ইসাবেল রোজ:
সঞ্চিতা একের পর এক আঘাতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। ওর এই বিপদের সময় কাউকে পাশে পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা সঞ্চিতা কোনদিন ভাবতেই পারেনি মারুফের সাথে মেলামেশা তার জীবনকে পুরোপুরি দূর্বিষহ করে দেবে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। আর হয়েছেও তাই। সব সময় সে মনে করতো কেউ একজন তাকে লুকিয়ে ফলো করছে। কেউ একজন তার উপর নজর রাখছে। এই আতংক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সঞ্চিতা মারুফকে বিয়ে করে সিলেটে মারুফের মা এর কাছে গিয়ে থাকতে চায়। যেখানে সে মারুফের মায়ের সেবা করতে পারবে এবং নিজেও নিরাপত্তাজনিত এ্যাংজাইটিতে ভুগবে না।
মারুফ এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়; কারণ ১) রাত বিরাতে সঞ্চিতা মারুফকে ভয় পেয়ে ফোন দিত। সেই ফোন থেকে মুক্তি পাওয়া।
২) মারুফের মা একজন ক্যান্সারের পেশেন্ট। এই মহিলাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। সঞ্চিতা এখানে কেয়ারার হিসাবে থাকলে মাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা থাকবে না।
এখানে না বলে পারছি না দুজনই ভুল কারণে একে অপরকে বিয়ে করেছে। পরিস্থিতি আজ দুজনকে বাধ্য করেছে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে। এমন নয় দুজন দুজনকে ভালবেসে পাগল হয়ে সংসার ফেলে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ার উদ্দেশ্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অতঃপর সঞ্চিতার জীবনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ আসে মারুফের বউ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া।
সঞ্চিতা খুবই চমৎকার একটি মেয়ে, একটু কষ্ট হলেও মারুফের ভাইবোন সবার মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়। যেহেতু সুমনাকে পরিবারের কেউ পছন্দ করতো না, সেহেতু সঞ্চিতার পক্ষে সবার মন জয় করে চলা সুবিধাজনক হয়।
সঞ্চিতা কিছুদিনের জন্য ভালো থাকে। খুব সুন্দর করে ঘর সাজায়। প্রতিটা ঘরের ফার্নিচার চেঞ্জ করে পুরো বাসার চেহারা পাল্টিয়ে দেয়। এখন ওর শুধু একটাই দুঃখ ‘পরী’ অনেক দূরে থাকে। ইচ্ছে করলেই অসুস্থ শাশুড়িকে একা রেখে ঢাকায় গিয়ে পরীকে দেখতে যেতে পারে না। পরীকেও স্কুল, কোচিং এসব বাদ দিয়ে সিলেটে নিয়ে আসতে পারে না। এই দুঃখ নিয়ে নতুন সংসারে ভালই দিন কাটছিল সঞ্চিতার।
সুমনা যেদিন জানতে পারে সঞ্চিতা মারুফের বিয়ে হয়েছে এবং সঞ্চিতা মারুফের মায়ের কাছে থাকে, সেদিন থেকেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মারুফকে ক্রমাগত নক করতে থাকে। ১০ বার নক করলে মারুফ একবার জবাব তো দেবেই। এভাবে শুরু হয় ফোন দেয়া। মারুফ তার বাচ্চাদের ফোন উপেক্ষা করতে পারবে না এটা সুমনা খুব ভালো করে জানে। আর জানে বলেই বাচ্চাদের ব্যবহার করে সে মারুফকে নিয়মিত ফোন করে বিভিন্ন খাতে টাকা চাইতে থাকে। মারুফ-সুমনার এই যোগাযোগ সঞ্চিতা মেনে নিতে পারে না। ওর ভাষ্যমতে যেই মহিলার জন্য আজ জীবনে এতোটা দুর্ভোগ নেমে আসছে, তার সাথে কিসের এতো কথা? মারুফ তার ছেলেমেয়ের স্বার্থেই সুমনার সাথে কথা বলতে বাধ্য হয়। এই নিয়ে সংসারে অশান্তি দেখা দেয়।
এছারা মারুফ তার ভাইবোন সমগ্র গুষ্ঠিকে ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দেয়। কিন্তু তার আয় কমে আসতে থাকে। ব্যবসায় মেজর শেয়ার চলে যায় ডিভোর্স সলুইশানে। ধীরে ধীরে মারুফের বিজনেস প্রজেক্টে লস হতে থাকে। তার নিজের ভাই তাকে ঠকিয়ে বড় রকমের অংক হাতিয়ে নেয়। বর্তমানে ব্যাংকের কাছে হিউজ লোনে জর্জরিত মারুফ আর কোনো উপায় না দেখে তার দুই সন্তানকে নিয়ে আবার ব্রিটেনে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। মারুফের ছেলেমেয়েরা যেহেতু ব্রিটিশ সিটিজেন, ওরা সহজেই ওদের মা সুমনাকে নিয়ে যেতে পারবে।
