ফাহমিদা বারী বিপু:
এক-
বারান্দার ইজিচেয়ারটাতে বসে ছোলামুড়ি খাচ্ছি।
ছুটির বিকেল। রিনার সাথে এটা আমার এক রকমের অলিখিত চুক্তি। অন্যদিন বিকেলে নাস্তা হিসেবে চা বিস্কিট যাই দিক না কেন, ছুটির দিনগুলোতে অবশ্যই ছোলামুড়ি চাই আমার। আর সাথে যদি একটু বাদাম ভাজা ছড়িয়ে দেওয়া যায়…ওহ! তোফা!
এক হাতে ধরা আছে বুদ্ধদেব গুহ’র ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। বাইরে ছেলেপুলের দল ক্রিকেট খেলছে। শব্দে কানে তালা ধরে যায়। তাই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারছি না। মাঝে মাঝে শুধু চোখ বুলাচ্ছি।
রিনা এসে বার কয়েক বইয়ের প্রচ্ছদ উল্টেপাল্টে দেখেছে। মুখে-চোখে ছদ্মরাগ ফুটিয়ে তুলে বলেছে,
‘কী, ভেতরে খুব রগরগে ব্যাপার-স্যাপার নাকি?’
আমি উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসেছি। যার অর্থ ‘হ্যাঁ বোধক’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি!
সাহিত্যে একটু ইয়ে টাইপের বিষয় আশয়ের উপস্থিতির ব্যাপারে রিনার মতামত আমার সাথে ঠিক মেলে না। আমি খানিক উদারপন্থী। নারীকে নারীসুলভ কৌমার্য দিয়ে যদি সুকোমল রূপে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে তাতে এতো আপত্তির কী আছে? সেটা তো সাহিত্যের দাবি! অস্বীকার করার তো উপায় নেই।
কিন্তু রিনা এই ব্যাপারে যাকে বলে ভয়ানক কট্টর। আমার উদার মতামতকে সে এক তুড়িতেই উড়িয়ে দেয়।
‘রাখো তোমার ওসব ভাবের কথা! বইয়ের কাটতি যাতে বেশি হয়, সেজন্য লেখক কবিদের এসব এক টাইপের ফন্দি আর কী! যত চটচটে বিষয়, তত পাঠকের দুর্বার আকর্ষণ। বইয়ের বিক্রিও রমরমা। আর তাছাড়া…তোমার মতো পাঠক তো একেবারে অলিতে-গলিতে! লেখকদের সেই খবর ভালোই জানা আছে। বুঝলে? ওসব কৌমার্য টৌমার্য সব ফাঁকা আওয়াজ।’
আমি তর্কে পারি না। আবার মেনেও নিই না। গাঁইগুই করে বলি,
‘সে তুমি যাই বলো…’
আমার বাসার পাশের রাস্তাতেই পাড়ার ছেলেপুলেরা রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলে। ইট দিয়ে স্ট্যাম্প আর রাস্তাকে পিচ বানিয়ে জম্পেশ ম্যাচ জমিয়ে ফেলে। তাদের হৈ হট্টগোলে বিকেল বেলাতে পাড়াটা বেশ মেতে থাকে।
মফস্বল শহর। বিনোদনের তেমন প্রাচুর্য নেই। তাই ছেলেপুলেরা এখনো এসব নির্দোষ খেলাধুলা নিয়ে সময় কাটায়। যদিও ব্যাটসম্যানের বেসামাল ছক্কার ঘায়ে আমার বাসার জানালার কাঁচ অনেকবারই আহত হয়েছে।
আজকেও তাদের চেঁচামেচি শুনতে শুনতে বই পড়াতে মন বসানোর চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ একসময় বোধ করলাম, বাইরে বেশ একটা নীরবতা। ছেলেপুলেদের আওয়াজ তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। একবার মনে হলো, কিছু একটা গাড়ি অথবা ঐ জাতীয় কিছু এসে থামলো আমাদের ফ্ল্যাটের পাশে। আর সেই সাথে দু’চারজন মানুষের ব্যস্ত কথাবার্তা।
আমি উঁকি মেরে ‘কী ব্যাপার’ দেখতে যাবো, এমন সময় রিনা হন্তদন্ত হয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেল। সাগ্রহে ঝুঁকে তাকিয়ে থাকলো নিচের দিকে।
‘এই শুনেছো, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া এসেছে। যাক বাবা, এতোদিনে একটু কথা বলার কাউকে পাবো!’
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটা অনেকদিন ধরেই ফাঁকা পড়েছিল। আগের ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ার পরে এতোদিনেও আর নতুন কোন ভাড়াটিয়া আসেনি। আগের ভাড়াটিয়া মহিলার সাথে রিনার খুব সখ্য ছিল।
সারাদিন বাসায় একা একা থাকে। আমাদের নতুন বিয়ে, এখনো ছেলেপুলে হয়নি। বেশ বুঝতে পারি, রিনার সময় কাটতে চায় না। খুব একাকিত্বে ভোগে সারাদিন।
এতোদিন বাদে নতুন ভাড়াটিয়ার আগমনে তাই রিনার খুশিটাই সবচেয়ে বেশি। ওর উল্লসিত মুখের দিকে সহাস্যে তাকিয়ে আমিও নিচের দিকে চোখ দিলাম।
বাসার সামনের রাস্তাটায় একটা পিকআপ ভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্যানে বোঝাই করা আসবাবপত্র। দুজন গাট্টাগোট্টা গোছের লোক সেগুলো নামাতে ব্যস্ত। একটু পরে বত্রিশ-তেত্রিশ বছরের একজন যুবক পিকআপের সামনের সিট থেকে নেমে এসে তাদের কাজের তদারকি করতে লাগলো।
পাশ থেকে রিনার ধারাভাষ্য চলছে সমান তালে।
‘খুব বেশিদিন আগে বিয়ে হয়নি বুঝেছো? আমাদেরই মতো হবে।’
আমি কৌতুকভরা মুখে বললাম,
‘বাব্বাহ, এটুকু দেখেই বুঝে গেলে?’
‘ও বোঝা যায়! দেখছো না, ফার্নিচারগুলো কেমন চকচক করছে!
আমি কিছুক্ষণ দেখে আবার এসে ইজিচেয়ারে বসতে যাচ্ছিলাম। পারলাম না…হঠাৎ মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে গেলাম আমি।
একটা বিশ-বাইশ বছর বয়সের তরুণী নেমে এসেছে গাড়ি থেকে।
সোনালী পাড়ের হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরনে। বাটিকের ব্লাউজ। চুলগুলো আলগোছে এঁটে রাখা একটা হাত খোঁপায়। একটু পেছন ফিরতেই চোখে পড়লো খোঁপাতে একটা রুপোর কাঁটা বসানো।
মেয়েটি নেমে বার কয়েক উপরের দিকে তাকিয়েছে। হয়তো বাসাটা দেখার জন্য। মুখটি দেখামাত্রই মনে গেঁথে গেল পুরোপুরি।
আমি সাহিত্যানুরাগী মানুষ। নারী সৌন্দর্যের কদর করি না এমন কথা তো আর বলতে পারি না! মেয়েটির মুখে তেমন কোন প্রসাধন নেই। চোখে হয়তো হাল্কা কাজল থাকতে পারে, আর ঈষৎ রাঙা ওষ্ঠাধর। ব্যস, এতোটুকুই!
তবু…কীসের এক অপার্থিব সৌন্দর্য যেন ঘিরে আছে মেয়েটাকে। কিছুতেই সেই সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না। নাক, মুখ, চোখ, কপাল, কপোল…প্রতিটি ক্ষেত্র যেন সুনিপূণ দক্ষ কোনো শিল্পীর অতি মনোযোগী তুলির নিখুঁত আঁচড়। কোথাও এতোটুকু অপূর্ণতা নেই।
কতোক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম, জানি না। একসময় নিজের কাছেই লজ্জা লাগতে লাগলো। এভাবে হ্যাংলার মতো পরস্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি। তাও আবার নিজের স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে!
পাশে তাকিয়ে দেখি, রিনাও হাঁ করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে এতোটুকুও রা নেই। শুধু রিনা কেন, নিচে যেসব কিশোর-তরুণের দল খেলছিল, তারাও সব একপাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকেই গভীর মনোযোগে দেখে চলেছে।
প্রত্যেকেই যেন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। পাক্কা পাঁচ মিনিট পরে রিনার আওয়াজ পেলাম পাশ থেকে।
‘এই হেমা মালিনি কই থেকে এলো রে বাবা? এ যে একেবারে ডাকাইত্যা সুন্দরী!’
