“আমার চেয়েও বড় দুঃখ আছে আরো অনেকের”

মোহছেনা ঝর্ণা:

(১) হঠাৎ করে আমার মেয়েটা দৌড়ে এসে আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, মা, আমার ভয় লাগছে। কথা শেষ না করেই মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? কেন ভয় লাগছে? মেয়ে মেয়ে নিচু স্বরে বললো, ঐটা হয়েছে মনে হয়।

ঘটনা বুঝে আমি হেসে বললাম, ও এই কথা, ভয় লাগছে কেন?
মেয়ে বললো, আজ থেকে যে বড় হয়ে যাচ্ছি। আমি বলি, ধুর, বোকা মেয়ে, এজন্য বুঝি কাঁদতে হয়? মা আছি না।
মেয়ে আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। আমিও আমার ভালোবাসার সব শক্তি দিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে রাখি বুকের মাঝে।

মনে পড়ে যায় নিজের হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া, নারী হয়ে যাওয়ার দিনটার কথা। ভরা বর্ষার এক দিন ছিল। বিকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে গিয়ে দেখি পরনের সাদা পায়জামা কেমন লাল হয়ে আছে। দৌড়ে বাথরুমে যাই। ভয় পেয়ে যাই কোনো অসুখ হলো না তো! মায়ের সাথে কেন জানি সব কথা বলতে পারতাম না। সংকোচ হতো। মাও কোনোদিন নিজ থেকে কিছু জানতে চাননি। এ সময় তো ভরা বিপদ। কিছুক্ষণ পর পর পায়জামায় রক্ত লেগে যাচ্ছে।আমি যে কী করবো, কিছু ভেবে পাই না।

একটা সময় দিশাহারা হয়ে বাথরুমে বসে কাঁদতে থাকি। আমার নিশ্চয় কোনো অসুখ হয়েছে। তা না হলে এমন হবে কেন? সারাটা দিন, সারাটা রাত এভাবে অস্থিরতাতেই কেটে গেল। ভেবেছিলাম ঘুম থেকে উঠলে দেখবো সব ঠিক হয়ে গেছে। পরদিন সকালবেলা পাশের ঘরের ভাবির কাছে কী একটা কাজে পাঠিয়েছিল মা। ভাবির বিছানায় বসেছিলাম। আসার সময় দেখি যে জায়গাটাতে আমি বসেছিলাম সে জায়গাটাতে রক্তের দাগ লেগে গেছে। লজ্জায় আর ভয়ে কুঁকড়ে যাই আমি। ভাবি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। উনি যখন খেয়াল করলেন, তখন আমি লজ্জায় মাথা তুলে ভাবির দিকে তাকাতে পারছিলাম না, ভাবি বোধহয় আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।
ভাবিই প্রথম ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন, ভয় পেয়েছো? ভয়ের কিছু নেই। সব মেয়েরই এমন হয়।

এবার আমি মাথা তুলে বিস্ময় নিয়ে ভাবির দিকে তাকাই। সব মেয়ের হয়,কেন হয়? ভাবি বলেছিলেন, এটাই নাকি প্রকৃতির নিয়ম। এটা হলেই মানুষ মেয়ে হয়। তার আগে সবাই শিশু থাকে, কিশোরী থাকে। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে আমি স্কুলে যাবো কীভাবে? ভাবি হেসে বলেছিলেন, সবাই যেভাবে যায়। এরপর বললেন, মেয়েদেরকে কিন্তু প্রতি মাসেই রক্ত দেখতে হয়।

