“স্পর্শ ও পুরুষতন্ত্র”

সুমিত রায়:

সাল ১৯৯৫। একান্নবর্তী পরিবার। বাপ-কাকা-জেঠুরা মিলে পাঁচ ভাই ও তাদের প্রায় গোটা একডজন ছেলেমেয়ে। বাড়ির মেজ ছেলের সবে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই পালা করে মেজ ছেলে নতুন বউকে গরু পেটা করে। মার খেতে খেতে বউটি ঘর থেকে ছুট দেয় বাড়ির বিশাল উঠোনে। সেখানে মাটিতে ফেলে চলে আরেক প্রস্থ ধোলাই। সবাই চুপ। ঘরে বসে সবাই যে যার কাজ করে যাচ্ছে। শুধু বাড়ির ছোট ছেলে অপুর দুচোখে রক্ত ফুটে ওঠে। ছুটে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ইচ্ছে করে একটা আদলা ইট হাতে তুলে মেজদার মাথায় মেরে ঘিলুটা বার করে দিতে। কিন্তু ততক্ষণে তার ক্ষুদ্র শরীর ক্ষোভে-যন্ত্রনায় অসার হয়ে আসে।

সাল ২০১৮। অফিস যাওয়ার পথে ট্রেনে বসে অপু খবরের কাগজ খোলে। মেট্রোর কামরায় আলিঙ্গনরত দুই দম্পতিকে সহযাত্রীরা গণধোলাই দিয়ে রেলপুলিশের হাতে তুলে দিল। খবরটা পড়েই অপু শৈশবের সেই রক্ত-জমাট স্মৃতিতে ফিরে গেল। ঘটনাটিকে এবার সে নিজের মত করে নতুন ভাবে সাজাতে শুরু করল —

সারাদিন ভ্যাপসা দমবন্ধ গরমের পর হঠাৎ ঠাণ্ডা হওয়া দিয়ে অঝোরে বৃষ্টি তাদের গ্রামের বাড়ির খোলা উঠোনে। মেজদা আর মেজ বৌদি হটাৎ ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করল। উঠোনের মাঝে ভিজতে ভিজতে আনন্দে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। অপু তাই দেখে ঘর থেকে ছুটে এল। মেজদাকে জাপটে ধরে বৌদি মেজদার ঠোঁটে চুমু দিতে থাকল। উঠোনের মাঝে ভিজতে ভিজতে অপু আনন্দে হাততালি দিতে লাগল। তারপর দু’হাত দিয়ে দুজনকে ধরে ওদের গায়ে মুখ ঘষতে লাগল। অপুর পিছন পিছন বাড়ির সব সদস্যরাও ছুটে এল; বাপ-কাকা-জেঠুরা সব রে রে করে তেড়ে এল:

“আরে এটা কী করে! ছি, ছি! বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনে! ছি ছি! নিজের ছোট ভাইটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সামান্যতম লাজ-লজ্জা কিছু নেই! তোরা দেখছি ভাদ্র মাসের কুকুর হয়ে গেছিস! … ছেলেদের তো লাজ-লজ্জা একটু কম হয়। কিন্তু একটা মেয়ে কীকরে এমন করে! তার উপর আবার নতুন বউ! এই ভদ্র ঘরের মেয়ের নমুনা! ছি ছি! ছেলেমেয়ের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা গেল! … অসভ্য, বেশ্যা মাগি! বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে সিনেমা করছে! এত তেল কোথা থেকে আসে কে জানে! বুড়ো বয়সে এসে এসবও দেখতে হচ্ছে! মরণ!”

বড়দা মেজদাকে ধরে চড়াচ্ছে; জেঠু-কাকুরা মেজবৌদির চুলের মুঠি ধরে বাড়ির উঠনের কাঁদায় আছড়ে ফেলছে।

কী অদ্ভুত সমাজ আমাদের! বধূ নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ সব নিয়মিত প্রকাশ্যে চলে এই সমাজে । অথচ একজন মানুষ আরেকজনকে ভালবেসে স্পর্শ করছে, জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখলেই আমরা গেল গেল রব তুলি।

জড়িয়ে ধরতে, চুমু খেতে একে অপরকে স্পর্শ করতে হয়, একে অপরের কাছাকাছি আসতে হয়। তেমনি একই ভাবে কাউকে শারীরিক নির্যাতন করতে, শ্লীলতাহানি করতে, ধর্ষণ করতে হলেও তাকে স্পর্শ করতে হয়। অথচ এক ক্ষেত্রে স্পর্শ চরম আপত্তিকর হয়ে যাচ্ছে, অপর ক্ষেত্রে “স্পর্শ” ততটা আপত্তিকর হচ্ছে না, তা যত ভয়ংকরই হোক।

