু স্বামীর নাম লেখা ছিল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো যে দু চারটা কবর মায়ের আশে পাশে ছিল, শুধু তাদেরই কবরে স্বামীর নাম লেখা হয়েছে। কিন্তু কিছুদুর যেতেই আমার ভুল ভাঙলো। যতগুলো নারীর কবর দেখলাম, সবারই একই অবস্থা। সেখানে সব পুরুষের পিতামাতার নাম ছিল। কিন্তু কোন নারীর পিতামাতার নামের পরিবর্তে শুধুই স্বামীর নাম লেখা ছিল।

ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েছে এই কারণে যে এই দেশে (লন্ডন) আমি অনেক কবরস্থান ভিজিট করেছি। আমার জীবনের একটা সময় আমি কবরস্থানে একলা বসে থাকতে পছন্দ করতাম। কেমন যেন শান্তি লাগতো আমার। মনে হতো মানব দেহের শেষ ঠিকানা এই মাটি। এখানে যারা শুয়ে ছিল তারাও এক সময় আমাদের মতোই হেঁটে চলে বেড়াতো। এসব ভাবতে ভাবতে আমি এপিটাফগুলো পড়তাম। সেখানে অনেক রকম লেখা থাকতো। কখনো “মাই বিলাভ্ড ওয়াইফ”। কখনো ছেলেমেয়েদের পক্ষে থেকে লেখা থাকত “আওয়ার মাম, নাম, জন্ম, মৃত্যু তারিখ”। অনেক সময় পড়েছি “মাই বিলাভ্ড হাজবেন্ড ”লেখা। কখনো মা বাবার নাম লেখা। কখনো শুধুই মায়ের নাম উল্লেখ করা।

এদেশে (ব্রিটেন) ফিউনেরাল কোম্পানিগুলো ক্লায়েন্টের কাছে জিজ্ঞাসা করেই নানা রকমভাবে লেখা তৈরি করে। ওদের এলবাম তৈরি করা থাকে। ক্লায়েন্ট সেখান থেকে বেছে নির্দেশ দিলেই ওরা সেভাবে ভেলিভারি দেয়। আমাদের দেশে যদিও এই ধরনের ফিউনেরাল কোম্পানির চল নেই, তাই কবর দেয়ার পর পরিবার থেকে যে তথ্য দেয়া হয়, সেটাই সাইনবোর্ড এ লিখে কবরের মাথায় সেট করে দেয়া হয়।

আমার প্রশ্ন হলো, প্রতিটি পুরুষের কবরে তাদের জন্মদাতা পিতা মাতার নাম থাকতে পারলে নারীর কবরে কেন শুধু স্বামীর নাম থাকতে হবে? নারীদের স্বামীদের নাম থাকুক সেটাও মেনে নিলাম। কিন্তু তারা কি আকাশ থেকে পড়ে স্বামীর ঘর করে মৃত্যু বরণ করেছিলেন? নাকি তাদের কেউ এই পৃথিবীতে জন্ম দিয়েছিলেন? তাহলে সেই জন্মদাতা মা-বাবার নাম কবরে কেন উল্লেখ করা হবে না?

আমি জানি যারা চলে গেছেন চিরতরে, তাদের কিছুই যায় আসে না। তাদের কবরে কী লিখা থাকলো আর থাকলো না। কিন্তু পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা বেঁচে আছে, তারা কী ভেবে এই কাজটি করে? মেয়েদের বিয়ের পর নাম পরিবর্তন করার রেওয়াজ আছে। মেয়েরা জীবিত অবস্থায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে তার স্বামীর টাইটেল ব্যবহার করবে কি না! মৃত্যুর পর সেই নারীর অবশ্যই করার কিছু থাকে না। সেখানে তার নামের পরই শুধু স্বামীর নাম লিখে রাখাটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একচোখা সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয়। কোনো পুরুষের কবরে কিন্তু তার স্ত্রীর নাম উল্লেখ থাকে না। তাহলে নারীর কবরে শুধু স্বামীর নাম কেন উল্লেখ থাকবে?

এভাবেই আমরা ছোটখাট ঘটনাগুলো উপেক্ষা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আরও উৎসাহ প্রদান করি।

(বি দ্র: আমি আমার মায়ের কবরে তার পিতামাতার নামসহ তার পিতার বাসস্থান অর্থাৎ মায়ের জন্মস্থান উল্লেখ করতে বলেছি। আমার মা কোথায় জন্ম নিয়েছেন, তার পিতামাতা কে ছিল সেগুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার কবরে। আমার বাবার সময়েও একই কাজ করা হবে। তার জন্মস্থানসহ তার পিতামাতার নাম উল্লেখ করা হবে বলে নির্দেশ দেয়া আছে)

পরিশেষে মায়ের কবরে কী কী ফুলের গাছ লাগানো হবে, মা কোন ফুলগুলো পছন্দ করতেন বেশি, এসব বাবার নির্দেশেই করা হয়। প্রতিটা মায়ের, প্রতিটা নারীর শেষ ঠিকানায় তাদের প্রকৃত পরিচয় উল্লেখ করা হোক। তাদের জীবনে স্বামী ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কেউ থাকতে পারে। সবার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা রেখেই একতরফা স্বামীর নাম ব্যবহার বন্ধ করা হোক।

শেয়ার করুন: