ক্ষুধা

সাদিয়া সুলতানা:
১.
রূপার পাশ ঘেঁষে আদুরি কুণ্ডলি পাঁকিয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা দিন রাত বস্তির পোলাপানের সাথে ঘোরে। প্যাঁক-কাদা ছানে। সাথে থাকে আদুরি। কুকুরটা ছিল রূপার বাপের। এখন মেয়ের নেওটা হয়েছে। সারাদিনে মেয়েটার পিছু ছাড়ে না। রাতেও মাথার কাছে শুয়ে থাকে। রূপার মতোই হাড় জিরজিরে শরীর। এর ভেতরে আবার বাচ্চা বিয়োবে। হঠাৎ আনুর খুব ঘেন্না লাগে। দিনরাত আগাড়ে-বাগাড়ে ঘোরা কুকুর। পায়ে নোংরা কাদা। শরীরের এখানে সেখানে কাদা শুকিয়ে আছে। রূপার গা ঘেঁষে শুয়েছে। মেয়েটার না কোনো অসুখ-বিসুখ হয়!

আনু উঠে বসে। নাহ্ এটাকে এখনই বাইরে বের করে দেবে। আর ঘরে ঢুকতে দেবে না। বাইরে ঘোরে ঘুরুক। কাল থেকে ঘরে আনলে রূপারও খবর আছে। কাছে যেয়ে আনু কুকুরটার গায়ে লাথি মারতে গিয়েও মারে না। মোমের আলোয় আদুরিকে অবিকল গর্ভবতী নারীর মতোন দেখায়। হয়তো নিজের শরীরের সাথে সাদৃশ্য দেখে আনুর ভেতরটা আর্দ্র হয়ে ওঠে।
পা টিপে টিপে আনু নিঃশব্দে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। মেয়েটার মুখ আবছা অন্ধকারে মোমের আলোর মতো কোমল লাগে। আনু হাত বাড়িয়ে দেখে রূপার শরীর ভেজা কি না। এতো বড় ধাড়ি মেয়ে এখনো রাতে বিছানায় পেচ্ছাব করে। মাঝরাতে টের পেলে আনু পিঠে দমাদম লাগায়। কাল রাতে ঝুম বৃষ্টির পর পরই হঠাৎ কেমন একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা পড়েছিল। মাঝরাতে আনুর ঘুম একটু আলগা হতেই রূপার ভিজে গায়ে হাত চলে গিয়েছিল। এরপর আর কোনদিকে তাকায়নি। চুলের গোছা ধরে পিঠে এক নাগাড়ে চড় মেরেছে। অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শেষ রাতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছিল। আনুর বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। রূপার বাপ বলতো, মাইয়ার নাম রাখছি রূপা, তয় বিয়ার সময় আমার মায়েরে সোনা দিয়া মোড়ায় দিব। সোনা! রূপা! পেটে এক মুঠো ভাতই জোটে না!
রূপার মাথার নিচে বালিশটা টেনে দেয় আনু।

মেয়েটা একেবারে ঘুমে কাদা। খালি গায়ে শুয়েছে। রূপার রোগা শরীরের দিকে আনু ভালো করে তাকায়। দু’পায়ের মাঝে কাঁথাটাকে চেপে ধরে ডান দিকে কাত হয়ে শুয়েছে। রাতের বেলা উদোম শরীরেই শোয় রূপা। এই ঘুপচি ঘরে খোলা হাওয়া খেলে না। আর ঘরে ওরা মানুষই দু’জন। রূপার খোলা পিঠে আলতো করে হাত বুলাতে থাকে আনু। আহা এতোটুকু মেয়ের সারাদিন কতো ধকল যায়! সারাদিন ছুটে ছুটে এটা সেটা কত ঘরের কাজ করে।