তারপরেই পাঁই করে ঘুরে গেল আমার দিকে। চোখের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ভালোমতো নিরীক্ষণ করে বললো,
‘কী, খুব সাধ মিটিয়ে দেখলে তাই না? দেখো দেখো…তোমারই তো দিন এখন!’
আমি তখন আকাশ দেখছি। যেন কিছুই শুনতে পাইনি এমন ভাব নিয়ে বললাম, ‘শুধু আমার দিন হবে কেন, ভদ্রলোকও তো দেখতে বেশ খাসা। এতোক্ষণ তুমি কি সেদিকে তাকিয়ে ছিলে না? বল বল!’
রিনা বেশিক্ষণ আমার কথায় মনোযোগ দিল না। সত্যি সত্যি যেন খুব চিন্তায় পড়ে গেছে এমনভাবে বললো, ‘ছোকরাগুলো পর্যন্ত কেমন হাঁ করে গিলছে একেবারে! এ তো ভারী ভয়ানক কথা!’
কী ভারী ভয়ানক ব্যাপার হলো সেটা না বুঝতে পারলেও আমি এই প্রথমবারের মতো আমার স্ত্রীর ভারী বাধ্য স্বামীতে পরিণত হলাম।
কোন প্রতিবাদ করে সময় নষ্ট করতে গেলাম না।
সেই সময়টুকুর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করলাম নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে।
দুই-
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটা দুমাসের খরা কাটিয়ে আবার সরগরম হয়ে উঠলো।
আমাদের প্রতিবেশি দু’জন মোটে মানুষ, স্বামী আর স্ত্রী। তবু সরগরমই হয়ে উঠলো বলা চলে। প্রায় সবসময়ই বাসায় কেউ না কেউ আসছে। সারাদিনই নাকি সেই বাসায় কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়।
আমি অবশ্য বিকেলের পর থেকে সেই আওয়াজ শুনি। দিনের বাকি অংশের রোজনামচা শুনতে পাই রিনার কাছ থেকে।দরজার সামনে রাখা ‘ওয়েলকাম’ লেখা পাপোষে প্রায় সবসময়ই কয়েকজোড়া জুতা স্যান্ডেল দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই রিনার বয়ান ভুল নাও হতে পারে।
এতোদিন পরে কথা বলার লোক পাওয়াতে যতোটা খুশি হয়ে ওঠার কথা ছিল, রিনা ঠিক ততটা খুশি হয়ে ওঠেনি বলে মনে হচ্ছে। কারণটা অবশ্য অনুমান করাটা শক্ত কিছু নয়। সেটি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর এতোদিনের নারীঘটিত বাস্তব-অবাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দিব্যি অনুমান করে নিয়েছি।
নারীজাতি প্রকৃতিগতভাবেই কিছুটা সন্দেহবাতিক, হিংসুটে প্রকৃতির। এতো ডাকসাইটে সুন্দরী রমণীর কিছু দোষত্রুটি না ধরতে পারলে নিজেকে অনেক নিচু অবস্থানে দেখতে হয়। সেটা তো আর মেনে নেওয়া যায় না!
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটির বারান্দা বেশ সেজে উঠেছে। সেখানে এখন খান আষ্টেক ফুল আর পাতাবাহারের টব আসন পেতেছে। কাপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য দড়ি না টাঙিয়ে ঝুলন্ত হ্যাংগারের মতো কী একটা যেন রাখা হয়েছে। অনেকটা বড় আকারের বাচ্চাদের ঝুমঝুমির মতো দেখতে। সেখানে একসাথে বেশকিছু কাপড় সুন্দর দোল খেতে খেতে রোদে শুকায়। দেখতে বেশ ভালোই লাগে।
ভাবছিলাম রিনাকেও বলবো, দড়ি সরিয়ে দিয়ে এমন কিছু একটা কিনে এনে বারান্দায় রেখে দিতে। বাইরে থেকে দড়ি ঝুলে আছে দেখতে কেমন যেন লাগে। কিন্তু রিনা আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অন্য কথা পাড়ে। বলাই বাহুল্য, পাশের বাসার প্রতিবেশিনীই এখন তার বেশিরভাগ গল্পের মূল বিষয়।
‘বুঝেছো, খুব নাক উঁচু। এমনভাবে তাকায় যেন আমরা তার প্রজা আর তিনি হচ্ছেন রাণী। খালি মুচকি হেসেই কাজ সাবাড়! আর কী সাজগোজ! বাপরে! বাসাতেও কেউ মাড় দিয়ে শাড়ি পরে থাকে? কোথায় ভেবেছিলাম এতোদিন বাদে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করার কাউকে পাবো! সব গুঁড়ে বালি!’
