বৈরী সংসারও যখন আটকাতে পারে না মেয়েটিকে – ৯

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

রাত গভীর হলে কেয়ার ঘুম আসে না।
দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফেরে পথে চলতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দেয়া, মনে গেঁথে যাওয়া কাঁটার মতো খচখচ করা কিছু সময়।

পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বাড়ি ফেরার পথে
এক রোদজ্বলা, পিচগলা গনগনে দুপুর –
সেই অপরিচিত মেয়েটির ঠিকভাবে না দেখতে পারা মুখখানা ভুলতে পারে না।
গাড়িঘোড়া, রিকশার বেলে অস্থির, দুঃসহ
যানজটে, যার চুলের মুঠি একহাতে চেপে সপাং সপাং পিটিয়েছিল ছ’ফুট উচ্চতার
টম ক্রুজ লুকের সানগ্লাসধারী এক যুবক।

যারা চেহারা দেখে প্রেমে পড়ে – তাদের চোখে নির্ঘাত সুদর্শন হিসেবে শতভাগ নম্বর পাবে এই ছেলে!
গরম পিচের উত্তাপ যেন স্যান্ডেল ফুঁড়ে পায়ের তলা স্পর্শ করছিলো সেদিন। ফুটপাথে ময়লা পানিতে ধোয়া শসা, তরমুজ আর ঘোলা ঘোলা নোংরা গ্লাসে লাল, হলুদ, সবুজ রঙের ভেজাল শরবত দেদারসে বিকোচ্ছে, শরবতওয়ালা গ্লাস তুলে দিতে দিতে বিজ্ঞের ভান ধরে শরবতের মহিমা বর্ণনায় মহাব্যস্ত। ভিড় জমানো ক্রেতাসকল ঘর্মাক্ত রিকশাচালক বা খেটেখাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। এই ঢাকা শহরে পয়সা দিয়ে ডাব কিনে খাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।

কেয়া দাঁড়িয়ে আছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। এসময় রিকশা পাওয়া মানে প্রাইজবন্ডের লটারি জেতার মতো ব্যাপার!

আচমকা কানে এলো অশ্রাব্য কতগুলো শব্দ –
হারামজাদী! দিনেদুপুরে বেশ্যামি করতে বেরোও!
জ্যামে আটকানো শত শত মানুষ দেখেছিল সেই দৃশ্য – কেউ উৎসুক চোখে, কেউ আতংকিত আবার কেউ বা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
মারতে মারতে মেয়েটির নীল ওড়নাটা হেঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিলো ছেলেটি।
অথচ মাত্র কিছুক্ষণ আগেই রিকশার হুড তুলে
প্রেমিক-প্রেমিকার বেশে দেখা গেছে তাদের!
জ্যামে বসে বারবার ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে ব্যতিব্যস্ত সুদর্শন প্রেমিকের হাত দেখেও না দেখার ভান করছিলো অনেকে। উপন্যাসের নায়িকাদের মতো মেয়েটির নীলাম্বরী সাজ জানান দিচ্ছিলো- আজ প্রিয়জনের সাথে দেখা হবার দিন।

কেয়া চিৎকার করতে চেষ্টা করেছিলো –
“খবরদার! দাঁড়ান, ছাড়েন ওকে। ”

ওড়নাটা শরবতের কাস্টমারদের পায়ের কাছে গড়াগড়ি যাচ্ছে।
হতভম্ব শরবতওয়ালা জিভ কেটে মাথা নাড়ে,
“হায়! হায়! উড়নাডি লন.. হাজার হউক মাইয়্যা মানুষ!”
দুই একজন তরুণ এগোতে গিয়েও পিছিয়ে যায় – “বেশ্যা” কথাটি তাদের পথরোধ করে বোধহয়!
টেনাহেঁচড়ার সময় একঝলক কেয়ার সাথে চোখাচোখি হয়েছিলো মেয়েটির। চোখে রাজ্যের মধ্যবিত্ত লজ্জা আর অপমানের গ্লানি নিয়ে বলেছিলো – “আমাকে বাঁচান! বিশ্বাস করেন, আমি ভদ্রঘরের মেয়ে”…

আর ওই যে মেয়েটি কনে সাজতে এসেছিলো স্যালুনে!
আচ্ছা! ও কী সেদিন সেই জঘন্য লোকটার সাথে কাজী অফিসে গিয়েছিলো? বিয়ে করতে পেরেছিলো লোকটাকে? বিয়ে হলেও মেনে নিতে পেরেছিলো?

“বউ সাজতে পার্লারে আসতে হয় ক্যান!!.. মাগী তুমি ছেনালি করো! পয়সা কী তোর গা বায়? ভদ্রঘরের মেয়েলোক পার্লারে আসে?? “..

