তাসফিয়া, এ প্রতারক পৃথিবী তোমার ছিলো না

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

তাসফিয়া,
তোমার ছবি দেখে নির্বাক চেয়ে রইলাম – কতক্ষণ তা বলতে পারবো না। সদ্য ফোটা গোলাপ কুঁড়ির মতো স্নিগ্ধ তোমার মুখখানি।
তোমার মতো নিষ্পাপ দুই কন্যা সন্তানের মা আমি। অনুমান নয় অনুভব করতে পারি, এমন মিষ্টি গোলাপ হয়ে যে বাবা- মায়ের বাগানে ফুটেছিলে – কী আনন্দধারায় না জানি ভরিয়ে রেখেছিলে তাদের ভুবন! এমন তো কথা ছিলো না বাবা!
পতেঙ্গা সৈকতে, খণ্ড খণ্ড পাথরের ওপরে গোলাপি জামায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নিথর তোমার দিকেও তাকিয়ে থাকলাম স্তব্ধ আমি – কতক্ষণ বলতে পারবো না। পাথরে থেতলে যাওয়া, পিষ্ট হওয়া সেই গোলাপ ফুলটির ছবি যদিও সহ্য করার মতো সাহস আমার ছিলো না।

তোমার বাবা- মা এই দৃশ্য সহ্য করার শক্তি কীভাবে পেলেন, আমি সত্যিই জানি না।

তাসফিয়া, শুনেছি তোমার মৃত্যুরহস্য অচিরেই উন্মোচিত হবে। এমনও শুনছি, তুমি নাকি খুন হওনি, আত্মহত্যা করেছো!
তাহলে তোমার দু’চোখ নষ্ট করে দেয়া হয়েছিলো, বুকে, শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছিলো – এসব কি মিথ্যে?

তোমার পড়ে থাকা নিথর দেহের ছবিসহ অনলাইন পত্রিকাগুলো খবর ছাপে রোজ। তার নিচে মন্তব্যগুলো পড়ে আমি অবাক হই না। মৃত্যুর আগে তোমাকে কতোটা আঘাত সইতে হয়েছে অথবা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে কিনা, এখনও নাকি নিশ্চিত জানা যায়নি! তোমাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে গিয়েছিলো কিনা, তাও জানি না।
তবে এখন কিন্তু তোমার মতো ছোট্ট কিশোরীর মৃতদেহের চরিত্র হনন করতে লোকের অভাব হচ্ছে না। এমন করুণ মৃত্যুর পরেও তোমাকে বাঁচাতে পারিনি সাইবার ধর্ষণের কবল থেকে।

পাথরের মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা তোমার জন্য এতোটুকু বুক কাঁপে না ওদের! তোমার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের জন্য ওদের মাথাব্যথা নেই। তোমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে মজা পাওয়া পিশাচগুলোর কথা ভেবে শিউরে উঠি যে – এই সমাজের আনাচে-কানাচে এদের বসবাস!
তোমার মতো কিশোর বয়সে অনেক ছেলেমেয়েরই বাবা- মাকে পর মনে হয়, স্বল্প পরিচিত বন্ধুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে ইচ্ছে হয়।

মনে হয় যেন বাবা- মায়ের চেয়ে বন্ধুই তাকে বুঝতে পারে, গুরুত্ব দেয়, সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো মানুষ চেনা। বন্ধু চেনা। পিশাচগুলো যে মানুষরূপে আমাদের আশেপাশেই থাকে, আমরা তা ভুলে যাই। সারাজীবন ধরে মানুষ চিনতেই আমরা ভুলটা করি।
আর তোমার মতো বয়সে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই বলে এমন মৃত্যু কারো হয়!

আমরা যারা তোমাদের মতো সন্তানের মা – বাবা, তারাও ভুলত্রুটির বাইরে নই। এই যেমন তোমার মতো বাচ্চাদের হাতে আমরা বাবা- মায়েরা সময়ের আগে মোবাইল ফোন তুলে দেই। ভুল থেকেই আমরা শিখি।
দুঃখ হয়, তুমি সে সময়টুকু পেলে না।

নিশ্চয়ই যখন তুমি ভুলটা বুঝতে পেরেছো, ততোক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছিলো। সেই মুহূর্তে তোমার কী মায়ের মুখটা মনে পড়েছিলো তাসফিয়া? যে মায়ের শাসন একটুও ভালো লাগতো না, তখন মনে হয়নি যে, মা কেন আরো কঠিন শাসন করে, শক্ত করে ঘরে বেঁধে রাখলো না?

তোমার কেন সমবয়সী ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হলো, তা নিয়ে বহুলোকের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। অথচ আদনান মির্জা নামের পনেরো/ষোলো বছর বয়সী ছেলেটির কী করে যুবক বয়সী প্রভাবশালী বন্ধু থাকে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না! ছেলেবন্ধুটিকে বিশ্বাস করে তুমি বাইরে গিয়েছো – তাই খুন হওয়াই তোমার জন্য উপযুক্ত শাস্তি – এমন কথা যারা বলাবলি করছে, তাদের অপরাধ আমার কাছে খুনি সমান।

অচিরেই তোমার মৃত্যুরহস্যের জট খুলে প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত হবে, ক্ষমতার দাপট উপড়ে ফেলে বিচার হবে আশা করি, দাবি জানাই। এ দাবি না জানালে নিজেকে মানুষ পরিচয় দেবো কীভাবে?

হত্যা না আত্মহত্যা, খুন আদনান করেছে নাকি অন্য কেউ তা বের হোক, বিচার হোক, যাই হোক- তুমি যে পতেঙ্গা সৈকতে লাশ হয়ে পড়েছিলে, এই সত্য তো মিথ্যে হয়ে যাবে না বাবা! তুমি তো ফিরে আসবেনা তাসফিয়া! বাবা- মায়ের বাগানে গোলাপ হয়ে ফুটবে না আর!
এই ক্ষুদ্র জীবনে কী নির্মম, অনিরাপদ আর প্রতারক এক পৃথিবীর কথা জেনে গেলে!

তারপরও কী আমাদের লজ্জা হলো!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.