আমি চুপচাপ শ্রোতার ভূমিকাতেই থাকি। এসব জায়গায় কিছু বলতে যাওয়াই বিপজ্জনক। বউয়ের পক্ষ নিলেও বিপদ, বিপক্ষে গেলে তো কথাই নেই!
প্রতিবেশি ভদ্রলোকের সাথে দু’একবার কথা হয়েছে আমার। একটু চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ। কেমন যেন শামুক গোছের। খোলস ছেড়ে বেরুতে চান না। একটা ব্যাংকে চাকরি করেন। এই শহরে নতুন এসেছেন বদলী হয়ে।
আর মেয়েটি…কী যেন নাম বলছিল রিনা…ও হ্যাঁ, বহ্নি। যথার্থ নামই বটে! এই মেয়ের নামের সাথে আগুন না থাকলে কি মানায়? আগুনের লেলিহান শিখা…দাউ দাউ বহ্নিশিখা।
তার সাথে কথা না হলেও সালাম বিনিময় হয়েছে আমার। বারান্দার ফুলের গাছগুলোতে পানি দেওয়ার সময় অথবা কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময়টুকুতে…চকিতে দৃষ্টিবিনিময় হয়েছে। শাড়ি পরিহিতাই দেখেছি বেশিরভাগ দিন। দীঘল চুল এলিয়ে ছিল পিঠের ওপরে।
সাজসজ্জাতে মোটেও কোন আড়ম্বরতা নেই। যথেষ্ট রুচিশীল আর পরিমিত চলন। আচরণে তা ভালোমতই ফুটে ওঠে।
আমার সাথে যে ক’বার দেখা হয়েছে, মেয়েটি অত্যন্ত সপ্রতিভ ভঙ্গিতে হাসিমুখে সালাম দিয়েছে। সেই হাসিমুখে কোন গায়ে পড়া চাটুল্য দেখতে পাইনি আমি। বরং ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল প্রকটভাবে।
সালাম দিয়েই সে আবার মনোযোগী হয়েছে নিজের কাজে। আমার কিন্তু মোটেও নাকউঁচু মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে এমনটা না হলেই বুঝি খারাপ লাগতো। এমন একটি মেয়েকে পাশের বাসার প্রগলভ মেয়ের চরিত্রে ঠিক যেন মানায় না।
রিনার বক্তব্য যে অনেকটাই কল্পনাপ্রসূত, সে ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়েছে আমার। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি, এ আর কিছু নয়…নারীসুলভ ঈর্ষা মাত্র। এমন সর্বগ্রাসী অথচ ছায়াময় স্নিগ্ধ রূপের প্রতি ঈর্ষার ছায়া থাকবে না, এটাও কিছুতেই হতে পারে না।
তবে কিছু বিস্ময়কর ব্যাপার-স্যাপার দেখছি ইদানিং।
আগে আমার বাসার পাশের রাস্তাটা বিকেলের দিকেই সাধারণত সরগরম হয়ে উঠতো। এখন প্রায় সারাদিনই রাস্তার পাশে একদল ছেলে ছোকরাকে বসে থাকতে দেখা যায়। নিচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে অথবা একখণ্ড ঘাসের ওপরে বসেই আড্ডা জ্মায় ছেলেপেলের দল।
বুঝতে অসুবিধা হয় না নজরটা তাক করা থাকে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটার দিকেই।
রিনাকে বলা হয়নি বিষয়টা। একদিন কথার সুরে বুঝলাম, ব্যাপারটা তারও নজর এড়ায়নি। গজগজ করতে করতে বললো, ‘দিব্বি নিরিবিলি শান্তিময় পরিবেশ ছিল। কী জানি কীসের খারাপ আছর পড়লো কে জানে!’ আমি হেসে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করি।
‘কী বলো এসব আজগুবি কথা! খারাপ আছর আবার কী?’ ‘কেন বুঝ না তুমি? আমার মোটেও ভালো লাগছে না এসব!’