সেক্ষেত্রে সঞ্চিতাকে দেশেই থাকতে হবে। মারুফের দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত সঞ্চিতা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। যার জন্য ঘর সংসার, মা, বাবা আত্মীয়-বন্ধু সব বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেই মানুষটি তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারে ওর মাথায় আসে না।
সঞ্চিতা বর্তমানে আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। মারুফ ফাইনান্সিয়াল স্ট্রেসে এক অন্য রকম মানুষে রুপান্তরিত হয়েছে। তার সবগুলো প্রজেক্ট ব্যাংকে বাজেয়াপ্ত, পাওনাদাররা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। এমতাবস্থায় মারুফ দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে।
সঞ্চিতার বক্তব্য হলো
*যখনি মানুষ জানবে তার পরিচয়, মানুষ এ্যডভান্টেজ নিতে চেষ্টা করবে।
*মারুফের সাথে তার লাইফ স্টাইল যেমন ছিল, অথবা আগে যেমন ছিল, তা থেকে হঠাৎ করে শূন্যের কোঠায় ড্রপ করবে।
*শূন্য থেকে শুরু করার মতো মানসিকতা এবং ধৈর্য্য কোনটাই অবশিষ্ট নেই।
*একা থাকার মতো মনোবল তার নেই।
*পরিচিত মহলে ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না।
*চাকরি থেকে যেহেতু ৫/৬বছরের একটি গ্যাপ হয়ে গিয়েছে, সেহেতু স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করাও তার পক্ষে সম্ভব না।
*যেই ফ্ল্যাটটি তার আছে, সুমনা সেই ফ্ল্যাট বিক্রি হতে দিচ্ছে না। যারাই আগ্রহ প্রকাশ করছে তারা খুব অল্প দাম অফার করছে। এমনকি ফ্ল্যাটটি ভাড়াও হচ্ছে না। সঞ্চিতার ধারণা, সুমনা কোন লোক নিয়োগ করেছে যেন এই ফ্ল্যাট বিক্রি অথবা ভাড়া না হয়।
মারুফ আজ না হয় কাল, বিদেশে চলে যাবে। যতদিন মারুফের মা বেঁচে আছে সঞ্চিতা হয়তো মারুফের বাসায় থাকতে পারবে। মায়ের শরীরের যা অবস্থা, বড় জোর তিন থেকে ছয়মাস পর্যন্ত উনি বাঁঁচবেন বলে চিকিৎসকদের ধারণা। তারপর সঞ্চিতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এতোদিন মারুফের বিভিন্ন প্রজেক্টে সঞ্চিতা সহায়তা করেছে, সেখানে সবার কাছে মালিকের বউ বলে একটা এক্সট্রা রেসপেক্ট পেয়েছে। কিন্তু এখন ওর পক্ষে অন্যের চাকরি করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
সঞ্চিতার মাথায় আবারও আত্মহননের চিন্তা ভর করেছে। এতোদিন ওর স্বপ্ন ছিল একদিন পরীকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারবে। এখন সেই স্বপ্নও ভেঙে গিয়েছে। পরী এখন একটু বুঝতে শিখেছে। সে মায়ের কাছে ফিরে আসতে চায় না। দিদা এবং বাবার সাথে থাকতেই পছন্দ করে।
মানুষ আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। সঞ্চিতার বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু আশা বা স্বপ্ন থাকা দরকার, সেই আশাও আর দেখতে পাচ্ছে না। আমি সঞ্চিতাকে বুঝিয়েছি নিজের মতো করে থাকা শিখতে। কিন্তু কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারছি না যে তার জীবনের সমাপ্তি মানেই তার পরী মাতৃহীন হয়ে যাওয়া। অন্তত পরীর জন্য তাকে বাঁচতে হবে। নিজের জন্যও তাকে বাঁচতে হবে।
খারাপ সময় অথবা ভালো সময় কোনটাই চিরস্হায়ী নয়। ভাল সময় নিশ্চয়ই আসবে। এতো এতো কঠিন সময় যখন পার করতে পেরেছে, এখনও ইচ্ছে করলে এই ক্রাইসিস অতিক্রম করতে পারবে। আমার কথাগুলো মনে হয় ওর কাছে ফাঁকা বুলির মতো শোনায়। কেমন যেন অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, “আমি পরীর দিদার ফোন নম্বর রেখে যাবো। তুমি প্লিজ পরীর খোঁজ নিও”। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি যতোই বোঝাতে চেষ্টা করি পরীর দরকার তার মাকে, আমাকে নয়। কিছুতেই বোঝাতে পারি না।
আমার খুব ভয় হয় কখন যেন কী করে ফেলে মেয়েটি! আমার ভয়টা যেন সত্য না হয়। সঞ্চিতা যা করেছে, মারুফও একই কাজ করেছে। কিন্তু শাস্তিটা শুধু সঞ্চিতা ভোগ করবে কেন? আবার এই একই সমাজ সুমনার মতো মেয়েদের মাথায় করে রাখে। এই বৈষম্য কাদের দ্বারা তৈরি? সঞ্চিতা, মারুফ এবং সুমনা তিনজনের জীবন কি অন্যরকম হতে পারতো না?
শেষ