গল্পটা অন্য রকম হতে পারতো

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

রেখা মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যবিত্ত বউ। মধ্যবিত্ত বউ বলছি, কারণ রেখা ও রেখার স্বামী দু’জনেই মধ্যবিত্ত টাইপের চাকরি করেন। তবে রেখার স্বামী ভালো মানুষ গোছের মধ্যবিত্ত। কারো সাতেও নাই, পাঁচেও নাই ধরনের পুরুষ মানুষ।
কারো সাতে-পাঁচে না থাকলেও পুরুষ মানুষ হবার যাবতীয় গুণাবলী রেখার স্বামীর আছে। এই যেমন ঘরে বসে বসে রেখার উপর খবরদারি করা। নিজে সংসার খরচ চালাতে পারুক আর না পারুক রেখার ছোট চাকরি নিয়ে রেখাকে খোঁচা মারা, কলিগদের নিয়ে সন্দেহ করা, বিয়ের এতোদিন পরেও শ্বশুর বাড়ি থেকে কী পেলো, আর কী পেলো না, কী পেতে পারতো, আর কী নিতে পারতো এসবের হিসেব কষা ইত্যাদি। এসব হিসাব নিকাশ করতে যেয়ে মাঝে মাঝেই তিনি তার গোবেচারা স্বভাব বিসর্জন দিয়ে রেখাকে দুই চারটে চড় থাপ্পড় দিয়ে ফেলেন।

রেখাও ঘরের লক্ষী বউ। স্বামীর কথায় তেমন উচ্চবাচ্য করার স্বভাব তার নাই। তাই এই গোবেচারা টাইপের লোকটা সারাদিন অফিস করে স্পোর্টস চ্যানেল অথবা সংবাদ শোনার ফাঁকে হতাশ হয়ে শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির প্রতি হালকা লোভ প্রকাশ করে গায়ে হাত যদিওবা তুলে ফেলেন তাতে রেখা কিছু মনে করে না। আসলে মনে করেও এর কোন প্রতিকার আছে কিনা রেখা জানে না, তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। তাছাড়া রেখাও সারাদিন চাকরি করে ঘরে ফেরে। ছোট হোক আর বড় হোক, তাকেও ৯টা-৫টা গাধার খাটনি খেটে ঘরে ফিরে সংসার সামালাতে হয়, তাই তখন তার গায়ে অতো জোরই থাকে না যে উচ্চবাচ্য করবে।

রেখার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর হতে চললো। বিয়ের এতো দিন পার হয়ে গেলেও রেখার কোন বাচ্চা কাচ্চা হয়নি। তাই রেগে গিয়ে গায়ে হাত তোলার আগে রেখার স্বামী রেখাকে সাধারণত আটকুড়ি বলেই সম্মোধন করেন। রেখার চেনাজানা কারো কানে এখবর গেলে তারা নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন, “যতই হোক পুরুষ মানুষ, বাবা হবার সুখ পাচ্ছে না, তাই মাথার ঠিক থাকে না”।

শ্বশুর বাড়ি ও সমাজের লোকজন এরই মধ্যে কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে যে বউয়ের সমস্যা আছে। রেখার স্বামী রেখার বাবা-মার কাছ থেকে রেখার চিকিৎসা বাবদ লাখ খানিক টাকাও নিয়ে ফেলেছেন। হাজার হোক রেখার স্বামী ভদ্র সমাজের ভদ্র মধ্যবিত্ত, রেখার বাচ্চা হচ্ছে না বলে তো আর তাকে ফেলে দিতে পারেন না। যদিও মুসলমান ধর্মে চার বিয়ে জায়েজ, তাতে কি? আরেকটা বিয়ে করা মানে আরেক দফা খরচাপাতি। এসব হাজারো চিন্তা রেখার স্বামীর মাথায় প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে।

রেখার শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামে থাকেন। সম্প্রতি তারা রেখার মা হওয়া নিয়ে বেশ বলাবলি করছেন,“রেখার বাচ্চাকাচ্চা হবার সম্ভাবনা নাই কারন রেখার দোষ আছে। রেখার বয়স ত্রিশ পার হয়ে গেছে, এখনো বাচ্চা না হলে আর কবে হবে?” এরকম আরো নানা কথা।