একটি নামী বিউটি স্যালুনের কাস্টমার কেয়ারে কাজ করে কেয়া। লেয়ার কাট, স্টেপস, ব্যাংস, ফ্রিঞ্জ, ফেঞ্চ ম্যানিকিউর, এ্যালোভেরা ফেসিয়াল, হেয়ার স্পা আর ফেয়ার পলিশের দীর্ঘ কিউতে হঠাৎই ইতস্তত একটি মুখ। সাদামাটা সাজপোশাক, প্রসাধনী ছাড়াই কী মিষ্টি মুখখানি!

: আপু বউ সাজতে কত লাগবে?”

চোখ ধাঁধানো নানান দামের ব্রাইডাল প্যাকেজ দেখে আরো চুপসে যায় মেয়েটি।

কেয়ার ঝটপট প্রশ্ন, “কবের জন্য বুকিং দেবেন ম্যাম? যেকোনো ফ্রাই ডে’র জন্য মিনিমাম সিক্স উইকস আগে বুকিং নেই আমরা। ”

: আসলে.. আমি এখনই সাজতে চাচ্ছিলাম! একটু পরেই আমার বিয়ে। দুই হাজার টাকার মধ্যে শাড়ী পরা, খোঁপা আর হাল্কা মেকআপ হবে না?
কেয়া বুঝলো, ব্রাইডাল প্যাকেজ – ট্যাকেজের ধারে কাছেও এ মেয়ের বাজেট নেই। তাই, মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে, আঠারো’শ টাকায় সবচেয়ে কমদামী লাইট পার্টি মেকআপের প্যাকেজের একটা স্লিপ ধরিয়ে নেক্সট সার্ভিসে
চলে যায়।

ঘন্টাখানেক পর লাঞ্চ আওয়ারে ভিড় কমে এলে, ফ্রন্ট ডেস্কে বসেই বাড়ি থেকে আনা টিফিন বাটি খুলে খেতে শুরু করে। খিদে পেটে ঠাণ্ডা চিটচিটে নুডলসও খারাপ লাগে না। খেতে খেতেই চোখ পড়লো, সেই মেয়েটি সার্ভিস নেয়া শেষ হলেও সামনের সোফায় বসে অপেক্ষা করছে কারো জন্য। ভিড়ের মধ্যে ভুলেই ওর কথা গিয়েছিলো কেয়া।

বউ সেজে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। কেয়ার মনে হলো, নিশ্চয়ই প্রেমের বিয়ে হবে। বাড়ির মত নেই। বিশ/ একুশ বছর বয়স হবে মেয়েটির। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা! বারবার ফোন আসছে। কাকে যেন জানাতে শুনলো লালমাটিয়া কাজী অফিসে বিয়ে হবে।

মেয়েটির ফোনালাপে কেয়ার ভাবনায় ছেদ পড়লো –
“আমি মিমি’স এ অপেক্ষা করছি। তুমি ওপরে চলে এসো, আমি সামনেই আছি।..তুমি রাগ করছো কেন? এই দিনটা কী বারবার আসবে বলো? বিশ্বাস কর, আমার জমানো টাকা ছিলো.. বেশি খরচ লাগেনি”… মেয়েটির চেহারায় অপমানিত ভাব আর টেনশন ফুটে ওঠে।

কথোপকথন শুনে মনে হচ্ছে ওর স্যালুনে এসে সাজার ব্যাপারে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে রাগারাগি করছে কেউ।
কেয়ার কেমন যেন খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্য।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাঁচের দরজা ঠেলে ঝড়ের বেগে এক দীর্ঘকায় তরুণ অতর্কিতে ঢুকে পড়লো ভেতরে। নিরাপত্তা প্রহরীকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে!
“এক্সকিউজ মি, আপনি আমার সাথে কথা বলুন প্লিজ”- কেয়া তাকে থামাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে সদ্য কনে সাজা মেয়েটিকে। সেই সাথে চলতে থাকে কিলঘুষি আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। মেয়েটির সাধের ফ্রেঞ্চ বান খুলে গেল।
সেই মেয়েটিও কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছিলো – “আপু, আমি খারাপ মেয়ে না.. আজকে আমাদের বিয়ে। ”
এই কী ভালোবাসার নমুুনা!
এ কোনো প্রেমিকের রূপ হতে পারে!

স্যালুনে কাজ করেই বয়স্ক বাবা – মাকে দেখভাল করে কেয়া। তবু আত্মীয়স্বজনকে বাবা বলতে লজ্জা পান যে, মেয়ে কী চাকরি করে! অফিস ইউনিফর্ম পরে বাড়ি ফেরা নিষেধ। পাছে প্রতিবেশীরা জানতে পারে! মেয়ের বিয়ে ভেঙে যায়!

