ফারজানা সুরভি:
আমি যে বাড়িটাতে থাকি, সেটা পুরাই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি”র মতো এক বাড়ি। আমাদের রান্নাঘর আর লিভিং রুম নিচ তলায় কমন। বিল্ডিং-এর সব বাসিন্দা ব্যবহার করে। দুই তলা বাড়ির একেক রুমে একেকজন থাকে। অনেকটা ইউনিভার্সিটির ডর্মের মতোন সিস্টেম। কতো বিচিত্র মানুষ! আর কতো যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে আমাদের তর্ক চলে নিচের এই লিভিং রুমটাতে!
আজ বিকাল পাঁচটায় পটলাক শুরু হয়েছিল। এখন রাত তিনটায় আড্ডা শেষ হলো। একদলের আড্ডা এখনো শেষ হয় নাই। তারা এখন রাত জেগে দল বেঁধে ‘দ্য অফিস’ দেখবে। আমার কাল কারিসার সাথে বের হওয়ার কথা সকাল ১১ টাতে। আমি ইস্তফা দিয়েছি। আমাদের আড্ডায় সবসময় লিবারেল বনাম কনজারভেটিভ দুই দল হয়ে যায়। বিতর্কের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে, একদম দুই মেরুর বিশ্বাস সত্ত্বেও হাসি হাসি মুখ করে সবাই নিজের যুক্তি দিতে থাকে। কেউ কারো যুক্তি মানে না। ‘তালগাছ আমার’ ধরনের অবস্থা। কিন্তু কেউ রাগও প্রকাশ করে না।
মাঝে মাঝে অবশ্য তর্ক বাদ দিয়ে সবাই সবাইকে পচানো শুরু করে। আজ ফেমিনিজম নিয়ে শুরু হয়ে গেলো বিতর্ক। চার্লস মুখ শক্ত করে বললো, “আমি ফেমিনিস্টদের পছন্দ করি না”। সে কনজারভেটিভ ক্যাম্পের বন্ধু। আমি আর এরন লিবারেল ক্যাম্প থেকে পচানো শুরু করলাম।
আমি বললাম, “তুমি কি কোনো ফেমিনিস্টের সাথে ডেট করে ছ্যাঁকা খাইসো?” এরন চোখ টিপি দিয়ে বলে, “ফারজানা কিন্তু মহা ফেমিনিস্ট। তুমি ফারজানাকে ঘৃণা করো তাহলে?”
চার্লস পচানি খেয়ে থতমত হয়ে আমাকে উলটা পচানি দিলো, “ফারজানাকে ঘৃণা করা সম্ভব না। তবে ফারজানা, আমি কিন্তু হিজাব দিয়ে চুল ঢাকার যুক্তির সাথে সহমত পোষণ করি। তোমার চুল একটু বেশি সুন্দর। ঢেকে রাখাই উচিত”। উলটা পচানি খেয়ে আমি পালটা পচানি দিলাম, “তুমি মোল্লাদের সাথে যোগ দাও। তোমার যুক্তি আর মোল্লাদের যুক্তিতে কোনো তফাত নাই। মোল্লারাও গে ম্যারেজ পছন্দ করে না। তুমিও করো না। মোল্লাদের-ও জেন্ডার ইস্যুতে চুল্কানি। তোমারো তাই। আই এস-এর খ্রিস্টান শাখায় যোগদান করো”।
স্টেসি বলে, “আমি তোমাদের এইসব আঁতেল ডিবেটে নাই। আসো আমরা গ্র্যান্ড থেফট গেম খেলি”। এরপর ম্যাট আর স্টেসি মিলে একটা মহা ভায়োলেন্ট গেম খেলা শুরু করলো বড় স্ক্রিনে। গেমে খালি ঠুসঠাস সবাই সবাইকে গুলি করে। স্ট্রিপ ক্লাবে আগুন ধরায়ে দেয় ইত্যাদি সহিংস কাজ-কাম।
জন্মসূত্রে আমরা কেউ মুসলিম, কেউ ইহুদী, কেউ খ্রিস্টান। বিশ্বাসে আমরা কেউ মহা র্যাডিকাল, কেউ মহা লিবারেল, কেউ মডারেট, কেউ নাস্তিক, কেউ বিশ্বাসী, কেউ সংশয়বাদী। কিন্তু এই ছেলে-মেয়েগুলোর সাথে এইসব রাত-বিরাতের আড্ডার দারুণ দিক হচ্ছে, পলিটিক্যাল সায়েন্সের গ্র্যাজুয়েট ক্লাস ডিসকাশনের মতোন সবাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলে। দ্বিমত করতে গিয়ে আমরা কেউ কাউকে অপমান করি না। দ্বিমত আছে বলেই এক লহমায় আমরা কেউ কারো বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যাই না।
স্টেসি মদ আর সিগারেট খেতে খেতে রাত-বিরাতে তার কষ্টের কথা বলে। আমি কোকের ক্যান হাতে নিয়ে ওর কষ্টের কথা শুনি। কোনো দ্বিমত আমাদের এই বন্ধুত্বের জায়গাটুকু নষ্ট করে না।