আমি এবার একটু উষ্মা দেখালাম। ‘দেখো রিনা, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। কিছু কিছু মেয়েদেরকে ছেলেপেলেরা একটু বেশি জ্বালাতন করে। তাই বলে সেই মেয়েগুলোকে দোষারোপ করার তো কিছু নেই। একজনের দোষে আরেকজনকে তো আর সাজা দেওয়া যায় না!’
আমি ভয় পেয়েছিলাম, রিনা বুঝি কঠিন প্রতিবাদ করবে। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মোকাবেলার। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রিনা আশ্চর্য নরম গলায় বললো, ‘জানি না…কেন এমন বলছি। আমার ভালো লাগছে না কিছু। একটা কোন অমঙ্গল আছে মেয়েটার সাথে। হয়তো আমার মনেরই ভুল…তবু…। মন থেকে সরাতে পারছি না’।
ঠিক যেভাবে মৌমাছির চাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি এসে জড়ো হয়, আমাদের পাশের বাসাটা যেন সেইরকম একটা কিছু হয়েছে। এসব ভালো কিছু বয়ে আনে না তুমি দেখো।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘এই চিন্তা সেই মেয়েটির স্বামীকেই করতে দাও। তুমি আর চিন্তা করে মাথা নষ্ট করো না।’ রিনা ম্লান মুখে হাসলো। কিছু বললো না।
তিন
দেখতে দেখতে প্রায় দেড় বছর এইভাবেই কেটে গেল। ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমাদের দিনগুলো এগিয়ে চলেছে। আগের প্রতিবেশির সাথে যেভাবে আমে-দুধে মিশে যাওয়া গিয়েছিল, নতুন প্রতিবেশির সাথে তা আর হয়ে উঠলো না।
রিনার সাথে বহ্নি’র বন্ধুত্ব ঠিক জমলো না। টুকটাক কথাবার্তা যে একেবারেই হয় না তা নয়, তবে সেটাকে ঠিক ঘনিষ্ঠতা বলা চলে না। সম্পর্কে বেশ একটা স্পষ্ট সীমারেখা আছে বোঝা যায়।
ভদ্রলোকের সাথে আমারও ঠিক সেরকম সৌহার্দ্য গড়ে ওঠেনি। প্রথমে যতোটা মনে হয়েছিল, পরে বোঝা গেল তিনি তার চেয়েও অমিশুক আর অসামাজিক মানুষ। আমাদের সাথে মাখামাখি না হলেও তাদের বাসাতে কিন্তু লোক সমাগমের অভাব নেই। সারাদিন এতো লোক কোথা থেকে যে আসে কে জানে!
ভদ্রলোক সারাদিন বাসায় থাকেন না। তার অনুপস্থিতিতে এতো লোকজন কেন আসে ঐ বাসায়, বিষয়টা কেমন যেন ধোঁয়াশা। রিনার সন্দেহ একসময় আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়। আসলেই অশুভ কিছু ঘটছে না তো!
মাঝে মাঝে বেশ অনেক রাতে পাশের বাসা থেকে আওয়াজ ভেসে আসে। পাশাপাশি লাগোয়া ফ্ল্যাট। রাতের নিস্তব্ধতায় অনেক কিছু পরিষ্কার শোনা যায়। ভদ্রলোক হিসহিস করে কিছু একটা বলেন। মেয়েটার নিচু স্বরে কথা ভেসে আসে। অস্পষ্ট, কিন্তু বোঝা যায় কিছু একটা ঝামেলা চলছে তাদের ভেতরে।
রিনা আমার গা ধরে ঝাঁকানি দেয়।
‘শুনতে পাচ্ছো?’
