শুধু “বাবা” হওয়া নয়, ভালো “মা” হওয়ারও চেষ্টা করুন

সুমিত রায়:

বিশ্বাস করুন, “মা” হওয়ার মধ্যে লজ্জার কিচ্ছু নেই। “বাবা” তো সবাই হচ্ছে। এ আর নতুন কী? একবার চেষ্টা করে দেখুন না একজন যত্নশীল, স্নেহময়, মমতাময় একজন সুন্দর “মা” হতে পারেন কিনা। খুব খারাপ লাগবে না। এর জন্য আপনাকে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরতে হবে না। প্যান্ট-শার্ট বা লুঙ্গি পরেও এই প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে।

আতঙ্কিত হবেন না; এর জন্য আপনাকে বাচ্চার জন্ম দিতে হবে না, বা বাচ্চাকে স্তন্যপানও করাতে হবে না। আপনার শিশ্ন বা অণ্ডদ্বয় যারপরনাই বলবৎ রেখেও আপনি একজন কোমলচিত্ত “মা” হতেই পারেন। আর তার জন্য আপনাকে চাকরি-বাকরি ছেড়ে ঘরের চার দেওয়ালে বন্দিও হতে হবে না। আপনি যথারীতি সকল “পৈতৃক” দায়িত্ব সামলেও তার সাথে সমান্তরালভাবে একজন অসাধারণ “মা” হওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যেতে পারেন। শুধু একটু সদিচ্ছা আর সামান্য প্রচেষ্টা থাকলেই চলবে।

মেয়েরা যদি জন্মের পর থেকেই একজন “মা” হওয়ার জন্য আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে পুরুষেরা পারবেন না কেন? মেয়েরা “মায়ের জাত”, সে না হয় বুঝলাম। আপনারা তো “পুরুষের জাত”। আর “পুরুষের জাত” চাইলে কিইবা না করতে পারে। পুরুষের কাছে অসম্ভব বলে তো কিছু হয় না। পুরুষ এতো অসাধ্য সাধন করছে। কেউ হিমালয় জয় করছে, তো কেউ অ্যান্টার্কটিকা। মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে কেউ, তো কেউ মহাকাব্য লিখছে। কেউ সর্বজ্ঞানী, কেউ আবার ধর্ম প্রচারক। কেউ বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য গড়েছে, আবার কেউ হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ছুঁড়েছে। সন্ত্রাস, যুদ্ধ, দাঙ্গা সবকিছুতেই পুরুষ তার মহান অবদান রেখে চলেছে। যে পুরুষ সম্প্রদায়ের মানব ইতিহাস জুড়ে এতো কীর্তি, সে সামান্য “মা” হওয়ার দায়িত্বটা কেন নিতে পারবে না?

নারীর জন্য পুরুষ এতো আত্মত্যাগ করে থাকে। রাত জেগে কবিতা লেখে, মূর্তি বানায়, কেউ আবার তাজমহল গড়ে। কেউ প্রেমিকা হারানোর দুঃখে দেবদাস হয়ে যায়। কেউ আবার নারীর সম্মান রক্ষা করতে সম্মুখ সমরে নামে। এতোকিছু করা যায় নারীর জন্য, অথচ মাতৃত্বের ভাগটা নিতে পুরুষের এতো আপত্তি কেন? এতো মাতৃত্বের জয়গান; সাহিত্যে, শিল্পে, গানে এতো মাতৃত্বের স্তুতি; তাহলে “মা” হতে এতো সঙ্কোচ কেন? কেন অনন্তকাল ধরে মাতৃত্বের দায় পুরোপুরিভাবে নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো?

মাতৃত্বের সাথে জুড়ে থাকে মায়া, মমতা, স্নেহ, যত্ন এমন কিছু গুণাগুণ যা “পুরুষ” মানুষের সাথে “মানায়” না। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে চিরকাল প্রভুত্ব করতে শিখিয়েছে। ক্ষমতা প্রদর্শন, শক্তি প্রদর্শন, দখলদারি, অন্যেরটা জোর করে কেড়ে নেওয়া, ছিনিয়ে নেওয়া – এসবের মধ্যেই পুরুষ হওয়ার প্রকৃত সার্থকতা। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে ধ্বংসাত্মক হতে শেখায়।