এইতো সেদিন, রেখার শাশুড়ির ফোন করে জানালেন রেখার মেজো জা’এর আবার বাচ্চা হবে। এই সুসংবাদটা দিতে শাশুড়ি যতো না সময় নিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় নিয়ে রেখাকে যা তা কথা শুনিয়ে দিলেন, “আটকুড়ি ডাইনি মেয়েছেলে ঘরে এনে তার ছেলের কপাল খেয়েছেন, আদরের ছেলে তার বাবা হবার সুখ পেলো না, সবার ঘরে দুই-তিনটা করে হয়ে গেলো, এই ছেলের ঘরে একটাও নাই”, ইত্যাদি।
রেখা ফোনটা কানে নিয়ে নিরবে সব কথা হজম করে নিলো। সপ্তাহে অন্তত একবার এরকম ফোনালাপ তাকে সামলে নিতে হয়, কখনো ঘরে, কখনো অফিসে। বিয়ের সময় রেখার বাবার বাড়ির মুরুব্বিরা রেখাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, “শ্বশুর বাড়িতে যেয়ে কথা যতো কম বলবা ততোই সুখী হবা”। রেখা গত সাত বছর ধরে সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে। তবে সুখী হতে পেরেছে কিনা সে জানে না।

বিয়ের প্রথম বছরই রেখা একবার সন্তান-সম্ভবা হয়েছিল, কিন্তু রেখার স্বামী তখনই পরিবার বড় করতে প্রস্তুত ছিলেন না বলে পরিচিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঝামেলা মুক্ত হয়েছিলেন। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তখন রেখার, স্বামীর কথামতো পুরো ঘটনাটা সেদিন রেখাকে চেপে যেতে হয়েছিল। আজও সেই সন্তানের কথা মনে পড়ে গেলে রেখার স্বর ভারি হয়ে আসে এবং দম বন্ধ বন্ধ লাগে।

তবে মা হবার যাত্রা রেখার সেদিন-ই শেষ হয়ে গেছে, তা নয়। বিয়ের তিন বছরের মাথায় আবার রেখা গর্ভধারণ করলো। এবার আর সুসংবাদটা রেখার স্বামী ধামাচাপা দেননি। রেখার শাশুড়ি সুসংবাদ শুনে গ্রামের বাড়ি থেকে ছেলের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তবে সন্তান সম্ভবা ছেলের বউয়ের দেখাশুনা করার জন্যে নয়, সন্তান-সম্ভবা ছেলের বউয়ের কাছ থেকে সেবা পাবার প্রত্যাশায়।

রেখায়ও সাধ্যের অতিরিক্তই করেছিল যাতে শাশুড়ি সেবায় কোন কমতি না হয়। তবু একদিন সকালে রেখার ঘুম ভাঙলো দেরি করে, নাস্তা হলো দেরি করে, তাই শাশুড়ি আম্মা আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না, চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হলো, “আমরা কি আর বাচ্চা পয়দা করি নাই? পাঁচ-পাঁচটা বাচ্চা হইলো, কই সংসারের কামে তো ফাঁকি দেই নাই”!

সকাল সকাল চেঁচামেচির শব্দে রেখার স্বামীর ঘুম নষ্ট হলো, ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারলেন, যতো দোষ নন্দ ঘোষ অর্থাৎ তার বউয়ের। যেই বুঝা সেই কাজ, স্বামী মহাশয় এক মিনিটও সময় নষ্ট করলেন না। চুল টেনে রেখাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। দু চারটে পিঠে বসিয়ে হালকা একটু ধাক্কা মারতেই, রেখা বেসামাল হয়ে পড়ে গেলো। সেই ছিল রেখার মা হবার স্বপ্ন দেখার ইতি। প্রথমে তলপেটে ব্যথা, তারপর রক্তক্ষরণ। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেলো। শাশুড়ি আরও সাত দিন বাসায় থাকলো, একটু সুস্থ হতেই শাশুড়ি রেখাকে গালিগালাজ করতে শুরু করলো। “অলক্ষী, অসাবধানী বউ”, ইত্যাদি।

রেখা ভেবেছিল রেখার চোখের জল সেদিনই শুকিয়ে গেছে যেদিন তার দ্বিতীয় বাচ্চাটাও পেটেই মরলো। তবে আজো মাঝে মাঝে রেখাকে অবাক করে দিয়ে তার গাল গড়িয়ে এক ধরনের নোনা উষ্ণ জল নেমে আসে। তখন তার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কষ্টের প্রখরতায় তার কন্ঠনালি দিয়ে কেবল চি চি মৃদু আওয়াজ বের হয়, চিৎকার না!

মাঝে মাঝে গোসলখানার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, যদি প্রথম থেকেই নিজের নিরবতা আর সবকিছু সহ্য করার গুণটাকে প্রশ্রয় না দিত তাহলে আজ হয়তো রেখার গল্পটা অন্য রকম হতে পারতো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.