মেয়েটার শরীরে এখনো নারীর শরীরের আভাস লাগেনি। কত আর বয়স রূপার! সামনের বৈশাখে সাত পুরো হবে। যেদিন রূপার জন্ম হলো, সেই দিনটির কথা আনুর স্পষ্ট মনে আছে। সারা পৃথিবীতে তখন ঝড়ের মাতম। রাতের উথালপাথাল অন্ধকারে ঘরে ওরা দু’টি মানুষ ভেজা পাখির মতো কাঁপছিল। রূপার বাপ সাহস দেবে কী, তার নিজের কান্নায় ঝড়ের হুংকারও চাপা পড়ে যাচ্ছিল।

এক সময় চারপাশ স্তব্ধ করে ঝড় থেমে গেল। বাইরে দেখে তখন কে বুঝবে এই ঝড়ে আনুদের বস্তির গোটা দশেক ঘর ভেঙেছে। ঝড় থামবার পর আচমকা চারপাশের নীরবতা ভেদ করে মেয়ের কান্না শোনা গেল। কচি কচি হাত-পা ছুঁড়ে সে যখন তার আগমন বার্তা পৃথিবীকে জানাচ্ছে, তখন রূপার বাপের দ্বিতীয় দফা কান্না শুরু হয়েছিল। প্রথম সন্তান জন্ম নেবার পর পরই রূপার বাপ গৃহবন্দী হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত মেয়েকে কোলে কোলে রাখতো। নিজেই গোসল করাতো। কাজ-কামের ভাবনা যেন নেই। পরে আনুর দাবড়ানি খেয়ে কাজে বের হতো। আনুর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সেই আদুরে মেয়ে এখন তিন বেলা ভাত পায় না। সারাদিনে যা খাওয়া জোটে তাতে মেয়েটার শরীর বাড়-বাড়ন্ত হয় কেমন করে! হঠাৎ আনুর ভাবনাটা বিপরীতমুখী হয়ে যায়। মাইয়্যা দেরিতে ডাংগর হইলেই ভালা। নইলে চিল শকুনে ঠোক্কর মারবো। তখন কে দেখবো বাপ-মরা মাইয়্যাটারে।

এবার নিজের শরীরের দিকে তাকায় আনু। শরীরের মধ্যভাগের উঁচু পেটটাকে ওর পাহাড়ের মতো লাগে। শরীরের বাড়তি অংশের দিকে তাকিয়ে ওর ছাড়া ছাড়া ভাবনাগুলো দুশ্চিন্তায় গাঢ় হয়। আর বেশি দেরি নেই। আরও একটা মুখ বাড়বে। হারামিটা মইরা যাওনের আগে আরেকটা বিছুন দিয়া গ্যাছে।

মুখ দিয়ে গাল বেরিয়ে আসার সাথে সাথে আনু কুঁকড়ে যায়। এমন কোন খারাপ মানুষ ছিল না রূপার বাপ। তবে মানুষটার একটাই দোষ ছিল, রাত-বিরাতে স্বপ্ন দেখতো। রাতে বাড়ি ফিরে এক থালা ভাত পেটে পড়তেই মানুষটার মুখ দিয়ে রাজ্যের মিষ্টি কথা বের হতো। আনুর উচুঁ হতে থাকা পেটে হাত রেখে আপন মনে কত কথা যে বলতো! কখনো কখনো উপুড় হয়ে ওর খোলা পেটে চুমো খেতো। কান পেতে কান্নার শব্দ শোনার চেষ্টা করতো। বলতো, এইবার পোলা হইবো… আমি হের কান্নার শব্দ পাই। আনু তখন লজ্জায় মরে যেত। লোকটার এতো শখ পোলাপানের। বছর তিনেক আগে আনুর পাঁচমাস বয়সী ছেলেটা যেদিন শ্বাসের টান উঠে মারা গেল, সেদিন রূপার বাপের কী কান্না! মানুষটার দাপাদাপি দেখে সারা বস্তির মানুষের চোখে পানি এসেছিল।

অথচ যেদিন রূপার বাপ ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মরলো, সেদিন আনুর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও বের হয়নি। বস্তির মানুষজন ধরাধরি করে রিকশাওয়ালা জমিরের থ্যাঁতলানো শরীরটা যখন আনুদের ঘরের সামনে রাখছিল, তখন আনুর শুধু বেহায়ার মতো মনে পড়ছিল, আজ মহাজনের কাছে টাকা চাওয়ার কথা ছিল, টাকাটা পাওয়া গেল না। আনুরা তো আর বড়লোকের বউদের মতো ক্লিনিকে ভর্তি হতে পারবে না। তবু এটা সেটা খরচ কুলানোর জন্য রূপার বাপ অগ্রিম চাইতে গিয়েছিল। রূপা যখন বাপের লাশ জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল, তখন আনুর মনে হচ্ছিল, মেয়েটার পেটে দেবার মতো ঘরে কিছু নেই। সবাই যখন ধরাধরি করে জমিরকে গোসল করাচ্ছিল, তখনও আনুর মনে হচিছল, কাল থেকে কাজ খুঁজতে হবে। পরক্ষণেই নিজের বিসদৃশ শরীরের দিকে তাকিয়ে মুখে গাল এসে গিয়েছিল, হারামির রস কত…মরণের আগে আরেকটা খাওউন্না থুইয়া গেছে।

শরীরের এই অবস্থায় কী করে যে সংসার চলে, তা সারাদিন ঘরে বসেও আনু ভালো করে টের পায়। রাসু’বু সেলাইয়ের কাজটা জুটিয়ে না দিলে কী হতো ভাবতেই ওর গা শিউরে ওঠে। অবশ্য পেটে একটাকে নিয়ে সেলাই করতে আনুর শরীর ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসে। একটানা সেলাই করতে পারে না। হাঁফ ধরে যায়। পিঠে টান লাগে। তবু রাক্ষুসে পেটকে শান্ত করতে আনুকে কাজ করতে হয়। এই হাতের কাজ আনা নেওয়াটুকু রাসু’বু করে বলে রক্ষা।

রূপার বাপ মরবার পর যখন আদুরির মতো ওদের ডাস্টবিন ঘাঁটার দশা, তখনই রাসু’বু কাজ জুটিয়ে দিয়েছিল। কামিজে নকশী বাহারি ফুল তোলা। প্রতি পিস কামিজে ফুল তোলার জন্য পঁচিশ টাকা করে পায়। বস্তির অনেকেই করে। অর্ডারি কাজ। রাসু’বুই আনে। কলোনির এক আপার কাছ থেকে। তবু বস্তিতে রাসু’বুর অনেক বদনাম। সবাই বলে তার নাকি সাতটা বিয়ে হয়েছে। এখন কোন স্বামীই নেয় না। তবু সপ্তাহে সপ্তাহে পরনে নতুন শাড়ি। বস্তি ছেড়ে কলোনির পাকা ঘরে থাকছে অনেক দিন। ভাল চরিত্রের মানুষ হলে কি তা সম্ভব? নিশ্চয়ই চরিত্রের ঠিক নেই। কিন্তু আনু এখন চরিত্র জানে না। জানে শুধু পেটের দায়।

২.
-ঐ দেখ, ভাতারখাগী মাগী যায়। গায়ের কাপড়খান দেখছস্…
– হ গো খালা, নতুন নাগরে দিছে মনে লয়।
– কয়দিন আগে খালাস হইল… রূপের ঢেউ দেখ্ না মাগীর…।
-আহারে কী কপাল! এক ভাতার মরলো টেরাকের চাপায়… দুই দিন যাইতে না যাইতেই নতুন জুটাইছে। তোরা কী করস্ গো আবিয়াইত্তা মাগী…

আনু ঘোমটা টানে। নতুন শাড়ির মাড়ের আঁচল খসখস করে ওঠে। পা চালায় দ্রুত। ঘর থেকে কল পাড় হাঁটা পথ। তবু তার হাঁফ ধরে যায়। শরীর কেমন ভার ভার লাগে। আজকাল সত্যিই ওর শরীরে রূপের ঢেউ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেই টের পায়। চেহারায় রুক্ষতা নেই। প্রতিদিন বিকেলে তেল দিয়ে কষে চুল বাঁধে। মাঝে মাঝে  স্নো-পাউডার দেয়। ওর চোখে-মুখে এখন আলগা লাবণ্য। শরীরের বাঁকগুলোও স্পষ্ট চোখে পড়ে। হবে না কেন? এখন আনুর কত সুখ। খাওয়া-পড়ার সমস্যা নেই। দুটো ভাতের জন্য বাড়ি বাড়ি ঠোক পাড়া নেই। আনুর ঘরেই আজকাল তিনবেলা ধোঁয়া ওঠা ভাত হয়। রূপার এখন সাত সাতটা নতুন ফ্রক। ছেলেটার জন্যে সপ্তাহে এক টিন দুধও জোটে।

