ফারজানা আকসা জহুরা:
বাবারা ভালো কাপড় পরেন না, দিন রাত পরিশ্রম করেন, দেরি করে ঘরে ফিরেন, সন্তানের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না, সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে আরও কত কী যে করেন! অথচ একটু কষ্ট করে স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারেন না! পারেন না সন্তানের মায়ের কষ্টগুলি ভাগ করে নিতে!
যে বাবা প্রাণ উজাড় করে সন্তানকে এতো এতো ভালোবাসতে পারেন, সেই বাবা বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা সন্তানের মাকে দিতে পারেন না!
ভালো বাবারা সন্তানদের জন্য এতো এতো ত্যাগ করেন, অথচ আরেকটু ত্যাগ স্বীকার করে গর্ভবতী স্ত্রীর যত্ন নিতে পারেন না! পারেন না এই সময়ে স্ত্রীর কাছ থেকে চাওয়া আরাম আয়েশ ত্যাগ করতে!
অনেক স্ত্রী ছিলেন যারা স্বামীর কথায় আর কর্মে অতিষ্ঠ হয়ে গায়ে আগুন দিয়েছেন, কিংবা আত্মহত্যা করেছেন, অথচ এই স্বামী আজও সমাজের কাছে ভালো বাবা! সন্তানও তার বাবার প্রেমে অন্ধ! অথচ এই ভালো বাবাই কিন্তু তার মায়ের হত্যাকারী!
অনেক স্ত্রী দুশ্চরিত্র স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সন্তান ফেলে পালিয়ে গেছেন, অথচ এই চরিত্রহীন বাবাই এখন সন্তানের কাছে সমাজের কাছে মহান! অথচ এই বাবাই কিন্তু নিজ সন্তানের কাছ থেকে তাদের গর্ভধারিণী মাকে কেড়ে নিয়েছেন।
স্বামীর দুর্ব্যবহার আর অত্যাচারে কত যে স্ত্রীরির গর্ভপাত হয়ে গেছে , তার কিন্তু কোনো হিসাব নেই । এইসব গর্ভের ভ্রুণ হত্যাকারী কিন্তু তাদের বাবারাই !
আবার গর্ভকালীন অবস্থায় স্বামীর অযত্ন আর অবহেলার কারণে, যেসব নারী মাত্রাধিক ডিপ্রেশনে ভুগেছেন, তাদের
অনেক সন্তানই আজ মানসিকভাবে নানা ধরনের সংকটে ভূগছে।
অনেক সময় সন্তান জন্মদানের পরে নারীর শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন কখনও কখনও মেনে নিতে পারেন না ভালো বাবারা। যার পরিণাম হয়েছে ছাড়াছাড়ি। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নারীর যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে, কয়জন ভালো বাবা পেরেছেন তা ভালো মন নিয়ে গ্রহণ করতে? ইদানিং এই খবরগুলো বেশি করে আসে যে, মায়ের হাতে সন্তান খুন। খবরগুলো পর্যালোচনায় মায়ের মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি উঠে আসে, সন্তান জন্মদান পরবর্তী মানসিক হতাশাগ্রস্ততাকে এর জন্য দায়ী করা হয়। ওই সময়টাতে ওই ভালো বাবারা সন্তানের মায়ের পাশে থাকেন না আদর, সহানুভূতি আর ভালবাসা, পরিচর্যা নিয়ে। থাকলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতো না সমাজে।
সন্তানকে দুধ খাওয়ান আর সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে মায়ের যখন দিনে দিনে অসুন্দর আর রুপ লাবণ্যহীন হয়ে পড়েন, যখন দিনের পর দিন তাদের টান টান শরীরে দাগ পড়ে, তখন কি পেরেছেন কোনো ভালো বাবা তাদের এই অসুন্দরী স্ত্রীকে ঠিক আগের মতন ভালোবাসতে?
অনেক ভালো বাবা আছেন যারা সন্তানের মায়ের বয়স হয়েছে দেখে তাকে রেখে আরেকটা প্রেম করেছেন। আবার কখনও দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, আজ সেই স্বার্থপর মানুষটিও কিন্তু সমাজে মহান বাবা হয়ে থেকেছেন।
সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে যে বাবারা টাকা জমায়, সেই বাবাই কিন্তু মায়েদের হাতে সন্তানের জন্য, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য দুইটা টাকাও তুলে দিতে পারেন না। যদিও মা তার সন্তানের জন্য হাজার টাকার চাকরি আর আয় রোজগার বিসর্জন দিয়ে বিনা পয়সার আয়া-বুয়া হয়ে যান। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গিয়ে মা পারেন না নিজের সম্পদ-সম্পত্তি গড়ে তুলতে। অথচ মায়েদের ত্যাগে যে সন্তানরা বেড়ে ওঠে, সেই সন্তানদের কাছে বাবারা হলো সুপার হিরো। প্রেরণার উৎস!
আমি কিন্তু কোনো খারাপ বাবাদের কথা বলছি না। আমি বলছি আমাদের ভালো বাবাদের কথা। যে বাবারা সমাজের কাছে, সন্তানের কাছে অনেক অনেক ভালো। অথচ কোনো এক অজানা কারণে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের স্ত্রীদের মূল্যায়ন করতে পারেননি। তাদের কাজকে, সন্তান লালন পালনে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে পারেননি।
বাবারা সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন, সন্তানকে সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু যে সন্তান নিয়ে বাবাদের বাবা হয়ে ওঠা, সেই সন্তানের জন্মদাত্রী মাকে কষ্ট দিয়ে কী ভালো বাবা হওয়া যায়?