ছেলেবেলা থেকেই হাতে খেলনা বন্দুক নিয়ে ছেলেদের এই “পুরুষ” হয়ে ওঠার লড়াই শুরু হয়। তারপর পাড়ার ছেলেদের সাথে লড়াই, পেশিশক্তির প্রদর্শন। একে ধরে পেটানো, অমুকের দাঁত মুখ ভেঙ্গে দেওয়া, কাউকে আবার মেরে চামড়া গুটিয়ে নেওয়া, কথায় কথায় খিস্তানো, বউকে মেরে শিক্ষা দেওয়া, প্রেমিকার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে তাকে চরম শিক্ষা দেওয়া – এই সবের মধ্য দিয়েই পুরুষতন্ত্র তার ক্ষমতার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখে।

অপরদিকে শৈশব থেকেই মেয়েরা হাতে খেলনা পুতুল নিয়ে “মা” হয়ে ওঠার লক্ষে এগিয়ে চলে। “মা” হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই নারী জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। তাকে যত্নশীল হতে হবে, দয়াময়ী, মমতাময়ী, নম্র, বিনীত, সুশীলা হতে হবে।
এই সব শিক্ষা শুধুমাত্র নারীর জন্য। পুরুষ এইসব শিক্ষা কখনই নেবে না। এসব শিক্ষা পুরুষ নিলে সে আর “পুরুষ” থাকবে না, সে তখন “মেয়েছেলে” হয়ে যাবে। তাকে গৃহবন্দি হতে হবে, সমস্ত রকম স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, অধিকার এই সবকিছুর উপর তখন তার নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এটা কখনই হতে দেওয়া যাবে না। তাই মাতৃত্বের জয়গান করা হবে, মাতৃত্বের স্তুতি গেয়ে মহান সাহিত্য-শিল্প রচনা করে মাতৃত্বের মহিমাকে উন্নীত করা হবে, কিন্তু মাতৃত্বের দায়ভার পুরোপুরি ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হবে নারীর উপর।

প্রশ্ন করা হলে অজুহাত দেওয়া হবে, “মেয়েরা মায়ের জাত, এসব মেয়েরাই ভালো পারে। পুরুষ মানুষের দ্বারা এসব কাজ হয় না।” কিন্তু এটা একটা নিছক কুযুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। “মেয়েরা মায়ের জাত” এই ধারণাকে প্রচলিত করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এক সর্বব্যাপক ক্ষমতা ও প্রভুত্বের রাজনীতির জাল বিস্তার করে পুরুষতন্ত্র।

“মেয়েরা মায়ের জাত” এটা যে নিতান্তই দায় এড়ানো একটা অজুহাত, এটা এখন উপলব্ধি করার সময় এসে গেছে। আমাদের এখন বুঝতে হবে যে পুরুষেরাও মাতৃত্বের দায় নিতে পারে। এখন বেশির ভাগ উন্নত দেশে কিন্তু অনেক পিতারাই মায়ের দায়িত্ব পালন করছেন; যথেষ্ট দক্ষতার সাথে ঘর সামলাচ্ছেন। এদেরকে “stay-at-home dads” বলা হয়। এমনকি বর্তমানে আমাদের দেশেও এমন পিতাদের আবির্ভাব ঘটছে, যা একসময় কল্পনারও অতীত ছিল। এই ধরনের পুরুষদের দেখলে হয়তো অনেকে “মেয়েছেলে” বলে টিপ্পনি করবেন, কিন্তু ভবিষ্যতে এটাই স্বাভাবিক হবে।

তাই এখন থেকেই ছেলেদের শৈশব থেকে “পুরুষ” বানানোর প্রকল্প বন্ধ হোক। ছেলেদেরকে ছোটবেলাতে সারাক্ষণ হাতে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অভ্যেস থেকে বিরত করুন। ছেলেরা যদি মেয়েদের সাথে পুতুল, রান্নাবাটি বা কানামাছি খেলে তাতে এতো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মেয়েদের সাথে মিশলে ছেলেরা “মেয়েলি” হয়ে যাবে, এই কুসংস্কার থেকে আমাদের মুক্ত হওয়ার সময় এসেছে। আর মেয়েদের সাথে মিশে ছেলেরা যদি একটু “মেয়েলি” হয়ে যায়, তাতে বরং সমাজের মঙ্গল। তাতে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি থেকে কিছুটা হলেও পৃথিবী মুক্ত হবে।

আর কোনো ছেলেকে “পুরুষালী” হতে না পারার জন্য বিদ্রূপের শিকার হতে হবে না। কোনো তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে সমাজচ্যুত হতে হবে না। মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালবাসা জেগে উঠুক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে। শিথিল হয়ে যাক পৌরুষ, ক্ষমতা, প্রভুত্বের দৃঢ় স্তম্ভ। মাতৃত্ব জেগে উঠুক সবার প্রাণে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.