মা-মাতৃত্ব যখন সন্তানের বোঝা!

লিপিকা তাপসী:

অনুবালা অসুস্থ, সকাল থেকেই মাঝে মাঝে খিঁচুনি মতো হচ্ছে। চার ছেলের কেউ একটিবার কাছে আসেনি। সেই ১১ বছর বয়সে যে বাড়িতে তাকে এনেছিল সেই ব্যক্তিটি ছুটোছুটি করছে। ক্রমেই অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বুড়ো ছোটে গ্রামের ডাক্তার ডাকতে। দূর খেকে বেনু বালার কানে ভেসে আসে বাবার প্রতি সেজো ছেলের দাঁত খিঁচুনি মার্কা কথাবুড়ো বয়সের প্রেম দেখে আর বাঁচিনে। একটু কিছুতেই ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। 
বুড়ো ডাক্তার নিয়ে ফেরে ততক্ষণে অনুবালা পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।
আহা মহান মায়ের মৃত্যু

কুসুমবালা স্বামী মারা যাবার পর শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ, ঠাঁই হয়েছে এক কোনার এক অন্ধকার ঘরে। এই ঘরেই মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কেটেছে সাত বছর, একলা। ক্ষুধায়, যন্ত্রণায় নিজেই নিজের সঙ্গী। চার ছেলেমেয়ের মমতাময়ী মায়ের প্রস্থান ঘটেছে একলা, ভীষণ নিঃসঙ্গতায়, যন্ত্রণায়। মারা যাবার পর মৃতমুখ দেখার সময় হয়নি গ্রাম থেকে ২৫০ কি.মি দূরে ঢাকায় থাকা এক সন্তানের।

সুভদ্রা পাঁচ ছেলে আর তিন মেয়ের মা। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে সংসার করছে। আর ছেলেরা আলাদা সংসারে। মায়ের থাকা খাওয়া ভাগ হয়েছে। একমাস করে প্রত্যেক ছেলের বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। একমাস হয়ে গেলে সে বাড়িতে আর মায়ের জন্যে রান্না হয় না। কখনো কখনো পরের মাসে যার বাড়িতে থাকা খাওয়ার সিরিয়াল, তার বাড়িতেও ভুলে মায়ের জন্যে রান্না হয় না। সেদিন কোনো বাড়িতেই আর খাওয়ার ডাক পড়ে না, তাই আলাদা করে কিনে রাখা মুড়ি খেয়েও দিন পার হয়।

বাড়ি ভর্তি ফলের গাছপালা, ফলের মৌসুমে ফল ধরে প্রচুর। সেগুলোও ভাগ হয়েছে। কোনটাতেই মায়ের হাত দেবার, কারো দেবার বা নিজে খাবার অধিকার নেই। অথচ এই গাছগুলোর কোন কোনটি মায়ের হাতেই লাগানো।

মেয়েরা দাবি জানিয়েছিল, মায়ের নামে একটি-দুটি গাছ, একটু জমি লিখে দেওয়ার জন্যে। বাবার উত্তর ছিল, ‘মায়ের নামে জমি গাছ থাকলে মেয়েরা পায়, তাই মেয়েরা এই দাবি করছে।” তাই এই দাবি আর কখনও কোনো মেয়ে মায়ের পক্ষ হয়ে করেনি। ছেলেরা কড়ায় গণ্ডায় মায়ের থাকা খাওয়ার হিসেব রাখে, একবেলা খাবারও এদিক-সেদিক না হয় যেন। মা গুনতে থাকেন এই ফুটবলের মতো গড়ানো জীবনের সুস্থাবস্থায় অবসানের।

এরকম অনুবালা, কুসুমবালা, হাজারও সুভদ্রা মহান মাতৃত্বের পদবী মাথায় নিয়ে তার চারপাঁচজন করে সন্তান থাকার পরও নি:সঙ্গ, চিকিৎসাহীন, দুবেলা খাবারের জন্যে এর ওর দিকে তাকিয়ে, অথবা কোন বেলা আধপেট খেয়ে দিন পার করতে হয়। বেঁচে থাকতে মায়ের অসুখবিসুখে ডাক্তার জোটে না, কিন্তু মারা যাবার পর ঘটা করে মৃত্যুবার্ষিকী পালন, আর সেই অনুষ্ঠানে ব্যাপক খানাপিনা অয়োজনকারী সন্তানের সংখ্যাও কম নয়।

মা সারাজীবন গায়ে গতরে সেবা দিয়ে যান। সন্তান হিসেবে আমরা কি চিন্তা করি শেষ বয়সের নিঃসঙ্গ মাকে সঙ্গ দেবার? মায়ের কী কী প্রয়োজন, সেটি জানার? নিজের ইচ্ছেমতো মা যাতে খরচ করতে পারে, হাতে কিছু টাকা পয়সা দেয়ার?

অনেক সন্তানকেই দেখেছি, মায়ের কাছ থেকে যা আছে টাকা পয়সা নিয়ে নিতে, মায়ের লাগলে আবার চেয়ে নেবে শর্তে। মায়ের বার বার আর চাওয়া হয়ে ওঠে না। মা বরং কিছু খরচ না করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। মা মহৎ, নির্ভরতার প্রতীক, কিন্তু সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে অক্ষম, পরম মমতার আশ্রয়স্থল শেষ বয়সে হয়ে যায় ভীষণ বোঝা। সম্পদহীন মায়ের ভার বহনে আগ্রহী ছেলেমেয়ের সন্ধান মেলে কম।

অনেক হয়েছে মায়ের মমত্বের কাব্য রচনা। এখন সন্তানের মমত্বের কাব্য রচনা হোক। প্রতিটি সন্তান মাকে যোগ্য সম্মান দিতে শিখুক, মমতা দেখাতে শিখুক, নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠুক। মানুষ হিসেবে মায়ের সম্পত্তির অধিকার, সন্তানের অধিকারসহ সকল অধিকার নিশ্চিত হোক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.