আমিও তখন সেদিকেই কান পেতে আছি। ভদ্রলোক চাপা স্বরে ধমকাচ্ছেন, আর মেয়েটা অস্পষ্ট সুরে কাঁদছে। এটা কি কোন অপরাধীর কান্না? সন্দেহ তীব্রতর হয়।
মেয়েটি কি তবে দুশ্চরিত্রা? দ্বিচারিণী?
এমন অপার্থিব সৌন্দর্যের একজন নারী… সে কী না ভ্রষ্টা!
রিনার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। মেয়েদের কি তাহলে সত্যি সত্যিই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের চেয়েও বেশি কিছু …’সপ্তম ইন্দ্রিয়’ আছে? আমরা পুরুষেরা যা বুঝতে পারি না, মেয়েরা এক দেখাতেই তা বুঝে ফেলে?
বাসার পাশের রাস্তায় আড্ডাবাজি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। দিনরাতের আর বিরাম নেই। হৈ চৈ শোরগোল, জোরে জোরে গান…একেবারে নরক গুলজার!
বহ্নিকে আর তেমন একটা দেখিই না এখন। আগে বারান্দায় আসতো এটা সেটা করতে। এখন আর আসেই না বলতে গেলে। বারান্দার টবের গাছগুলো অবশ্য বেশ সজীব। কোন এক ফাঁকে এসে হয়তো পানি দিয়ে যায়। নিজের অজান্তেই আমার চোখজোড়া তাকে খোঁজে। মনকে মৃদু ভৎস্যনা করি। আবার প্রবোধও দিই এই বলে,
‘সৌন্দর্যকে শুধু চোখ ভরে দেখার অধিকারটুকুও কেন থাকবে না?’
একদিন বিকেলের দিকে বাসায় ফিরতেই দেখি, সামনের রাস্তাতে বেশ একটা জটলা। অনেক লোক একত্র হয়ে দাঁড়িয়ে সমস্বরে চেঁচামেচি করছে। বুকটা অজানা আশংকায় ধক করে উঠলো।
একটু সামনে এগুতেই দেখতে পেলাম, পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাসার সামনে। আমার মাথা কাজ করছিল না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম বাসার দিকে।
দরজার কাছেই রিনা দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ চোখ একেবারে পাংশুটে। পাশের বাসার দরজা খোলা, ভেতর থেকে লোকজনের শব্দ ভেসে আসছে। রিনা আমাকে দেখেই হাউমাউ করে ছুটে এলো, ‘পাশের বাসার ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছেন!’
‘কী? কখন?…’ আমার গলা দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। এ কী ভয়ানক কথা!
ভদ্রলোক সারাদিন বাসাতেই ছিলেন। কাজে যাননি। সারাদিন শোওয়ার ঘরের দরজা আটকে বসে ছিলেন। বহ্নির ডাকাডাকিতে কাজ হয়নি। দরজা খুলে বের হননি ভদ্রলোক। দুপুরে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করেও যখন দরজা খুলছিলেন না, তখন বহ্নি আমার স্ত্রী রিনাকে এসে ব্যাপারটা জানায়।
পরে অন্য বাসা থেকে লোকজন নিয়ে এসে দরজা ভেঙ্গে ফেলা হয়।
দরজা খোলার পরে দেখা যায়, ভদ্রলোক বিছানার চাদরে ফাঁস লাগিয়ে সিলিং এর ফ্যানের সাথে ঝুলছেন। পুলিশ এসে সিলিং থেকে লাশ নামিয়েছে। পুলিশের কয়েক দফার জেরাতে বহ্নি নাকি শুধু এটুকু জানিয়েছে, ‘তার স্বামী তাকে বিশ্বাস করতো না। সবসময় তাকে সন্দেহ করতো।’ পুলিশের জেরার হাত থেকে আমরাও রক্ষা পাইনি। নিকটতম প্রতিবেশি বলে কথা!