-আলো… তোরা মহারাণীকে জায়গা করে দে।

কেউই তার জায়গা থেকে নড়ে না। শুধু আনুকে দেখে সবার মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো মুখ টিপে হাসতে থাকে। পুরুষের চেয়ে মহিলার সংখ্যাই বেশি। কোন কোন মুখ ভীষণ সচল হয়ে যায়। যেন বিনোদনের অপূর্ব সুযোগ অযাচিতভাবে তাদের সামনে এসে পড়েছে।

-রাসু রঙিলার লাইন ধরছে।
-হ গো চাচী… আমাগো রূপের কদরই কেউ করলো না।

আনু কোনো কথা কানে তোলে না। ঘোমটা’টা আরও লম্বা করে টেনে লাইনের একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়ায়। সকাল হতেই কলপাড়ে কোলাহল বাড়তে থাকে। বস্তির মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত পরিষ্কার পানির একমাত্র উৎস এই অপরিষ্কার কলপাড়টি। সরকারি সাপ্লাইয়ের পানি। ঘন্টা দুয়েকের জন্য কলের মুখ দিয়ে শীতল পানির স্রোত বেরোতে থাকে। কে কার আগে যাবে তাই নিয়ে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে ঝগড়াও বাঁধে। আগে কলপাড়টি পরিচ্ছন্নই ছিল, এখন কলপাড়ের আশেপাশের কাদা ঘাটা মাটি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ আসে সারাবেলা। দুপুরের রোদ চড়া হবার সাথে সাথে সেই গন্ধ আরও তেড়ে ফুঁড়ে বের হয়। সেই উৎকট গন্ধের সাথে বস্তিবাসীর অকথ্য কলহ-কোলাহল মিলে মিশে চারপাশের পরিবেশ ভীষণ অসহনীয় হয়ে ওঠে।

-নে… আরও একজন আইছে…।
রাসুবু তেড়ে আসে।
-তোরা থামবি… দুই পা কব্বরে তবু মাগীর মুখ কমে না।
-আলো মাগী তোরও কি কব্বরের ডর নাই। ভাতারখাগী… বারোভাতারি…

রাসুবু, রাহেলার মা, রাহেলা, হনুফা, তাহেরা… কতগুলো বেসুরো ক্লান্তিহীন গলার অশ্রাব্য চিৎকারে কলপাড়ের বাতাস গমগমে হয়ে ওঠে। এই শুরু হলো। ঘন্টাখানেকের আগে থামবে না। অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাই কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে যায়। প্রথমে হাঁক পেড়ে দল ভারি করা। তারপর ধীরে ধীরে আনু ছাপিয়ে কলহের বিষয়বস্তু আরও বিস্তৃত হতে থাকে। একে একে এর ওর হাঁড়ির খবর বের হতে থাকে। সেই সাথে নানারকম গোপন খবরও বের হয়ে আসে। বছরের পর বছর ধরে এতো খেদ জমেছে নিজেদের মধ্যে। মনে হয় একে অপরের চিরশত্রু। যেন অকথ্য খিস্তি-খেউড়ে একে অন্যকে ধুয়ে ফেললেই সেই শত্রুতার অবসান ঘটবে। অথচ দুপুরের পর পরই দেখা যাবে ভিন্ন চিত্র। সাতসকালে যারা একে অপরের চরিত্রের কুৎসা নিয়ে বস্তি গরম করে ফেলেছিল, তারাই একে অপরের মাথার উকুন মারবে, আর দুঃখের কথনগুলো ভাগ করে নেবে। এটাই বস্তির প্রাত্যহিক চিত্র।

