তাসফিয়াদের ‘ভালো বন্ধু’ হয় না কেন?

রুমানা রশিদ রুমি:

একদিন আমার খুব কাছের এক প্রবাসী বান্ধবী সাদা শাড়ীতে সুন্দর সাজে নিজের ছবিখানা আপলোড করলো ফেসবুকে। সেই ছবিতে কমেন্ট করলো আমাদেরই খুব কাছের অন্য এক বন্ধু –‘পরীরা কি সাদা পোশাকের হয়!’ আমি ঠুকে দিলাম হাসির ইমো। আর মনে মনে সেই ক্যাম্পাস জীবনের স্মৃতি হাতড়াতে থাকলাম।

কী মধুর বন্ধু সম্পর্কগুলো। বন্ধু কত নির্ভরতার। একদল বন্ধু অামরা একসাথে ঘুরতাম। হৈ চৈ আর আড্ডাময় জীবন ছিল আমাদের। একবার ডিপার্টমেন্টের এক স্যরের রুমে স্যার কী কাজে যেন ডেকেছিলেন। আমার আসতে দেরি দেখে ওরা তো চিন্তায় অস্থির। এ রুম সে রুম খোঁজা শুরু করলো। পরে ফিরলে কষে একটা চড় দিয়েছিল। কেন কাউকে সাথে নিয়ে যাইনি বলে।

যখন আমার বিয়ে হলো, বিয়েতে বরের পক্ষের কাছে কান ভাঙ্গানী দিয়েছিল কারা যেন। আমার বাবা বেশ চিন্তায় ছিলেন। গায়ে হলুদ মাখাতে মাখাতে এই বন্ধুই বললো, দোস্ত ভাবিস না। বেশি ঝামেলা হলে আমরাই কেউ একজন কলমা পড়ে নিয়ে যাবো। আবার যখন পড়তে পড়তে বাচ্চা পেটে আসলো, ক্লাস শেষে ওরাই রিকশায় সযত্নে তুলে দিয়ে বলতো, মামা, স্পিডব্রেকার দেখে সাবধানে নেবেন। ঝাঁকুনি যেন না লাগে।

আমি জানি আমার সেই প্রাণের বন্ধুদের কাছে আমরা বান্ধবীরা সত্যিই সাদা পরী। সারা জীবনের জন্য। আমাদের মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন, গেট টুগেদার পার্টিতে, জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকীতে দেখা হয়। আমরা ছেলেমেয়ে, স্বামী-স্ত্রীদের নিয়ে দেখা করি। কখনো নিজেরা একা দেখা করি। সংসার, সুখ-দু:খ, ক্যারিয়ার, রাজনীতি, ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠা, সব থাকে আমাদের আড্ডায়। শুধু থাকে না ভয়। কারণ বয়স বেড়ে দাঁত পড়ে ফোকলা সাদা চুলের হলেও আমাদের বন্ধুদের কাছে আমরা এক একটা সাদা পরী।

এ প্রজন্মের তাসফিয়াদের জন্য মায়া হয়। ওরা বন্ধুর কাছেও নিরাপদ নয়। চট্টগ্রামে লাশ হয়ে পড়ে থাকা তাসফিয়ার কথা বলছিলাম। বন্ধুর সাথে বাইরে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি সে। পরে তার থেঁতলানো মুখের লাশ মেলে। আমি যখন একজন ছেলের মা, আমার এই বন্ধুবাৎসল জীবনের অভিজ্ঞতা ছেলেকে শেখাই। যেন ওর কাছে ওর বান্ধবী নিরাপদ থাকে। কিন্তু যখন এই আমিই একজন মেয়ের মা, আমি ভয়ে কুঁচকে থাকি। আমার মেয়ের বন্ধু কি এমন হবে? ওকে সাদা পরী ভাবতে শিখবে?

আমাদের বন্ধুরা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করেতে গেছে, একবার শুধু বলেছে, দোস্ত একটু দেরি হয়ে গেল। সময় মতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে তোকে মিস করতাম না। আমরা নিজ হাতে বন্ধুদের বউদের বাসর ঘরে পৌঁছে দিয়েছি। বন্ধু -বান্ধবী যার যার নিজের সংসারে ভালো আছে দেখে আমরা ভালো থাকি। এই ভালো থাকাটাই আমাদের পাশাপাশি রেখে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। আমাদের মুখ থেঁতলে, ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করে ছিন্নভিন্ন পোশাকে রাস্তায় ফেলে দেবার কথা ভাবনাতেও আসেনি। বরং ওই ‘মিস করতাম না’ শব্দ সারাজীবন আমাদের মিস করতে শিখিয়েছে।

আমাদের বন্ধুরা আমাদের জীবনের বড় রকমের ব্যাক আপ। জীবনের যে কোনো বিষয়ে আটকে গেলে জীবনপণ সাহায্য, মানসিক সাপোর্ট পাবার মতো দৃঢ়বিশ্বাস আমাদের আছে। তবে কি আজকালকার ছেলেমেয়েরা রেসে জিততে কনুই দিয়ে বন্ধুকে পিছনে ফেলে একাই সামনের সারিতে থাকতে চায়? এভাবে সামনের সারিতে যখন সে দাঁড়ায়, সে তখন একজন অপরাধী কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। মূল্যবোধের সেই অবক্ষয়ের জন্য তাহলে দায় কার? পিতা-মাতা বা শিক্ষকের? যে দায়ভার এক সাদা পরীকে সাদা চোখে দেখতে দেয় না!

শেয়ার করুন: