ক্ষুদিরাম আখ্যান-১

ফারহিম ভীনা:

কোন কোন চরিত্র জীবনভর মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ক্ষুদিরাম সেরকম একটি চরিত্র। এ বীর বিপ্লবী আমার মনের খুব গভীরে লুকিয়েছিল। দেশকে ভালোবেসে এ কিশোর হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিল। বলেছিল -একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। অঞ্জলি নিও হে বিপ্লবী। ভেবেছিলাম জীবনী লিখবো -কাগজ নিয়ে বসতেই দেখি যা লিখি তা বোধ হয় একটি উপন্যাস হচ্ছে।
তা হোক -তবু লিখি। ইতিহাস আমার বিষয় না -আমার বিষয় সেই অগ্নিঝরা সময় আর কিংবদন্তি ক্ষুদে বিপ্লবী। ফেইস বুক যেন আমার গল্প লেখার খাতা -আমি লোভ সামলাতে পারি না। আবার ফেইসবুক যেন মঞ্চ নাটক -সাথে সাথে পেয়ে যাই পাঠ প্রতিক্রিয়া। শুরু হোক তবে ক্ষুদিরাম আখ্যান।

খুদের বিনিময়ে ছেলে

সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। ঊনিশ শতকের শীতকাল। মেদিনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে নেমে এসেছে শীতকাল। পথের চারপাশের আকন্দ ফুলের বন আর রাঙ্গা বন ডুমুরের গাছে শিশির পাড় চক চক করে ওঠে। কুয়াশায় ভেসে যায় ছায়ামায়া দুর্বাঘাসের সবুজ চাদর, বই চিতলার মাঠ, পথ, গাছপালা, নীলকুঠি সাহেবের কাড়ি থেকে শিমুল বাবলার বন। ভেসে যায় সারি সারি খেঁজুর গাছ, মাঝি পাড়া, কুমোর পাড়া, বনবিবির জাগ্রত মন্দির এমনকি গ্রামের শেষ প্রান্তের বয়োজ্যষ্ঠ বটবৃক্ষটিও। শীতের চাদরে চরাচর আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে গ্রামটি যেন হয়ে ওঠে একটি আঁকা ছবি।

হাবিবপুর গ্রামের এলোমেলো মস্ত ঝোপালো বাগানটিতে বাস করেন ত্রৈলোক্যনাথ বন্দোপাধ্যায়। বাগানটি মস্ত, তবে নিতান্তই এলোমেলো- ত্রৈলোক্যনাথের ভাষায়, ‘নাহ্ বাগানটির কোন ছিরি-ছাদ নেই।’ বাগানে বাহু বিস্তার করেছে শ্যাওড়া গাছ, দিনের আলোটিও যেন চুরি করে অসংখ্য ঝুড়িতে জমিয়ে রেখেছে বট পাকুড়ের গাছ। ফলের গাছে যত্ন নেই-তবু দিব্যি আম-কাঁঠালের সারি। কলাগাছগুলি জন্মেছে যত্র তত্র। আছে দু’চারটে নিম গাছও। তারই মধ্যে জরাজীর্ণ স্যাঁতস্যাতেঁ দুটি নিচু নিচু ঘর। একটাতে ছাদ ভেঙ্গে হেলে রয়েছে, তাতে গোলপাতা দিয়ে ছাউনি দেওয়া আছে। ঘরের পেছনে বেশ প্রশস্ত একখান পুকুর। ঢলো ঢলো কাজল পুকুর। মাঝে মাঝে এ পুকুরে আলো করে ফুটে থাকে শাপলা ও পদ্ম ফুল। এই পুকুরের কাজল জলে মাছরাঙ্গাদের ঝাঁপ দিয়ে হঠাৎ নেমে আসা আবার চকিতে দূর অসীম পানে উড়ে যাওয়া, এ সবই নিত্য নতুন দৃশ্য তৈরি করছে এ বাগানে।