আনুর পায়ের কাছে আদুরি কুঁই কুঁই করে। আদর নেবার আবদার নয়, যেন মুদু সুরে সহানুভূতি জানায়। ক’দিন আগে ওর বাচ্চাটাকে বস্তির পোলাপান খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলেছে। তাই বেদনা ভাগ করে নেবার জন্য তার ভেতরটাও আকুলি-বিকুলি করে। আনু আর পানি নেবার জন্য দাঁড়ায় না। রূপার বাপকে বলতে হবে এ বস্তি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।
রূপার বাপ! নাকি কাশেম দোকানদার! নাকি ওর নতুন ভাতার! নতুন নাগর! কলপাড়ে জটলা করা মুখগুলো খিস্তি করেই চলে। আনু মুখ তোলে না। শূন্য কলসিটা তুলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। বলুক ওরা। যা মনে হয় বলুক। ওরা শুধু বলতেই পারবে। পারবে দিতে আনুর গায়ে নতুন শাড়ি? মেয়েটার পেটে একমুঠো ভাত? আনুর চোখ ভরে জল আসে। অপমানের অশ্রু নয় যেন কী এক অভিমানে ওর বুক ঠেলে কান্নার স্রোত বেরিয়ে আসে।

৩.
-মা ভাত দিবি না। বিহানেও তো কিছু দিলি না। হারাদিন না খাইয়া থাকমুনি?
রূপার পায়ের কাছে দাঁড়ানো আদুরি সম্মতিসূচক শব্দ করে। তার পেটেও আজ দানাপানি পড়েনি। দুপুর অবধি বহু দূর ঘুরে এসেছে। মানুষজনের কী যে হয়েছে আজকাল। এত চেটেপুটে খায়! আস্তাকুঁড় ঘেঁটেও কিছু চোখে পড়ে না। অবশ্য আজকাল দুপেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথেও তাকে লড়াই করতে হয়। অসহায় মানুষ আদুরির চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত? নীরব দেখে রূপা মাকে ধাক্কা দেয়,
-কী মা? উঠলি না? ভাত দিবি না?

উঠতে গিয়ে তলপেটে আচমকা টান লাগায় আনু ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। পায়ের সাথে বেকায়দা শাড়িটা জড়িয়ে ছিল বলে বসতে গিয়ে ফড়ফড় করে অনেকখানি ছিঁড়ে যায়। শাড়িটা একেবারে নরম হয়ে গিয়েছিল। কতখানি ছিঁড়লো তা আর দেখার চেষ্টা করে না আনু। পেটে হাত রেখে ব্যথাটা চারপাশে ছড়িয়ে দিতে চায়। হাঁটতে গেলেই আজকাল তলপেটটা টনটন করে ওঠে। পেশাবে বসলেও জ্বালাপোড়া হয় ভীষণ। ছোট ছেলেটা হওয়ার পর থেকেই এমন হচ্ছে। গায়ে গতরে তেমন জোর পায় না।

আনু টের পায় শরীর ফুরিয়ে আসছে। কাল মাঝরাতে ছেলেটা কেঁদে উঠলে বুকের দুধ দেবার চেষ্টা করেছিল। ছেলেটা ওকে ছিবড়ে ফেলেও এক ফোঁটা দুধ পায়নি। অথচ আবু কোলে আসার পর পরই যেন ওর বুকে দুধের বান ডেকেছিল। শাড়ি ব্লাউজ ভিজে চটচট হয়ে থাকতো, তবু আবু মুখে তোলেনি এক ফোঁটাও। কৌটার দুধের নবাবিতে পেয়েছিল বড়টাকে। আর এই ছেলেটা দুধ পায় না এক ফোঁটাও।