পুরুষতন্ত্র স্পর্শকে স্বীকৃতি দেয় তখনই যখন সেই স্পর্শের মধ্যে ঘৃণা, ক্ষোভ, প্রতিশোধ, দমন এমন কোনো কর্তৃত্ব সুলভ মানসিকতা জড়িয়ে থাকে। পুরুষতন্ত্র নারীর দেহকে ভোগ করতে জানে, তাকে দমন করতে জানে, কিন্তু তাকে স্বীকৃতি দিতে জানে না। তাই ভালবাসার সাথে নারীর দেহকে স্পর্শ করা পুরুষতন্ত্রে একপ্রকার “কাপুরুষতা”রই লক্ষণ। তাই রাস্তাঘাটে কোনো পুরুষ যখন ভালবেসে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে বা চুমু খায় তখন সেই পুরুষ আর পুরুষ থাকেনা, সে তখন “মেয়েছেলে” হয়ে যায়।

সারাক্ষণ গায়ের সাথে গা ঘেষে থাকা, হাত ধরে থাকা, গায়ের মধ্যে ঢলে পড়া এসব “মেয়েছেলে”রা করে। পুরুষকে এসব মানায় না। পুরুষ মানুষ “মেয়েছেলে”র থেকে সর্বদা দূরে থাকবে, কখনো তাকে “touch” করবে না; শুধুমাত্র রাতে মশারির তলায় সে নারীর দেহের নৈকট্যে আসবে, আর সেটাও শুধুমাত্র তার শরীরটাকে ভোগ করার উদ্দেশ্যে। ভোগ করা হয়ে গেলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, কারণ নারীর স্পর্শে বেশিক্ষণ থাকলে পুরুষ “মেয়েছেলে” হয়ে যেতে পারে। বউয়ের আঁচলের তলায় বেশিক্ষণ থাকলে তাকে সবাই “স্ত্রৈণ” বলবে।

মেয়েরা অনেক সময়ই যখন একসাথে গল্প করে তখন একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে, গায়ে ঢলে ঢলে পরে। ছেলেদের মধ্যে এই চরিত্রটা সেভাবে দেখা যায় না। ছেলেদেরকে বোঝানো হয় যে এগুলি “মেয়েলি” স্বভাব। ছেলেদের একটু শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। নইলে তাকে ঠিক পুরুষ বলে মনে হয় না। কারোর গা স্পর্শ করাটা অসভ্যতা বা অস্বাভাবিক আচরণ, কারণ এগুলি “মেয়েলি” চরিত্র। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যাদেরকে আমরা উপহাস করে “হিজরা” বলে থাকি, তাদের মধ্যেও এমন “মেয়েলিপনা” দেখা যায়। তারা খালি শরীর স্পর্শ করে। তাই ওদের দেখলেই আমরা ভীষণ আতঙ্কিত হই।

শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা — এ এক পুরুষতন্ত্রের তৈরী করা রীতি। এই রীতি আধিপত্য বজায় রাখার এক কৌশল বা রাজনীতি। নারী অধম, কারণ সে শুধুই শরীর। তাই তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এই দূরত্ব তৈরি করার মধ্য দিয়েই পুরুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখে, যাতে নারীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সুবিধা হয়। ঠিক যেমন ভাবে “উচ্চ” বর্ণের মানুষ “নিম্ন” বর্ণের মানুষের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে। কখনও ছোঁয়া লেগে গেল “নিম্ন” বর্ণের মানুষটির উপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ঠিক যে কারণে “উচ্চ”পদস্থ ব্যক্তি “নিম্ন”পদস্থ যারা তাদের সাথে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখে; তাদের সামনে বড় টেবিল থাকে, নয়তো পায়ের নীচে উঁচু প্ল্যাটফর্ম। শারীরিক নৈকট্য কখনোই আধিপত্য বিস্তারের অনুকূল নয়। তাই শারীরিক নৈকট্য ততটাই গ্রহণযোগ্য যেটুকু দমন-নিপীড়নের জন্য প্রয়োজন।

মেয়েদেরকেও কিন্তু শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে শেখানো হয়, তবে সেটা নিতান্তই শরীরের “পবিত্রতা” রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, কারণ সেটা বিশেষ কোনো পুরুষের ভোগে ব্যবহৃত হবে। তাই পর পুরুষের থেকে তাকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু পুরুষ যৌন মিলন ছাড়া বাকি সময় নিজের স্ত্রীর সাথেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখে কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে।

জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়া অনেক দূর, মেয়েদের সাথে হ্যান্ডশেক করাতেও আমাদের সমাজ সাচ্ছন্দ বোধ করে না। একজন মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করা মানে তার ব্যক্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন পুরুষ একজন মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করছে মানে সে সেই মহিলাকে সমমর্যাদা দিচ্ছে। তার কাছে নারী তখন শুধুমাত্র একটি “দেহ” থাকছে না, সে তখন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষে পরিণত হচ্ছে।

পুরুষতন্ত্র শরীরকে বর্জন করতে শেখায়। পুরুষতন্ত্রে শরীর গৌণ, বর্জনীয়, ঘৃণ্য। দেহের চর্চা মনকে দূষিত করে। তাই পুরুষের শরীরের যত্ন নিতে নেই, সাজতে নেই। এসব মেয়েছেলেদের কাজ, কারণ তারা শরীর সর্বস্ব। তাই নারীকে ভালবাসা মানে শরীরকে স্বীকৃতি দেওয়া। পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরকে ভোগ্য বস্তু রূপে ব্যবহার করলেও, পুরুষতন্ত্র কিন্তু শরীরকে কখনও স্বীকৃতি দেয় না। তাই প্রকাশ্যে, লোকালয়ে, ট্রেনে-বাসে, কি রাস্তায় ছেলেমেয়েরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে পুরুষতন্ত্র আতঙ্কিত হয়। এর থেকে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ভাল, কারণ এতে শরীরকে ভোগ করা যায় কিন্তু শরীরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে না। নারীর শরীরকে দমন করা যায়, পীড়ন করা যায়, কিন্তু ভালবাসা যায় না।

যে পুরুষ নিয়মিত বেশ্যালয়ে যায় সে কিন্তু শুধুমাত্র নারীর শরীরটাকে ভোগ করতে যায়, যে শরীরটাকে সে প্রকৃতভাবে ঘৃণা করে। আমি যেটাকে ঘৃণা করি, আমি সেটাকেই ভোগ করছি! এটা কীকরে সম্ভব! পুরুষতন্ত্র এটাই আমাদের শেখায়–ভোগ, কিন্তু ঘৃণার সঙ্গে। এই ঘৃণাটি থাকা প্রয়োজন আধিপত্য বজায় রাখতে। তাই পুরুষ নারীর শরীরকে যখন ভোগ করে তখন আপাত ভাবে সে নারীর শরীর নিকটে আসে ঠিকই, কিন্তু নারীর শরীরের সাথে তার মানসিক দূরত্ব সেই মুহূর্তে চরম অবস্থানে থাকে; কারণ তখন সে ঘৃণিত বস্তুকে ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে।

এ এক চরম অস্তিত্ব সংকট। এই সংকট থেকে বাঁচতে একমাত্র পথ ঘৃণা। তাই যত শারীরিক নৈকট্য, তত বেশি ঘৃণা, আর তত বেশি মানসিক দূরত্ব। ভালবাসা এই ঘৃণার রাজনীতি, এই আধিপত্যের রাজনীতিকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। ভালবাসার আবেগে দুটো শরীর কাছাকাছি আসলে তখন সেখানে কোনো আধিপত্য থাকে না; ক্ষমতার তন্ত্র ভেঙে যায়; দুটো শরীর, দুটো মন এক হয়ে যায়। তাই ভালবেসে যৌন মিলন নয়, যদি যৌনমিলন করতেই হয় তাহলে সেটা ঘৃণার সাথে। তাই ধর্ষণও আমাদের সমাজে একপ্রকার যৌনমিলন বলেই গণ্য হয়। তাই ঘরে ঘরে স্বামীরা যখন স্ত্রীদের ধর্ষণ করে, আমাদের সমাজ, বিচারালয় বুঝেই উঠতে পারে না স্বামী আবার স্ত্রীকে কিভাবে ধর্ষণ করে! যৌনমিলন তো ঘৃণার সাথেই হয়ে থাকে, এটাই তো স্বভাবিক, এটাই তো যৌনমিলনের আসল রূপ, এতেই তো আসল মজা!

আর জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া এসবকে তো কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কারণ এসবের মধ্যে রয়েছে ভালবাসা। ঘৃণা করে কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে না বা চুমু খেতে পারে না। সুতরাং এসব “মেয়েলিপনা” চলতে দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই। তাও লুকিয়ে করলে একরকম। এসব যদি ট্রেনে-বাসে করতে শুরু করে, তাহলে তো মহামারির মতো ছড়াবে। (“প্রেম” এ কিন্তু একধরনের আধিপত্য থাকে, যেটা ভালবাসায় থাকে না। তাই “প্রেম” শব্দটি ব্যবহার করলাম না। যাই হোক, সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য এই লেখার নয়)।

তাই নারীর শরীরকে স্পর্শ করো, কিন্তু ঘৃণার সঙ্গে, ভালবাসার সঙ্গে কখনোই নয়। ভালবাসার সাথে স্পর্শ মানেই শরীরের কাছে আত্মসমর্পণ, আর তাতেই পুরুষতন্ত্রের মৃত্যু। তাই এখানেই আপত্তি, এখানেই জ্বালা, এখানেই ক্ষোভ। তাই রাস্তাঘাটে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ, তার চেয়ে ভালো, ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলুক।

(বি: দ্র: এই লেখাটি ক্ষমতার রাজনীতি বা পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। পুরুষ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তাই ব্যক্তিগত ভাবে কেউ নেবেন না।)

লেখক: সুমিত রায়, ইংরেজি শিক্ষক, গবেষক, কল্যাণী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.