সন্ধ্যার বিষন্নতায় পুকুর পাড়ে হাওয়ার লুটোপুটি দেখলে মনে হয় কোথাও দারিদ্রের গ্লানি নেই। পরিবারটি সামর্থবান নয়, তবে মালিন্য বা ক্ষুদ্রতার ভারে নত নয়। জমিদারবাবুর সেরেস্তাদারি করে যে একুশটি নগদ টাকা আয় করেন, তাতে সংসারটি মন্দ চলে না। সংসারের হাল ধরে আছেন ত্রৈলোক্যনাথের স্ত্রী লক্ষীপ্রিয়া দেবী। সংসার নিপুণা, ধর্মপ্রাণ এই নারী। ইতোমধ্যে তিন কন্যা অপরুপা, সরোজিনী আর ননীবালাকে সৎ পাত্রস্থ করেছেন। তারপরও পুত্র কামনায় লক্ষীপ্রিয়া প্রায়ই ‘হত্যে’ দিয়ে পড়ে থাকতেন মন্দিরে। দুবার পুত্র সন্তান জন্ম দিলেও ভগবানের ইশারায় তারা মায়ের কোলকে চিরবিদায় জানিয়েছে।

১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর বিকেল নাগাদ লক্ষ্মীপ্রিয়ার প্রসব বেদনা ওঠে। আঁতুড় ঘরের চারপাশে দু’চার পড়শী মহিলা ভিড় জমিয়েছেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর মা খবর পেয়ে গতরাতেই জামাই বাড়ি এসেছেন। তিনি মেয়ের প্রসব বেদনায় অস্থির হয়ে গরম পানি নিয়ে দৌড়াচ্ছেন আঁতুড় ঘরে। চারপাশে আজ যেন বাগানের অন্ধকার আরো ঘনীভূত ও নিকষিত হয়ে উঠেছে।
শীতের রাত বড় দীর্ঘ রাত। সরারাত মেয়ের প্রসব বেদনা স্থায়ী হবে কিনা সে দু:শ্চিন্তা যেন তার একলার। জামাই জমিদারবাবুর কাজ শেষ করে এখনো বাড়ি পৌঁছাননি। তিনি একসময় বাগানে চোখ মেলেন-গাছ পালায় আকীর্ণ বাগানটি তার কাছে কেমন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। তবু নি:সীম অন্ধকারে থেকে থেকে জোনাক জ্বলে উঠলে তিনি একটু ভরসা পান। রাজ্যের ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে বিরামহীন। আজ এই ঘরে তার কেমন ভয় করছে। আহা একটি পুত্র সন্তানের জন্য মেয়েটি কিনা করেছে। যদি সত্যিই ছেলে হয়-সে বড় আনন্দের। কিন্তু আনন্দাশ্রু ফেলতে পারেন না। ভয় হয় আগেকার মতো যদি না বাঁচে? আর যদি ছেলে নাই হয়?

ত্রৈলোক্যনাথ বাবু দেরি করতে চাননি-তাও খাতাপাত্রের হিসেব মেলাতে মেলাতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। তিনি একটু হাঁপাতে হাঁপাতে আঁতুড় ঘরের সামনে আসেন এবং গলা খাঁকারি দিয়ে তার আগমনী জানান দেন। আশ্চর্যের ব্যাপার বই কী! ঠিক সেসময় দাই বুড়ি মনীষের মা ফোকলা দাঁতে একগাল হাসি নিয়ে দোর খুলে দাঁড়ায়।

-‘ওগো, কে কোথায় আছিস? রাজপুত্রের মতন ছেলে হয়েছে। সোনার বরণ গা।’
ত্রৈলোক্যনাথ তাও যেন বিশ্বাস করেন না। জিজ্ঞেস করেন-
-‘সত্যিই আমার ছেলে হয়েছে? ছেলে নড়ছে তো?’

