উইমেন চ্যাপ্টারের লেখক-পাঠকদের অভিনন্দন

সুপ্রীতি ধর:

আজ ২০ মে, নারীবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টারের পঞ্চম বার্ষিকী। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের নারীবিরোধী দাবি-দাওয়া উত্থাপনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল পোর্টালটির।

একদিকে শাহবাগ আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সমস্ত বাঙালী যখন ফুঁসছে, ঠিক তখনই সেই আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে হেফাজতে ইসলামের উত্থান। ঢাকাসহ দেশব্যাপী তাদের তাণ্ডব, মৌলবাদীদের প্রতি সরকারের নতজানু নীতি নারী হিসেবে আমাদের অবস্থানকে তখন প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। আমাদের শতবর্ষীয় নারী আন্দোলন যেন হঠাৎ করেই হোঁচট খায় পুরো প্রক্রিয়ায়। তাহলে কীসের জন্য আমরা এতোদিন আন্দোলন করছি? যদি নারীকেই ঘরে ফেরত পাঠানোর পাঁয়তারা চালায় একপক্ষ, এবং তারা সেটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতেও কুণ্ঠিত হয় না, তখন স্বভাবতই আমাদের অবস্থানকে নতুন করে দেখার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

যখন নারী অধিকার আদায়ে আন্দোলনরত সংগঠনগুলো বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলামের দাবির বিরোধিতা করে, তখন এর পাশাপাশি মেয়েদের লেখালেখির জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম খুব জরুরি মনে হয়েছিল বলেই এই পোর্টালটির সূচনা হয়। নারী অধিকার, নারীবাদ, নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য প্রতিরোধে পোর্টালটি ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় অনলাইন পাঠক এবং লেখকদের মাঝে। খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে আটপৌরে নারীদের কাছে, যারা কোথাও তাদের কথাগুলো বলতে পারতো না, অথচ বলতে চাইতো।

লেখকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত লেখকরা ছাড়াও এমন অনেকে ছিলেন, যারা কোথাও লিখতো না, মানে অন্য বিদ্যমান পোর্টালগুলো যখন নারী লেখকদের লেখা ছাপাতে অনীহা প্রকাশ করতো, তখন উইমেন চ্যাপ্টার তাদের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল।

কালে কালে অনেক লেখক এসেছে, অনেকে চলে গেছে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। পুরনোরা চলে গেলে নতুনরা সেখানে জায়গা করে নেয়। উইমেন চ্যাপ্টারও নতুন নতুন লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ হয় প্রতিনিয়ত। হতে পারে অনেক অ্যামেচার লেখক এখানে লেখে। লিখতে লিখতেই না লেখক হবে, আমি তা বিশ্বাস করি। এবং হয়েছেও অনেকে।

যেহেতু ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠী নারীর সমঅধিকারের বিরোধী, তাই এর সম্পাদক এবং লেখকদের ওপর নানারকম হুমকিও এসেছে বিভিন্ন সময়ে। সবশেষে সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলাও হয়েছে। তাতে কাজের কোনো হেরফের তো হয়নি। আমরা আরও বলিষ্ঠ হয়েছি।

এসবকিছু সত্ত্বেও উইমেন চ্যাপ্টারের পথচলা রোধ হয়নি। বরং নিত্যনতুন উপলক্ষ জড়ো হচ্ছে পোর্টালটির ঝুড়িতে। এরই মাঝে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আলাদা করে ইংরেজিতে পোর্টালটি যাত্রা শুরু করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এরই মধ্যে ইংলিশ চ্যাপ্টারের সাথে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে, অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার উইমেন চ্যাপ্টারের বিভিন্ন লেখা আর্কাইভ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাছাড়া যাত্রা শুরুর এক বছরের মাথায় উইমেন চ্যাপ্টার অনলাইন পোর্টাল হিসেবে পাঠকদের ভোটে জার্মানির ডয়চে ভেলের বিখ্যাত দ্য ববস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও ছিনিয়ে এনেছিল অন্য দেশগুলোর সাথে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে। আজকের দিনে স্মরণ করছি সেইসব সতীর্থকে, যারা এই অনলাইন ভোটে উইমেন চ্যাপ্টারকে জয়ী হতে প্রাণপণ চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন। পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন পাঠকদের কাছে। মূলত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই জয়ের পরপরই।

এসবই উইমেন চ্যাপ্টারের সাফল্য। আর এই সাফল্য এসেছে পাঠক এবং লেখকদের কারণেই। সবার ভালবাসার মধ্য দিয়েই। এভাবেই এগিয়ে যাবে আরও বৃহৎ কোনো কল্যাণের লক্ষ্যে।

আজ বর্ষপূর্তিতে উইমেন চ্যাপ্টার সকল লেখককে স্মরণ করছে ভালবাসায়। যারা ছিল একসময় উইমেন চ্যাপ্টারের সাথে, এখন নেই, তাদেরও স্মরণ করছি একজন অপরিপক্ক সম্পাদক হিসেবে। কালের যাত্রায় উইমেন চ্যাপ্টার থাকবে কী থাকবে না, তার চেয়েও বড় কথা হলো, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসের কারণেই পোর্টালটি আজ ইতিহাস হতে পেরেছে। তাই যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো নানা কারণে, তাদের প্রতি, এবং যারা কোনো অবস্থাতেই পোর্টালটির হাত ছাড়োনি, তাদের সকলের প্রতি আজকের দিনের বিশেষ অভিনন্দন।

লেখক এবং পাঠকদের বলছি, অনেক সীমাবদ্ধতা আছে পোর্টালটির, সম্পাদক হিসেবে আমার তো রয়েছেই, সবাই সেগুলোকে ক্ষমার চোখে দেখবে, ভালবাসবে পোর্টালটিকে এবং সেইসাথে আমাকেও। এই পোর্টাল হোক সবার ঘরের ‘মানুষ’। আর সব সত্ত্বেও চলো আরও কিছু বছর আমরা হাত ধরে হেঁটে যাই নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে! দেখিই না, কতোদূর যাওয়া যায়!

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, উইমেন চ্যাপ্টার যতোটা না অনলাইন পত্রিকা, তার চেয়েও বেশি একটি আন্দোলন। এটি একটি আন্দোলনের নাম হিসেবে এরই মধ্যে নাম লিখিয়েছে, কেউ স্বীকার করুক বা নাই করুক। তো, সেই আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার।

সবাইকে অনেক অনেক ভালবাসা আজকের এবং আগামী দিনগুলোতে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.