– ওমা… কানে হুনস না। আইজও ভাত রানবি না? নয়া বাপে আহে না ক্যান মা? আইলেই তো ভাত খাইতে পারি।
রূপা এবার মায়ের পিঠে মৃদু ধাক্কা মারে। আনু এক ঝটকায় পিঠ থেকে মেয়ের হাতটি সরিয়ে দেয়। কোলে বড় ভাইটিকে নিয়ে টাল সামলাতে পারে না রূপা, মায়ের হাতের ঝটকায় মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে। মাটিতে পড়ে গিয়ে ছেলেটা দুনিয়া কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। মায়ের রুক্ষতায় রূপার চোখে পানি আসে না, বরং অসহ্য চনচনে ক্ষুধায় পেটের ভেতরটা পাঁক দিয়ে ওঠায় তীব্র রোষে সে মায়ের দিকে তাকায়।

-ভাত দিতে পারবি না যখন তোর পোলা তুই রাখ।
রূপা এক লাফে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা হঠাৎ কচি লতার মতো বেড়ে উঠেছে। ভাত জোটে না দু’বেলা, তবুও বড়ো বাড়ন্ত শরীর। ছেঁড়া-ফাঁড়া নোংরা ফ্রকটির এখান সেখান দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশগুলো চোখে পড়ে। আনু উঠে বসার চেষ্টা করে না। তার পরনের শাড়িটারও বেহাল অবস্থা। ওর ভয় হয়। হয়তো উঠতে গেলে আবার ছিঁড়বে। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ছোটটাকে শুইয়েছে। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে সবে ঘুমিয়েছে। ভাইয়ের চিৎকারে উঠে গিয়ে সেও সমান তালে চেঁচাতে থাকে। আনু তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ছোটটার মুখে তার অপুষ্ট স্তন চেপে ধরে। দেড় মাস বয়সী বাচ্চা তবু কী করে যেন তাকে ঠকানো হচ্ছে সে ফন্দিটা ধরে ফেলে। মায়ের চিমসে যাওয়া স্তন কামড়ে ধরে সে তার শোধ নেয়। তারপর মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার ছোট শরীরে যতখানি শক্তি আছে ততখানি শক্তি দিয়ে সে সেই প্রতারণার কথা সারা পৃথিবীকে জানাতে থাকে।

চারপাশ অসহ্য ঠেকে আনুর। ছেলেটাকে ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। তারপর হাত বাড়িয়ে বড় ছেলেকে কাছে টানে। দুই বছরের ছেলেটাকে দুই মাস বয়সী লাগে। রোগা-জীর্ণ হাত-পা। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছে ছেলেটা। কান্নার শক্তিও ফুরিয়ে গেছে। গায়ে বল কই যে কাঁদবে? আনু হাত বাড়াতেই তবু রোগা পায়ে ভীষণ জোরে লাথি মারে মায়ের বুকে।
মুহূর্তেই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায় আনুর। তারপর উঠে গিয়ে ওর পিঠে দমাদম লাগায় কয়েক ঘা। মর…মর…মরস না কেন? খাওন নাই… ফিন্দন নাই… এতো দম কেন বুকের মইধ্যে…?

৪.
নানা আকারের বিচিত্র বর্ণের উড়ন্ত পোকাগুলো আলোর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আগুনের মাঝে। এক একটা পোকা আগুনে পড়বার সাথে সাথে ঝিরঝিরে একটা শব্দ হচ্ছে। মরছে, তবু দলে দলে আসছেই। যেন কী এক ঐক্য রক্ষায় আলোর মিছিলে শামিল হতে গিয়ে প্রাণ বির্সজন দিচ্ছে একে একে। মোমের আলো যতনা তীব্র, এর উত্তাপের প্রচণ্ডতা তার চেয়ে বেশি। হয়তো এই সামান্য নিখুঁত সত্যটা ওদের জানা নেই, নতুবা ইচ্ছে থেকেই এদের আত্মাহুতির পালা। আনু মোম নেভায় না। পুড়ুক। যদিও অভাবের সংসারে সন্ধ্যে রাতে এই আলোটুকুও বিরাট অপচয়। কিন্তু রাতের ঘন অন্ধকারে ওর আজকাল বড় ভয়। শুধু রাত বিরাতে কেন, বিকেল হতেই এই ভয় ওকে জাপটে ধরে ফেলে। রাত যত বাড়তে থাকে, ততই একটা চোরা ভয় শিরশিরিয়ে পায়ের পাতা অবধি নেমে যায়।