বিউটি স্যালুনে চাকরি করার অপরাধে ইমনের সাথে কেয়ার সাত বছরের সম্পর্কটা বিয়েতে গড়ানোর আগমুহূর্তে এসে ভেঙে যায়। সাহস করে সেদিন বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো কেয়া নিজেই।
এখানে নাকি ভদ্রলোকের মেয়েরা কাজ করে না, তাই বাড়ির বউ পার্লারে কাজ করে, ইমনের পরিবার তা মেনে নেবে না। বিয়ে ভাঙার আগে ইমনও একই কথা বলেছিলো – “বিয়ে করতে হলে পার্লার ফার্লার ছাড়ো। বউ হবা, না বেশ্যা হবা তোমার সিদ্ধান্ত।”
এই কথার পরে আর যে পারে পারুক কেয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া।

এই তো সেদিন ডিভোর্স হয়ে গেল কেয়ার বন্ধু নাজিয়ারও। নাজিয়া পেশায় একজন বিমানবালা। প্রকৌশলী হাজব্যান্ডের পক্ষে বিমানবালার সাথে সংসার করা সম্ভব না! অথচ ওদের বিয়ে হয়েছিলো তিনবছর ধরে একে অন্যকে চেনা জানার পর। বিয়ের পর থেকেই আসিফ আর তার পরিবার থেকে চাকরি ছেড়ে দেবার জন্য চাপ আসতে থাকে। আড়াই বছরের সংসারজীবনে নাজিয়াকে উঠতে বসতে

আসিফের মিথ্যে সন্দেহের শিকার হতে হয়। ফ্লাইট থেকে ফিরলে আসিফ বলতো,”বেশ্যাগিরি” করে বাড়ি আসিস! শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পারিবারিক অনুষ্ঠানে টিপ্পনী কেটে বলতো, “বিমানবালা” মানে নাকি প্লেনযাত্রীদের বুয়া! পাইলটের রক্ষিতা!

মনে পড়ে কেয়াদের বাড়ির দারোয়ানের বউ মিনুর কথা। সংসারে রোজগার বাড়াতে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিলো মিনু। দারোয়ান বলে স্বামীত্ব কিছু কম তো না! সেই স্বামীর সংসার টিকিয়ে রাখতে গার্মেন্টসের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় মিনু। কারণ ‘ঘরের বউ গার্মেন্টসে গেলে চরিত্র নষ্ট হবে!’ তাই ‘স্বামীর ভাত খেতে গেলে বেশ্যামি ছাড়তে হবে!’

এই ভালো মেয়ে আর মন্দ মেয়ে পরিমাপের এককটা আসলে কী?
বেশ্যা কাকে বলে? নারীকে কোণঠাসা করতে যুগযুগ ধরে কেন গালি হিসেবে মোক্ষম এই শব্দটি বেছে নেয়া। “বেশ্যা” কী আদৌ কোনো গালি হতে পারে? বেশ্যাকেও কী বেশ্যা বলে গালি দেবার অধিকার কারো জন্মায়?
কীসের ভিত্তিতে যখন খুশি বেশ্যা বলে গালি দেবার লাইসেন্স নিয়ে রেখেছে এই সমাজের পুরুষেরা?

কত সহজেই প্রেমিকা, জীবনসঙ্গী বা হুট করে অচেনা – অদেখা কোনো মেয়েকে বেশ্যা বানিয়ে দিতে পারে পুরুষেরা! অসম্মান করতে পারে তাদের পেশাকে, ব্যক্তিত্বকে!

রাত গভীর হয়। কেয়ার ঘুমানো দরকার।
সকালে অফিসে যেতে হবে। এই অসুস্থ পারিপার্শ্বিকতা পায়ে ঠেলে চাকরি তাকে করতে হবে। বেশ্যার তকমা গায়ে লাগার ভয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। বাবার ওষুধ কেনা দরকার। মায়ের ডাক্তার দেখাতে হবে। অফিস থেকে ফেরার পথে বাজারটাও করতে হবে।অনেক কাজ পড়ে আছে কালকের জন্য।
এই কাজটুকু করে বলেই কারো বাবা – মা – ভাইয়ের মধ্যবিত্ত সংসারে সেও খানিকটা হাল ধরতে পারে। নিজের কাজকে সে ভালোবাসে।

এই কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই এখন একটু আধটু স্বপ্ন দেখতে সাহস করে নিজের একটি বিউটি স্যালুন খুলবে। ইমনকে ফিরিয়ে দেবার জন্য কেয়ার কোনো অনুতাপ হয় না।
পেছনে ফিরে তাকানোর সময় তার নেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.