মেয়েরা, তোমরা একা না, জানো তো?

সাদিয়া রহমান:

২০১৩ সাল, প্রথম বর্ষে তখন। চোখ, দুনিয়া সব রঙিন। বড় ভাইবোন, সমবয়সী মিলে বিশাল দলবল জুটে গেলো; একসাথে থাকি, আড্ডা দেই, ঘুরে বেড়াই। দুপুরের খাবারটাও ক্যাম্পাসে সবার সাথে খাওয়া হয়।

সময়ের প্রভাবশালী নেতা, তার আমাকে ভালো লেগে গেলো। দলবল নিয়ে খাচ্ছি সেরকম এক দুপুরে ফুল চকোলেট আর বিশাল দল নিয়ে হাজির। তার উপহার আমার গ্রহণ করতে হবে। বয়স কম, বুদ্ধি কম, রক্ত গরম। জানিয়ে দিলাম নিবো না। তারপর একটা দৃশ্য।

সেদিন ওইরকম রঙিন চোখে হঠাৎই আমার ভাটা পড়তে শুরু করেছিলো। না, ঘটনা অতীতেও বহু দেখেছি। চলতে পথে ছোঁয়াছুঁয়ি অথবা কারো উপস্থিতিতে অস্বস্তি আগেও জেনেছি। বড় পরিসরে প্রজেকশন সেটাই প্রথম। সেইদিনের সেই ঘটনাতে যারা ক্ষমতাধর ছিলো, তাদের আচরণের চেয়ে আমার চোখে কষ্টের ছিলো আমার সাথের মানুষগুলোর নীরবতা। যে দুইজন কথা বলেছিলেন তাদের আমি পরম শ্রদ্ধায় মনে রেখেছি। আমি মনে রেখেছি সেইসব প্রগতিশীল তাদের যাদের সাথে আমি সবসময় থাকতাম তবু ওই সময় কেউ আমার দিকে তাকায় নি। আমি মনে রেখেছি তাদের যারা এক মুহুর্তে আমার সাথে পরিচয় অস্বীকার করেছিলো। না আমার রাগ নাই কিন্তু অভিজ্ঞতাটা আছে, সেটা চিরস্থায়ী।

সেইদিন থেকে শুরু সামনের জনের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তাটা। এই ঘটনা, তারপর আরো কত ঘটনা, এক এক করে ঘটে গেছে, আমি ভেবেছি, আমার চোখের সামনে যদি কখনো কোনো মেয়েকে এই অবস্থার মধ্যে দেখি আমি চাইবো সে যেনো আমার মতন একা না হয়।

দিনে দিনে বছর গড়িয়েছে। নিত্যনতুন মানুষ চিনেছি। সবচেয়ে ভালো ভাবে বুঝেছি, উপলব্ধি করেছি মেয়ে হিসেবে সমাজে চলার অর্থ।

অনেকেই বলে নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতন বা যৌন সহিংসতা বন্ধ করলেই দায়িত্ব শেষ। আর কোথাও কোনো সমস্যা নাই। অবাক হয়ে ভাবি, এই বিশাল অংশের মানুষের “মন” নামক ব্যাপারটার সাথে কোনো পরিচয় নাই। অনেকে আবার বাসে ইঞ্জিনের গরমের ওপর ছয়টা আসন পেতে দিয়ে মেয়েদের ‘সুবিধাভোগী’ বলে মনে করেন। আশ্চর্য লাগে এটা ভেবে “সাম্য” বা “ন্যায্যতা” কোনোটিই তাদের মস্তিষ্কের অভিধানে নাই।

আমি জানতাম,আমি নিশ্চিত জানতাম নিত্যদিনের এইসব অভিজ্ঞতা, এইসব খারাপ লাগা, এইসব কষ্ট, এগুলো আমার একার না। আমি জানতাম অসংখ্য মেয়ে এসব ধারণ করে ক্ষোভ নিয়ে ঘুরছে, কান্না চেপে ঘুরছে আবার অনেকে নানান অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে কারো মুখের দিকে বা লুকানো কান্নার দিকে তাকিয়ে মনে হত তাকে বলেই দিই তুমি একা না।

অনলাইন পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টার আমাকে সেই জায়গাটাই দিয়েছে। আমাকে একটা মঞ্চ দিয়েছে, তা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কত বড় জানি না। কিন্তু এটার মাধ্যমে আমি জানতে পাই, আমি একা না। আমি জানাতে পারি, মেয়ে তুমি একা না। আমি এর মধ্য দিয়ে গেছি আমি জানি কেমন লাগে।

আজ পোর্টালটির পঞ্চম বছর পূর্তি হলো। বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এই প্লাটফর্ম দিয়েই যতজনকে সম্ভব আবার বলতে চাই, আমি খুব ক্ষুদ্র একটা মানুষ। ক্ষুদ্রতা দিয়েই আমার স্বল্প সামর্থ্যের মাঝে যেটুকু কুলায়, আমি সবটা দিয়েই চেষ্টা করে যাবো যেভাবে আমি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি তা আর কেউ যেন না হয়।

গভীর রাতে প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে হাউমাউ করে কান্নার সময় মেয়েটা মনে রাখুক সে একা না। অনেকেই ওইরকম মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে নির্ঘুম বসে আছে, আমরা সবাই সবার শক্তি। প্রতিবাদ করতে সংশয় হলে সে জানুক বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা সবাই গলা মিলাবো। সে একা না। আমরা আছি। আমরা সবাই আছি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.