মাগরিবের আজান পড়বার সাথে সাথে তাই ছেলেমেয়ে তিনটিকে বুকে জড়িয়ে ঘরের ঝাঁপ টেনে বসে থাকে। টের পায় রাত্রি নামবার সাথে সাথে ওর ঘরের সামনে পায়ের আওয়াজের আনাগোনা বাড়ে। মানুষ নাকি কুকুর-শেয়াল এতো রাত অবধি জেগে থাকে আনু বোঝে না।

অন্ধকার তাড়াবার জন্য আজ এই মোমটুকুই সম্বল। ঘরে কুপি আছে, কিন্তু আজ আটদিন হল, কেরোসিন শেষ। বাজারে সব জিনিসের দাম নাকি বাড়তি। কোন কোন দেশে নাকি যুদ্ধ চলে। আনু ভেবে পায় না। কী এমন খায় বস্তির লোকেরা যে সে সবের দাম বাড়বে। বড়লোকেরা যেসব কেনে, সেগুলো না হয় বিদেশি খাবার, যুদ্ধ বাঁধলে বিদেশ থেকে আনা যায় না। আর ওদের ইরি চালের পুষ্ট ধানের ক্ষেত তো সারাবছরই ফলন দেয়। কত সবুজ ধানী জমি ওদের গাঁয়ে! মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজ ধানের শীষ যুবতী নারীর মতো মোহনীয় হয়ে বাতাসে দোল খায়। বড়ো মধুর সেই দৃশ্য! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নেশা ধরে যায়।

হঠাৎ করেই মেঠো ধানের মাতাল গন্ধে আনুর শূন্য পেটের ভেতর পাঁক দিয়ে ওঠে। সেই সাথে চোখের সামনে ফুলকুঁড়ি গ্রামের ভরা খেতের লোভনীয় ধানদৃশ্য ভেসে ওঠে। ধীরে ধীরে সে দৃশ্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। ঘরের নিভু নিভু অন্ধকারে এতো স্পষ্ট সুরেলা দুপুর কী করে চোখে পড়ে আনু ভেবে পায় না। যেমন হঠাৎ করে আনু ডুবে গিয়েছিল একটা অপরিচিত স্বপ্নদৃশ্যে, তেমনি হঠাৎ করেই আনু তার পরিচিত গণ্ডিতে ফিরে আসে। মোমটা এখন কড়ে আঙ্গুলের সাইজের। আগুন ছোট হয়ে শেষ সুতাটুকু পুড়ে যাবার আগেই এক ফুঁয়ে আনু আলো নিভিয়ে দেয়। সাথে সাথে ঘরের চারপাশ জুড়ে নেমে আসে অসহ্য বুনো অন্ধকার।

মাঝরাতের শব্দহীন অন্ধকারে আশেপাশের ঘুপচি ঘরগুলোকেও ভরাট অন্ধকারের মতো লাগে। তবু মাঝে মাঝে উকিঁ দেয়া চাঁদের আলোয় আনুর ঘরখানা মানুষটির ঠিকই চোখে পড়ে। খানিকক্ষণ ইতঃস্তত করে মানুষটি আনুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বেড়ার গায়ে কয়েকটা টোকা দিতেই ঘরের ঝাঁপ ভেতর থেকে খুলে যায়। চারপাশের নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা ভেদ করে একটা শুষ্ক নারীকন্ঠ শোনা যায়,

-শুধু শুইবা… নাকি বিয়া করবা? বিয়া করলে একখান রঙিন ছাপওয়ালা শাড়ি দিতে হইবো? নাইলে তিন কেজি চাল। দিবা তো?
এরপর রাত্রির মতো নিঃশব্দে ঘরের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। আর ঠিক তক্ষুনি রাত্রির ঘন অন্ধকারে চাঁদটা মেঘের ফাঁকে ঢুকে যায়। উড়ো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদটা ডুব সাঁতার কাটে, নাকি তার চোরা মুখ মেঘের কাছে লুকাবার চেষ্টা করে ঠিক বোঝা যায় না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.