ভাবির ভরসাতেই বলা যায় প্রথম যাত্রায় একটা রক্ষে হলো। ভাবিই সব শিখিয়ে দিলেন। শুধু মা বলেছিলেন, স্কুলে গিয়ে এসব কথা কারো সাথে বলবে না। আমি ধরেই নিয়েছি এসব নিশ্চয় অনেক খারাপ বিষয়, তা না হলে মা মানা করলেন কেন! অবশ্য মা মানা না করলেও এ বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আমার কথা বলার বাসনা জাগতো বলে মনে হয় না।
এরপর থেকে মাসের একটা নির্দিষ্ট সময় আসলেই আমি কুঁকড়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে পেটে এতো তীব্র ব্যথা হতো যে শুধু কাঁদতাম। কান্না করছি কেন মা জানতে চাইলে বলতাম, স্কুলের পড়া শিখতে পারিনি, নাহলে মাথা ব্যথা করছে এরকম এলোমেলো সব কথা। কেন জানি পেট ব্যথা করছে এই কথাটা বলতে খুব লজ্জা লাগতো।

আমার খুব মন খারাপ থাকতো। বলা যায়, সে দিনগুলো থেকেই বিষন্নতা নামক একটা বিষয় আমি আবিষ্কার করতে পারি আমার মধ্যে। আমার মনে হতো আমিই বোধহয় এ পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। যদি সব মেয়েরই এমন হয়, তাহলে তাদের কেন আমার মতো সমস্যা হয় না! আমি কেন আমার কথাগুলো কাউকে বলতে পারি না?

ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং করার সময় হঠাৎ চোখে পড়লো আমাদের এক সহপাঠীর জামাটার পেছন দিকে রক্তের দাগ লেগে আছে। অনেকক্ষণ সে খেয়াল করেনি। পরে কেউ একজন তাকে বলার পর সে খুব তড়িঘড়ি করে ম্যাডামকে বলে ছুটি নিয়ে চলে যায়। পরদিন স্কুলে আসার পর আবার তার একই অবস্থা। এদিনও কেউ তাকে বলার পর সে খেয়াল করে, এবং লজ্জায় লাল হয়ে থাকে। আমার সেই সহপাঠীকে দেখে এই প্রথম আমার মনে হলো পৃথিবীতে আমি একাই অসহায় নই, আমার মতো কিংবা আমার চেয়েও বেশি আরো অনেকেই আছে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো,
“এখন জেনেছি আমি একা নই, বহু মানুষের
আমার চেয়েও বড় দু:খ আছে, হতাশ্বাস আছে
এখন জেনেছি আমি একা নই, মেঘ-ফানুসের
রাজ্যে আমি একা নই”

সময় যেমন কারো জন্য বসে থাকে না, ঠিক তেমনি অসময়গুলোও কারো জন্য বসে থাকে না। নিজের যেদিন মেয়ে হলো, তখন থেকে একটা ভাবনা ছিল আমার মেয়েটা যেন কোনো একটা মুহূর্তের জন্য নিজেকে একা না ভাবে, অসহায় না ভাবে। আমাদের দু’কন্যা নিয়ে আনন্দ করে বাঁচার একটা চেষ্টা প্রথম থেকেই মাথায় অটো সেট হয়ে গেছে।

মেয়ে যখন একটু একটু বড় হচ্ছিল, আর টিভিতে যখন স্যানিটারি ন্যাপকিন এর বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছিল, তখন মেয়ে একদিন প্রশ্ন করেছিল, মা এগুলো কী? মেয়েকে আমি বলি নারী জীবনের কিছু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার কথা। সেদিনও মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিল, না?
আমি হেসে বলেছিলাম, কষ্ট সবারই হয় মা। কারো কম, কারো বেশি।

