দিনা ফেরদৌস:
প্রেম, বিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে অনেক লেখাই হয়েছে, হচ্ছে। তবে প্রেম, বিয়ে হতে না হতে বহু কিছুই ঘটে যায় একটি নারীর জীবনে; যা কেউ কোনদিন প্রকাশ না করলে অজানাই থেকে যায়। আমি এইসব ঘটনা বাতাসেই পাই বলা যায়, মূল ব্যক্তির কাছ থেকে শোনার সুযোগ খুব কমই হয়েছে। কিন্তু যখন শুনেছি, তখন প্রতিবাদ করার সাহস বা বয়স কোনটাই আমার ছিল না।
পরিচয় বলবো না, তাতে অনেকেই ক্ষেপে যাবেন। নিজেদের অন্যায় কৃতকর্ম অন্যের মুখে শুনলে খারাপই লাগে। আর কেউ এইসব প্রকাশ করে না বলে আজীবন আড়ালেই থেকে যায় ঘটনাগুলো। আগেই বলে রাখছি, কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই লিখা নয়, নিজের অনুশোচনা থেকেই এই লিখা।
পরিচিতা একজন বলেই শুরু করি। পরিচিতা একজন যার নাম ‘ক’, বয়স ত্রিশের কোটায়, দেখতে যেমন সুন্দরী, তেমনি অনেক গুণী। পড়ালেখা তেমন না করলেও ঠিক বয়সে বিয়ে দিলে যেকোনো লন্ডনী পুরুষের বউ হতে পারতেন। সংসারের দায়িত্ব, অসুস্থ্য মায়ের সেবা, আর তার বড় ভাইকে বিয়ে না দিয়ে ঘর ছাড়ার উপায় ছিল না বলে তাকে ত্রিশের কোটায় যেতে হয়েছে। এইদিকে বড় ভাইয়ের চাকরি-বাকরি না থাকায়, কোন মেয়ের বাপ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না।
‘ক’ কে সবদিক সামলাতে হয় বলেই সব কিছুতেই সে কথা বলে, এমনকি নিজের বিয়ের ব্যপারেও। আত্মীয়-স্বজন সহ্য করতে পারেন না নিজের বিয়ে নিয়ে কথা বলা বেহায়া মেয়েটিকে। কেউ কেউ বাজারিও বলেন, কিন্তু তার বাজারের কাজে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেন না। ভাইয়ের বিয়ের পর সেইসব আত্মীয়-স্বজন ‘ক’ এর জন্য দয়া করে পাত্র দেখতে লাগলেন।
ডিভোর্সি পাত্র, যার দুই/ একটা বাচ্চা আছে; সেই বাচ্চা পালনের জন্য। বউ মরা পাত্র, যার বয়স হয়েছে, ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে , যার শুধুই এখন সেবার প্রয়োজন। অথবা বেকার পাত্র, যাকে মেয়ের ভাই সাহায্য করলে কিছু একটা করতে পারে। ‘ক’ এইসবের প্রতিবাদ করতে গেলে পিছনে পিছনে আত্মীয়রা বলাবলি করতেন, ওরে কে নেবে? ওর যা বয়স, এই বয়সে আমরা ছেলেমেয়ের মা-বাবা হয়েছি ( তিনাদের শুধু বিয়ের জন্য জন্মানো ভাগ্য দেখলে আমার নিজেরও হিংসা লাগে)।
অবশেষে একদিন খরব পেলাম, অসুস্থ মা মারা যাওয়ার পর পরই তার বিয়ে হয়েছে। তিনি আমার ঘনিষ্ট কেউ ছিলেন না, যারা তার বদনাম করতেন, তাদের কাছ থেকেই তাকে আমার চেনা (এখন মনে হয়, হয়তো মায়ের জন্যই সে এতোদিন বিয়ে করেনি)। সবাই জানে, তার বুড়ো হয়েই বিয়ে হয়েছে বহু কষ্টে, কেন বুড়ো হতে হয়েছে তার খবর কেউই জানবে না কোনদিন।
