সামিয়া কালাম:
সেদিন আরজে জিনাতের শো চলছিল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী শো চলার সময়ে অন এয়ার রুমে সেলফোন সাইলেন্ট মোডে রাখতে হয়। তাই জিনাত জানতে পারেনি তার ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে অসংখ্য বার কল আসে। সাধারণত কোন আননোন নাম্বারের কল সে রিসিভ করে না, কিন্তু তখন সময়টা দুপুর, এবং বার বার কল আসছে দেখে সে ভাবলো বাসায় কোন বিপদ আপদ হয়নি তো!
শো শেষে কিছু কাজ গুছিয়ে, নিজের শো রিপোর্ট এবং অন্যান্য ফাইলগুলো যথাস্থানে রাখলো। সিনিয়ার প্রডিউসারের সাথে ছোট একটা মিটিং সেরে বাড়ি ফিরবে এমন সময় আবার সেই কলটা এলো। এবারে কলটা না রিসিভ না করে পারা গেল না।
: হ্যালো?
: হ্যালো, একাটি আর জে জিনাত এর নাম্বার?
: হ্যাঁ, বলছি।
: আপা, আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি একটু?
: কে কথা বলছেন?
: আমার নাম মিনহা। আমি থাকি মগবাজারের পীর পাগলা গলিতে, আপা আমার একটা মেয়ে আছে, ওর নামও জিনাত জানেন! আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
: বাহ! বেশ তো!!
: আপা, আপনার কি সময় হবে? আমি একটু কথা বলতাম…।
: মিনহা, আপনি তো কথাই বলছেন…
: না, মানে আমার কিছু বিশেষ কথা ছিল, যদি একটু শুনতেন।
: আজ তো একটু ব্যস্ত, পরে না হয় একদিন শুনবো, কেমন? ভালো থাকুন। আজ রাখি।
মিনহার সাথে সেদিনই জিনাতের প্রথম আলাপ। এরকম কল মাঝে মাঝেই আসে, তাই জিনাত পারতপক্ষে আননোন নাম্বার রিসিভ করে না। সে একজন রেডিও জকি। বেতারকে ভালোবেসে এই পেশায় এসেছে। ছোটবেলা থেকেই বেতারের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ।
বাবা বলতেন, বেতার এক শক্তিশালী মাধ্যম। টেলিভিশান সিগন্যাল যেখানে পৌঁছায় না, বেতার এর তরঙ্গ সেখানে পৌঁছে যায়। অবশ্য দিন বদলের খেলায় এখন মোবাইল নেটোয়ার্ক পৌঁছে যায় সবখানেই। এটা তার ভালো লাগার জায়গা। কোনরকম প্রচার বা সেলিব্রিটি হাবার বাসনা নেই, সময়ও নেই। তাই এই ধরনের ফোন কল সে এড়িয়ে যায়, কিন্তু দিন দশেক পর সেই নাম্বারটা থেকে আবার কল এলো। সেদিন জিনাত বাসায়, খুব বেশী ব্যস্ততা তার ছিল না।
: হ্যালো
: জিনাত আপু, ভালো আছেন? আমাকে চিনতে পরেছেন? আমি মিনহা। ঐযে সেদিন কল করেছিলাম।
: কেমন আছেন মিনহা, চিনতে পেরেছি।
: হ্যাঁ আপু খুব ভালো আছি। আপু আপনার কি একটু সময় হবে এখন? আমার কিছু কথা বলার ছিল।
: কী বিষয়ে বলুন তো?
: আমার জীবনের বিষয়ে।
: আপনার জীবনের বিষয়ে কথা আমাকে কেন শোনাতে চাচ্ছেন?
: কারণ আপনি বুঝবেন, এবং আমার এই কথাগুলো কোন না কোনভাবে মানুষের উপকারে আসবে আমি সেটা চাই। প্লিজ আপু, যদি একটু শুনতেন…
: আচ্ছা বলুন।
অতঃপর মিনহা তার জীবনের কিছু কথা জিনাতকে বলে:
আপু আমি আমার শৈশবকে খুব মিস করি। হুট করে কীভাবে যেন সময় পার হয়ে গেল! আমার শৈশব। কবে তাকে ফেলে এসেছি, কিন্তু কেন এখন এতো বেশি মনে পড়ে? কাঁচা আমের চাটনি, দুরন্তপনা, মায়ের শাড়ি ফ্রকের ওপর পেঁচিয়ে পরে গিন্নী গিন্নী খেলতে খেলতে কখন যে ফুল টাইম গিন্নী বনে গেছি, খেয়ালই করিনি!
আমি এক নারী, সমাজের নিয়মে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই কন্যা শিশু হিসেবে বেড়ে উঠতে হয়েছে। একটু বড় হবার পর বাবা, আর কাকাদের কোলে দিতেও মা এর সে কী সাবধানতা! কত সতর্কতা আমাকে নিয়ে! আমার চলাফেরা, খেলার সাথী, প্রাইভেট টিউটার, এমনকি ছোটবেলায় যারা আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, তাদের থেকেও আগলে আগলে রাখা। তবুও আমাদের সমাজেই প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে তিনজনই কোন না কোনভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার। তাই আমিও বাদ পড়িনি।
কোন এক নির্জন দুপুরে মা যখন সংসারের সব কাজ সেরে ক্লান্ত, বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছেন। তখনই ঘটলো সেই ব্যাপারটা, এবং আমি এক তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার কারলাম, আমার আত্মীয়দের একজনই আমার শরীরের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তার কুৎসিত হাত। যাকে আমি পরম আপনজন জানতাম, যে বাড়ি এলে আচার আর চাচা চৌধুরীর কমিক বই কিনে দেবার জন্য বায়না করতাম, সেই মানুষটাই সেদিন চাচা চৌধুরীর দুষ্টু লোকদের মতো আমাকে আক্রমণ করলো অতর্কিতে!
আহা আমাকে বাঁচাতে সাবু বা চাচা চৌধুরীর মতো কেউ যদি এগিয়ে আসতো তখন! কী জানি, কী দৈব বলে, কাছাকাছি কোন এক পরিচিত পায়ের শব্দ শুনে একটু পরেই পিছিয়ে গেল সে, কিন্তু ততোক্ষণে আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। বুঝলাম মেয়ে শিশু বলে আমাকে থাকতে হবে একটা বর্মের ভেতরে। আর মুখ রাখতে হবে বন্ধ। পাছে কেউ জানতে পারে, পাছে নিন্দে হয়।
সেদিন রাতে বুকে তীব্র যন্ত্রণা হলো। অস্বস্তি দেখে মা জানতে চাইলেন কি হয়েছে? মাকেও আমি বলতে পারলাম না… কারণ সেই আততায়ী বা আত্মীয় আমাকে এই ঘটনার পর নানা ভাবে, নানা সময় বারণ করেছে আমি যেন কাউকে কিছু না বলি। কেননা আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আমাকেই সবাই মন্দ বলবে। আর এই “মন্দ” বলার ভয়ে আমি নীরব হয়ে রইলাম। আতংক আমাক ঘিরে রাখলো। এরপর আরও কত কত দিন কেটে গেল। আমি আরও বড় হলাম। মা এর হাত ছেড়ে একা হাঁটার চেষ্টা করলাম আর পাঁচ-দশ জনের মতো। বাসে, পথে, ফুটপাতে, এমনকি কো-এডুকেশান শিক্ষাক্ষেত্রে আমি আবার নিপীড়িত হতে থাকলাম। আর চুপ করে থাকতে লাগলাম। সেই নিস্তব্ধতা দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে যেতে থাকলো।
সোনালী রোদ্দুরের মত আমার জীবনেও প্রেম এলো এক সময়। কোন এক বিশেষ মূহূর্তে সেই মানুষটার আচরণকেও আমি সেই আততায়ীর মতই মনে করলাম। আমার অবুঝ মন বা শরীর বিভেদ করতে পারল না কোন স্পর্শটা ভালাবাসার আর কোনটা আক্রমনের। আমি দূরে সরে যেতে থাকালাম।
সময় আরও গড়ালো। পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে চাপ আসতে লাগলো ‘মেয়ের যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে, এবার বিয়ে দাও’। স্টুডেন্ট অবস্থায় তথাকথিত এক সু-পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো একদিন। সময় বয়ে যেতে লাগলো। আমার কাছে কোন স্পর্শে ভালবাসা রইলো না। একদিন সেইসব ভালবাসাহীন স্পর্শে আমি নিজের মাঝে মাতৃত্ব অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সময়। অথচ তখনও আমি বাড়ির বাইরে গেলে আমাদের সমাজের মানুষগুলো কথার তীরে আমায় বিদ্ধ করতো। শিশু জন্মানোর প্রক্রিয়া নিয়ে নানান উক্তি করতো এক রাস্তা ভরা জনবহুল জনারণ্যে, আমি সেই তিরস্কার শুনেও চুপ করে থাকতাম। ভেবে নিতাম, এরকমই বুঝি হয়। এটাই বুঝি স্বাভাবিক। অবশেষে সেই দিন এলো; আমার মধ্য দিয়ে আবার আমারই জন্ম হলো। সেই ছোট্ট কন্যা শিশুটি ঘুমের মাঝেই মুচকি হাসে, কিন্তু আমার সব আনন্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়…. আপা, আপনি না সুযোগ পেলেই কবির সুমনের গান প্লে করেন? ঐযে একটা গান আছেনা…
“গান তুমি হও আমার মেয়ের ঘুমিয়ে থাকা মুখ
তাকিয়ে থাকি, এটাও আমার বেঁচে থাকার সুখ।”
আমার ঘুমন্ত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কত কতবার যে আমি কেঁদেছি! মনে হয়েছে এ কোন পৃথিবীতে এনে ফেললাম তাকে। এ পৃথিবী কামুক, জরাগ্রস্ত, বিকৃত লোকেদের আবাস। আর আমি ভাবতে থাকি, ওকেও তো চুপ করেই থাকতে হবে!! কিন্তু ওকে আমি চুপ করে থাকতে শেখাই না। বলতে শেখাই। আমাদের শৈশব এর ঘটে যাওয়া এই দুষ্ট চক্রকে ভাঙ্গতে হবে আমাদেরই। ভালো থেকো শৈশব। ভালো থেকো শৈশবের সব শিশুরা।
ফোনের এপাশে জিনাত নিঃশব্দে কথাগুলো শোনে। খুব অসহায়ত্ব তাকে ছেয়ে ফেলে। কেননা প্রতিদিন রেডিও টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে নানা প্রচারণা চলতে থাকে, আর একই সাথে প্রচার হতে থাকে নতুন নতুন নির্যাতনের খবর। খবরে নতুন মাত্রা যোগ হয়, ‘ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গ কেটে পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণ।’ ‘ গণধর্ষণের পর পাথর মেরে হত্যা।’ আরো কত কী! সে সব খবরে চোখ রাখলে বাকিটা দিন দম বন্ধ হয়ে আসে।
* মিনহা একটি ছদ্ম নাম। ফোন রাখার আগে সে অনুরোধ করেছিল তার নাম এবং পরিচয় যেন গোপন রাখা হয়। কেন করেছিল তা জিনাতের জানা নেই। কেউ কেউ হয়তো অন্তরালেই থেকে যেতে চায়।
লেখক: প্রোডিউসার এবং আরজে এফএম ৯৬.০