এসময় ছেলের কান্নার শব্দ শুনে উপস্থিত সকলের চোখ সজল হয়ে উঠলো। আহা দু’পুত্র সন্তানের মৃত্যুর পর বহু সাধনায় পাওয়া এ ধন। আজ ভাঙ্গা এ ঘরে চাঁদের আলোর বান ডেকেছে। পড়শীদের বৌ-ঝিরা কলকল করতে করতে এগিয়ে এলো। সত্যিই বড় জাগ্রত কালী।

ত্রৈলোক্যনাথ ছেলের মুখ দেখলেন। পাঁজি দেখলেন- সুলক্ষণ ছেলে, বড় মিষ্টি তার মুখ। ছেলে তার অনেক বড় হবে। সংসারের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু হঠাৎ অজানা আশংকায় ভরে ওঠে মন। সত্যিই যদি আগের দু’ছেলের মতো এও ফাঁকি দিয়ে যায়?
আশংকাটি অমূলক নয়। লক্ষীপ্রিয়ার পুত্র সন্তান বাঁচে না।

এদিকে লক্ষ্মীপ্রিয়া আঁতুড় ঘরে ছেলের মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছেন না। আবার ভুলতেও পারছেন না কঠিন সত্যকে। এইতো ক’দিন আগে আসন্ন প্রসবের পূর্বে পাশের বাড়ির শান্তির মা, মাসী, পিসতুতো ননদ সকলে পরামর্শ দিয়েছে-পুত্র সন্তান জন্ম হলে বাঁচানোর জন্য বিক্রি করে দিতে হবে।

কেউ আবার এও বলছে-
‘ওরে জানিস তো মেয়ে যমেরও অরুচি। ছেলে হলে ছেলের মঙ্গল কামনায় কঠিন হতে হবে।’ ছেলেকে মেয়ের মতো কান ফুঁড়ে দিতে হবে, সোনার এইটুকুন বিন্দু তাতে বসাতে হবে। যমরাজকে কন্যা সন্তান সাজিয়ে ফাঁকি দিতে হবে। ত্রৈলোক্যনাথও আজ জমিদারবাবুর বাড়িতে সেকরমটি শুনেছেন।

লক্ষ্মীপ্রিয়ার মা অর্থাৎ শাশুড়ী মাও যেন তার মনের কথাটি বললেন,
‘পুত্রের মঙ্গঁল বলে কথা। তোমরা মনস্থির কর।’
লক্ষ্মীপ্রিয়া মায়ের কথা শুনে বলল, ‘ওগো মাথা খাও তুমি আমার। আমার এই তপস্যা করে পাওয়া পুত্রটিকে দূরে কোথাও দিও না।’ সেসময় শাশুড়ী মা পরামর্শ দিলেন, ‘কেন গো বাছা-তোমার তিন যুগ্যি মেয়ে রয়েছে- সৎ পাত্রস্থ করেছো তাদের। তাদের একজনের কাছে এ ছেলেকে শাস্ত্রমতে দিয়ে দাও।’ বড় কন্যা অপরুপা বিয়ের পর ঘরেই রয়েছে-সর্বাগ্রে তার কথাটি মনে পড়লো। বাহ্, তবে তো ঘরের ছেলে ঘরেই থাকবে।

নবজাতক ছেলের আয়ু ও কল্যাণ কামনায় ঘরে আয়োজন করা হলো দুটি অনুষ্ঠান। সেইসাথে বিবিধ আচার। প্রথম অনুষ্ঠানে দিদি অপরুপা তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে তার মায়ের কাছ থেকে ভাইটিকে কিনে নেন। এইবার নবজাতকের দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত হলো। একইসাথে হলো নামকরণ। খুদের বিনিময়ে কেনা বলে ক্ষুদিরাম। আর একটি অনুষ্ঠানে ক্ষুদিরামের কান ফুঁড়ে দেওয়া হলো মেয়েদের মতো। নাহ্ যমদূতকে নিয়ে আর ভয় রইলো না। কন্যা শিশু মনে করে তাচ্ছিল্য জ্ঞানে দূরে থাকবে। সত্যি যমের মুখে ছাই দিয়ে নবজাতক পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.