যারা বদনাম করে করে এক সময় মুখে ফেনা তুলতেন, তারাও এখন নিজের মেয়েদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে দেখছেন ত্রিশ বয়সটা খুব একটা বেশি না ( মানে নিজের বেলায় সব ঠিক)। তিনারা সবাই এখন ফেরেস্তার মতো মানুষ। নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কথা বলেন, মেয়েদের চাকরির দরকার আছে বলেও মনে করেন। এই প্রজন্ম কোনদিন জানবেও না তাদের পিতা-মাতা, চাচা-চাচী, ফুফু, খালারা শুধু অন্যের মেয়েদের বদনাম করে করে সেই মেয়েগুলারে কত মানসিক কষ্টের মধ্যে রাখতেন এক সময়।
দ্বিতীয় কাহিনী হচ্ছে, আমার পরিচিত একজনের ফুফুকে নিয়ে। যিনি স্বামীর বাড়িতে বাচ্চা না হওয়ার কারণে বহু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমনকি উনার বর আরেক বিয়েও করেছেন। উনাকে সেই স্বামীর বাড়িতেই কাটাতে হয়েছে আমৃত্যু। ভাইয়ের বউ উনাকে খুব ভালবাসতেন (মানে ভালবাসা দিয়ে মানসিক চাপের মধ্যে রাখতেন,) বলতেন; তুমি যদি স্বামীর সংসার ছেড়ে এখানে চলে আসো, তো তোমার ভাইজীদের বিয়ে দেবো কেমনে? তোমার ভাই কারও সঙ্গে বড় মুখ করে কথা বলতেও পারবেন না। সবাই জানে তুমি শ্বশুর বাড়িতে বেশ ভালোই আছো।
এই ফুফা সেইসব ভাতিজিদের বিয়েতে যান, কারও কারও উকিল বাপও হোন সেইসব বিয়েতে। সেই ফুফু যার নিজের বাচ্চা-কাচ্চা নেই, বাপের বাড়িতে সম্পত্তিতেও আছে অধিকার, তাকে অবহেলায় মরতে হয়েছে শ্বশুর বাড়িতে; এক সময় ভাইজি- ভাইপোদের বিয়ে দেবেন বলে। উনার ভাইজি-ভাইপো সবাই বিয়ে করে ভালোই আছে। ফুফুকে মনে রাখার দরকার নেই কারও আজ, যাদের কথা ভেবে ভেবেই ফুফু সারা জীবন নরক বাস করে গেছেন।
আরেকজনের কথা বলি, যার এক চোখে একটু সমস্যা। পিছনে কেউ কেউ তাকে ‘ট্যারি’ বলেও ডাকে। উনার সমস্যা হচ্ছে, গরীব হলেও হাড্ডি শক্ত। মানে জাতিলা টাইপের মানুষ। উনাকেও কেউ একজন মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, উনিও বাসেন। তবে ছেলেটা তথাকথিত জাতিলা না। আর উনাদের জাতের কেউ তাকে বিয়েও করবে না। ওই ছেলের কাছে বিয়ে দিতে শুধু তার পরিবার না, আত্মীয়-স্বজনদেরও মান সম্মান জড়িত। ফলে বেচারির আর বিয়েই হয়নি। আর ভদ্র ঘরের মেয়ে বলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করাও সম্ভব হয়নি। পরিবারের মান ইজ্জত বলে কথা। এক সময় সবাই জানবে এক চোখ ট্যারা ছিল বলে কেউ তাকে বিয়ে করেনি।
আরেকজন অপরিচিতার গল্প বলি, তার নাম ধরি ‘গ’, যার গায়ের রঙ কালোই বলা যায়। বেশ সচ্ছল, আর জাতিলা ব্যবসায়ী পরিবারের তিনি। পড়াশোনা নেই পরিবারে, আছে শুধু টাকার গল্প। সেই পরিবারে মেয়েটি স্কুল পাস করে কলেজে গিয়েছিল। আর তার আগ্রহ ছিল সাজগোজের প্রতি। পরিবারের লোকের কাছে কালো মেয়েটির সাজগোজের প্রতি আকর্ষণ মোটেও ভাল লাগেনি। কালো মেয়ের আবার এতো সাজ কীসের! বেশি পাকনা হয়ে যাচ্ছে, একে আটকাতে হবে, না হলে পড়ালেখা করে নষ্ট হয়ে যাবে, একবার কোন কিছু ঘটালে বিয়ে দেয়া মুশকিল হয়ে যাবে!