(২) আমাদের এক বান্ধবীর বড় বোনের বিয়ে হয়েছে খুবই উচ্চ শিক্ষিত এক পরিবারে। বিয়ের পর মাস দুয়েক শ্বশুর বাড়িতে বেড়িয়ে সেই আপু যখন বাবার বাড়িতে এলেন, তখন অনেক গল্পের এক ফাঁকে তিনি তার শ্বশুর বাড়ির গল্প করতে গিয়ে বললেন, ওরা ভীষণ অন্য রকম টাইপের। আমরা ভাবলাম, নিশ্চয়ই খুব খারাপ টাইপের। আপু বললেন, ওরা না ওদের স্যানিটারি ন্যাপকিন আনার জন্য নিজের বাবাকে বলে।
আমরা চোখ কপালে তুলে বলি, তাই নাকি? আপু বললেন, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম দেখে আমার ছোট ননদ বললো, ভাবী, এটা তো লুকোচুরি করার মতো কোনো বিষয় না, আমাদের অন্য সব স্বাভাবিক নিয়মের মতোই একটা নিয়ম। তাহলে বাবাকে চুলের শ্যাম্পু আনতে বলতে পারলে কিংবা গায়ে মাখার সাবান আনার কথা বলতে পারলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথা কেন বলা যাবে না? এটা হচ্ছে প্র্যাকটিসের বিষয়। আমাদের প্র্যাকটিসটা হচ্ছে লুকানোর। যার কারণে প্রথম দেখে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে।

আমার বান্ধবী বললো, অস্বস্তি তো হবেই। আমরা তো কোনোভাবে বাবা- আর ভাইকে লুকিয়ে মায়ের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথা বলতেও অস্বস্তিতে থাকি।

(৩) প্রথম প্রথম টিভিতে যখন স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখাতো, খুব অস্বস্তি লাগতো। টিভির সামনে বাবা বা ভাই কেউ বসে থাকলে খুব দ্রুত চ্যানেল পালটে ফেলতাম, আর যদি চ্যানেল পাল্টানোর সুযোগ না পেতাম তাহলে নিজেই টিভির সামনে থেকে উঠে যেতাম। কিন্তু প্রতিদিন দেখতে দেখতে এখন আর অস্বস্তি হয় না, এখন আর পালিয়ে যেতেও ইচ্ছে করে না। এটাই হয়তো প্র্যাকটিস। আসলেই তো ন্যাচারাল বিষয়টাকে ন্যাচারালি এক্সেপ্ট করার মানসিকতা নিজ নিজ পরিবার থেকেই শিখতে হবে, জানতে হবে। তাহলেই তো হবে জীবন আনন্দের।

(বিভিন্ন সময়ে আমার আশেপাশের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে যখন নিজের একাত্মতা খূঁজে পাই তখনই এ লেখাটার জন্ম)

বিঃদ্রঃ সম্প্রতি “প্যাডম্যান” নামে একটা ছবি দেখলাম। ছবিটা নাকি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে বানানো। এই ছবি দেখে আফসোস হচ্ছিল, আহা আমাদের দেশেও যদি এরকম কোনো ক্ষ্যাপাটে প্যাডম্যানের জন্ম হতো! তাহলে হয়তো আমাদের দেশের সব মেয়েরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ৫ টাকা/১০ টাকার বিনিময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারতো। ৯০ টাকা করে প্রতিমাসে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা অনেক পরিবারে এখনো বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়। আর তাই আমাদের প্রান্তিক মেয়েদের একটা বড় অংশ এখনো ঝুঁকির মধ্যেই আছে। চ্যানেল আইতে ‘স্বর্ণ কিশোরী’ নামে একটা অনুষ্ঠান দেখায়। কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করে। তাদেরকে ফ্রিতে স্যানিটারি প্যাড দেয়া হয়। কিন্তু সংখ্যাটা খুবই সীমিত।

মেন্সট্রুয়েশন, মাসিক, পিরিয়ড যে নামেই বলি না কেন একটা নির্দিষ্ট বয়সে এসে নারী, পুরুষ সবাই তা জানতে পারে, বুঝতে পারে। পুরুষ হয়তো নারীর কষ্টটুকু অনুভব করতে পারে না। তবু ছবির প্যাডম্যানের মতো কেউ কেউ অনুভবেরও চেষ্টা করে।

আমাদের দেশেও এমন প্যাডম্যানের জন্ম হোক, যার অনুভবের প্রচেষ্টায় সুরক্ষিত নারী স্বাস্থ্যের জন্য স্বল্পমূল্যে উন্নত মানের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের সুযোগ পাবে আমাদের সকল মেয়ে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.