আমি চেপে যেতে চাইলেও আমার স্ত্রী পুলিশকে জানিয়েছে, তাদের বাসাতে সবসময়ই লোকজন আসা যাওয়া করতো। তবে কারা আসতো তা আমরা জানি না।
আস্তে আস্তে আরও অনেক কিছুই জানতে পারা যায়। বহ্নির স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে তার বাসাতে অনেকেই বেড়াতে আসতো। একটুখানি ছুতো খুঁজে নিয়ে দেখা করতে আসতো সবাই। লতায় পাতায় আত্মীয় পরিজন থেকে শুরু করে আশেপাশের বাসা থেকেও অনেকে আসতো বহ্নির সাথে আলাপ করতে। পরিচিত হতে। যারা খুব বেশি সাহসী হতে পারতো না, তারা আসতো বিকেলের পরে। বহ্নির স্বামীর উপস্থিতিতে।
তাদের সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলতো বহ্নি। ভদ্রতা বজায় রাখতে ভুল করতো না।
বলাই বাহুল্য এসব আগন্তুকদের প্রত্যেকেই পুরুষ। এই নিয়ে স্বামীর সাথে বহ্নির মতবিরোধ চলতো। স্বামী বিশ্বাস করতে পারতো না তাকে। ভাবতো, তার অগোচরে বহ্নি সবাইকে প্রশ্রয় দেয়। তার প্রশ্রয়ের সুযোগ নিতেই আসে সবাই।
পুলিশ আমাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে জেরা করেছে। এতো পুরুষের আগমন যে বাসায়, সেই বাসার পাশের পুরুষই যায়নি বহ্নির কাছে…এটা যেন গভীর সন্দেহের বিষয়। রিনাও কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাতে থাকে। আমি বাবা-মা, বউ সবার কসম খেয়ে বলেছি, ‘ও পথ আমি কখনোই মাড়াইনি!’
বহ্নি কি সত্যিই দ্বিচারিণী ছিল? নাকি পুরোটাই তার স্বামীর সন্দেহ আর কল্পনা মাত্র? আমার মন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগতো। মনে মনে হাসতাম। বহ্নির স্বামীই তাকে বিশ্বাস করতো না, আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে আর কী আসে যায়? রিনা কিন্তু তার মতামত থেকে কখনোই সরেনি। তার এক কথা, ‘ঐ মেয়ের মধ্যে কিছু একটা আছে…তুমি যাই বল!’
চার
সেই ঘটনার পরে কেটে গেছে প্রায় পনেরো বছর। আমার কর্মস্থল এখন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলায়। বেশ প্রত্যন্ত এলাকা বলা চলে। রিনাকে আমার সাথে আনতে পারিনি। সে আমাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্মদানের জন্য তার বাবার বাড়িতে আছে এখন। আমাদের প্রথম সন্তানও আছে তার কাছে।
এখনো মাঝে মাঝে আমার বহ্নিশিখার কথা মনে হয়। স্বামীর মৃত্যুর পরে বহ্নিশিখা সেই বাসা ছেড়ে অন্য কোথায় যেন চলে যায়। যাওয়ার আগে সে আমাদের কাছ থেকে মৌখিক বিদায়টুকু পর্যন্ত নেয়নি। বাসায় তালা মেরে চুপিসারেই সে চলে গিয়েছে।
দিনের পরে দিন বাসা তালাবদ্ধ দেখে আমরাই গিয়ে বাড়িওয়ালাকে খবরটা দিই। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বহ্নি তার স্বামীর বাসার সব জিনিস সেখানেই ফেলে গেছে। এমনকি তার নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র… শাড়ি কাপড় পর্যন্ত ফেলে রেখে গেছে।
এই কাণ্ড দেখে তো বাড়িওয়ালার মাথায় হাত। পরে পুলিশ এসে সব জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছে। হয়তো বহ্নির স্বামীর কোনো আত্মীয়ের কাছে সেগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা আর সে খবর জানতে পারিনি। আমাদের দিন যাপনের ছন্দেও কোন ছন্দপাত ঘটেনি।
এই প্রত্যন্ত এলাকাতে একা একা খুব মন খারাপ লাগে আমার। স্ত্রী সন্তানের কথা মনে পড়ে। তাদের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে সবসময়। টেলিফোনে কথা বলেও যেন সবকিছু বলা হয়ে ওঠে না। স্ত্রীর কাছে বিরহের দিনরাতের বর্ণনা দিয়ে লম্বা লম্বা চিঠি লিখি। আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী সেই গল্পের বই। গল্প উপন্যাস সব একেবারে ভেজে খেয়ে ফেলেছি এই কয়েক মাসেই। অবশ্য গল্প করার একজন সঙ্গীও পেয়ে গেছি এই অল্প সময়ে, রফিক সাহেব।
তিনিও চাকরি সুবাদেই এখানে পড়ে আছেন। আমার বেশ আগে থেকেই আছেন এখানে। কয়েক বছর হয়ে গেছে। তার সাথেই একটা বাসাতে শেয়ার করে থাকি। রফিক সাহেব অবশ্য বিপত্নীক। স্ত্রী মারা গেছে প্রায় সাত-আট বছর হলো। আর সংসারের জালে আটকাতে চাননি। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান।
তার কাছেই একদিন একটা গল্প শুনলাম। আমাদের বাসাটা থেকে কয়েক বাসা সামনেই নাকি এক ভদ্রলোক থাকতেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। ভদ্রলোক মাঝবয়েসী। স্ত্রী’র বয়স ত্রিশের কোঠায়। ভয়ানক মাথা খারাপ করিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দরী যাকে বলে।
অতি মিষ্টভাষী, অমায়িক…উদার। তার বাসাতে লেগে থাকতো অতিথি অভ্যাগতদের ভিড়। পরিচিতরা তো আসতোই, অপরিচিতরাও সেই বাসার দরজায় যখন তখন কড়া নাড়াতো। গল্প শুনতে শুনতে আমার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ টের পেলাম। কোনমতে সামলে নিয়ে বললাম,
‘কী হয়েছে সেই ভদ্রলোকের?’
রফিক সাহেব অবাক হলেন। জানতে চাইলেন,
‘আপনি জানেন নাকি?’
আমি নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললাম,
‘নাঃ, এমনি জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। তারপরে?’
‘আপনার জিজ্ঞাসা ঠিকই আছে। ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু সন্দেহও করতেন প্রচণ্ডরকম। এতো সুন্দরী বউ…তার ওপরে মধুমক্ষিকার মতো লোকজনের উৎপাত।’
সেই মূহুর্তে আমার রিনার দেওয়া সেই উপমাটি মনে পড়ে গেল। আমি উৎসুক মুখে তাকিয়ে থাকলাম রফিক সাহেবের দিকে… গল্পের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটুকু জানার জন্য।
‘সেই ভদ্রলোক আর নিতে পারছিলেন না। স্ত্রীকে ছাড়তেও পারছিলেন না, কারণ তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ তার কাছে নেই। আবার বিশ্বাসও করতে পারছিলেন না। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে না পেরে একদিন হুট করেই স্ত্রীকে বাসায় রেখেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন ভদ্রলোক। কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারে না।’
অবশেষে প্রশ্ন করলাম, ‘আর সেই ভদ্রমহিলা? তিনি কোথায় এখন?’ ‘স্বামীর অপেক্ষাতে একমাস থেকে তিনিও কোথায় যেন চলে গেছেন। তার খবরও কেউ জানে না।’ ‘অদ্ভূত!’ আমার মুখ দিয়ে আপনা-আপনিই বেরিয়ে এলো।
‘জি ভাই, আসলেই ভারী অদ্ভূত। কী কারণে যে এমনটা হলো কে জানে! ভদ্রমহিলা কিন্তু বেশ ভদ্রগোছের জানেন? তাকে দেখে অন্তত মনে হয় না, তার কোন চারিত্রিক সমস্যা আছে। অথচ…’
উত্তরটা যদিও জানাই আছে আমার, তবু জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
‘কী নাম সেই ভদ্রমহিলার?’
‘কী যেন…একটু আনকমন নাম। ব…ন…’
‘বহ্নিশিখা!’
রফিক সাহেব চমকে উঠে বললেন,
‘আরে ঠিকই তো বলেছেন। কীভাবে জানলেন আপনি? সব দেখি মিলে যাচ্ছে আপনার অনুমানের সাথে। হ্যাঁ, ওটাই নাম…বহ্নি!’
………………………………………………
রিনার কাছে চিঠি লিখতে গিয়ে একবার মনে হলো বহ্নি’র পুন আবির্ভাবের গল্পটা ওকে শোনাই। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। থাক!
ওর গলার জোর আরেকটু বেড়ে যাবে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আবার বলবে,
‘কী আমি বলেছিলাম না? ঐ মেয়ের মধ্যে কীসের যেন একটা অমঙ্গল আছে!’