ফলে মেয়েটির পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া হয়। কালো মেয়ের পিছনে খরচ করে লাভ নেই। পড়ালেখা দেখে তো আর কালো মেয়েকে কেউ নিয়ে যাবে না, ঘরের কাজ-কর্ম জানলে বরং বলা যাবে ঘরের সব কাজ পারে। কেউ যদি বিয়ে করে বুয়া নিতে চায় তো তুলে দেয়া যাবে, ভাবনাটা ঠিক এই রকম। মাঝখানে পাল্টাতে থাকে অনেক কিছুই। সময় যেতে থাকে, মেয়েটির বিয়ের বয়স হয়, কিন্তু পাত্র পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের লোকজন ঘটক লাগাতে থাকেন চারদিকে। মেয়েটিকে বিয়ে যে ঘটক দিতে পারবে, তাকে দেড়/ দুই লাখ টাকা দেওয়া যাবে, সেই রকম চুক্তিও হয়।
অবশেষে দূর গ্রামের সৌদি আরবী পাত্র এক বহু কষ্টে জোগাড় করে নিয়ে আসে কোনো এক ঘটক। পাত্রের পড়ালেখা নেই বললেই চলে। সেইপাত্র বিয়ের পর সৌদি আরবে যায়, আসে, আর মেয়ে সেই বিয়ের নাম নিয়ে বাপের বাড়িই থাকে। অথচ চাইলে সময়মতো মেয়েটির পড়াশোনায় ইনভেস্ট করলে হয়তো ঘটকের পিছনে এতো টাকা ইনভেস্ট করতে হতো না। সবাই জানে কালো মেয়েটিকে নিয়ে পরিবার কী কষ্টই না করেছে! কত টাকা ঘটকের নিচে খরচ করেছে এই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য! মেয়েটিকে নিয়ে সবার কত চিন্তা। মেয়েটি নিজেও হয়তো কোনদিন ফিল করেনি তার এই পরিণতির মূলে আসলে তার পরিবারই দায়ী। মনে মনে সেও হয়তো তার কালো রঙকে দোষ দেয়।
অনেকে মনে করতে পারেন, এই চরিত্রের মানুষগুলো চাইলে নিজেও বেরিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু আমি যাদের কাছ থেকে দেখেছি, তাদের বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তা অন্তত আমি দেখিনি। পরিবার থেকে বেরিয়ে একটি সাধারণ মেয়ে হুটহাট করে চাইলেই কোথাও চলে যেতে পারে না। আর আমাদের সমাজ কাঠামোও সেই রকম, যেখানে সাধারণ একটা মেয়ের একা যুদ্ধ করে বাঁচার মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই। ঘুরে ফিরে সেই একই সমাজ।
আর যারা বের হয়ে গেছে, তারা বেশিভাগই আর ঘরে ফিরতে পারেনি। সারা জীবন পরিবার ছাড়া, আত্মীয়- স্বজন ছাড়া এক কঠিন জীবন বেছে নিতে দেখেছি। একজনকে চিনি, যিনি প্রেম করে বিয়ে করার কারণে, পরিবার তাকে সম্পত্তি থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত করেছে। একজন যদি প্রেম করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়, তাতে করে পরিবারের যে সম্মান যায়; তা হচ্ছে সামাজিক, আর ব্যক্তির কষ্টটা হচ্ছে মানসিক। এখানে আইনত কোন বাধা নেই, যার ফলে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে। সেই মেয়েটি ওই বাড়িতে জীবনেও যায়নি। আর নিজের পরিবারের সাথে আইনি লড়াই করতেও ইচ্ছুক না। সে মনে করে, পরিবারকে সে এমনিতেই সবার কাছে ছোট করেছে। পরিবারও সেই ফায়দাটা লুটে। ভাইবোন কয়জন বলার সময় তাকে বাদ দিয়েই গণনা করা হয় ওই পরিবারে।
যেই মেয়েটির গল্প বললাম, সে পালিয়ে না গেলে হয়তো, তাকেও কোন অপছন্দের লোককে বিয়ে করতে হতো। আর সারাজীবন পরিবার তাকে টানতো, তা না হলেও অপছন্দ নিয়ে কারো সাথে বাকী জীবন তাকেও কাটাতে হতো।
এজন্যই প্রেম, বিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে লিখতে আমার আর ইচ্ছে হয় না। এইসব ছাড়াও আরো অজানা বহু গল্প আছে মেয়েদের জীবনে, যা দূর থেকে দেখে ধারণা করা অসম্ভব। তাই আমি মনে করি, এখন সময় হয়েছে মেয়েদের কথা বলার। অমুকের সম্মান আর তমুকের কথা ভেবে সময় নষ্ট না করার।
একটাই জীবন। যারা আজ বাধা দেয় সবকিছুতে, কাল সময় গেলে তারা কিছুই করতে পারবে না। ভাল-মন্দ দুইটাই ঘটতে পারে এক জীবনে। পরিবার দেখে দিলেই যে সবার আগামী ভালো হবে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। বরং এরাই ইজ্জতের দোহাই দিয়ে জোর করে ঘৃণা, অপমানে ভরা সংসারে মানিয়ে নিতে বলে; শুধু নিজেদের মান বাঁচাতে, পরিবারের মেয়েটির কথা ভেবে নয়।
প্রতিটি দিন ব্যক্তির নিজেকেই যাপন করতে হয়। সব পরিবারেই কম-বেশি দেখা যায় ভাই-বোনের সম্পত্তি নিয়ে ভেজাল আছে। তার কারণ হচ্ছে, বেশিভাগ ভাইয়েরাই চায় বোনদের সম্পত্তি মেরে দিতে নানা উছিলায়। ফলে সম্পর্ক নষ্টের ভয়ে বেশিরভাগ বোনেরাই সম্পত্তির দাবি তোলে না। অথচ অন্যায় যতোই করুক পরিবারের একটি মেয়ে, সম্পত্তির অধিকার থেকে তাকে কোনভাবেই বঞ্চিত করার অধিকার নেই কোন ভাইবোনের।
এখনো সেই সমাজেই আছি, যেখানে নিজের পিতা সম্মানের ভয়ে কন্যাকে হত্যা করতে পারে।
অনেক ঘটনা আমাদের জানা হবে না কোন কালেই, বলবেনাও কেউ, তবুও কোন ঘটনা থেমে নেই। ব্যক্তিকেই বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন।