বৈতরণী হক:
সবাই ওকে ডাকে চিত্রা বলে। আসলে মেয়েটির নাম সুচিত্রা দাস। ওর বাবার নাম কমল দাস আর মায়ের নাম মালা দাস। চিত্রার বড় দুই দাদা আছে, যাদের সে বড়দা আর ছোড়দা বলেই ডাকে। বেশ আদরের একমাত্র বোন সে।
চিত্রাদের নিবাস টাংগাইল জেলার কালিহাতি থানার ডুকরা গ্রামে (গ্রামের নামটি কাল্পনিক)। চিত্রারা বলার মতো অবস্হাশালী নয়, আবার জরাজীর্ণ জীবন-যাপন করে, তাও না। ওদের বংশের একটা ব্যবসা আছে সুই সুতা আর বোতামের ব্যবসা। গঞ্জে ওদের ছোট দুইটি দোকান আছে। এছাড়াও খাস জমিতে ফসল হয়, গোয়ালে গরু আছে, পুকুরে মাছ আছে। খেয়ে পরে আছে ভালোই তারা।
চিত্রাদের পরিবারে লেখাপড়া করার তেমন একটা রীতি নেই। ওর দুই দাদা কোনরকমে সিক্স-সেভেন পর্যন্ত পড়ে কাজে লেগে গিয়েছে। চিত্রাই একটু অন্যরকম। সে গ্রামের হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছিল। তারপর তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় লেগে যায়। নাছোড়বান্দা চিত্রা কালিহাতি থানার এক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এবার আর কোন মাফ নেই, ওর বাসার সবাই উঠে পড়ে লেগেছে ওর বিয়ে দিবে বলে। আইবুড়ো মেয়ে এখনো বিয়ে হয় নাই, সমাজে মুখ দেখাবার জোর নেই মা-বাবা আর দাদা, বৌদিদের।
তবে চিত্রা এবারও বেঁকে বসেছে। ওর বান্ধবী পারুল নার্সিং এ ডিপ্লোমাতে ভর্তি হয়েছে টাংগাইল শহরে, আর চিত্রাও চায় সেখানে ভর্তি হতে। বাসার সবাই না করছে, তবে চিত্রার খুব ইচ্ছা মানুষের সেবার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা। ছোটবেলায় স্কুলের বইতে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলকে নিয়ে পড়েছিল, এটি একটি আদর্শ পেশা সে জানে। বাসার সবার তীব্র অনীহা উপেক্ষা করে পারুল এর সাথে টাংগাইলে এক মেয়েদের মেসে থাকা শুরু করলো সে। বাসায় নিয়মিত আসা যাওয়া হতো। বিয়ের কথা লেগেই আছে, আর সাথে বাক বিতণ্ডাও।
এভাবেই চলে গেলো তিনটি বছর। চিত্রা কোর্স শেষ করে টাংগাইলে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে কাজে ঢুকেছে। প্রায় চার মাস কাজ করার পর ওর বাসা থেকে ডাক আসলো, কারণ কমল দাসের শরীরটা ভালো নাই। গিয়ে দেখলো কথা সত্য, বাবাকে একটু রোগাই দেখাচ্ছে। চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে পুরোদস্তুর বাবার সেবায় মনোযোগ দিলো চিত্রা।
এর মধ্যে ছোড়দা একটা বিয়ের কথা আনলো চিত্রার জন্য। পাত্র লতায়-পাতায় তার শ্যালক। ঢাকায় শুনেছে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে, আসল দেশ নরসিংদীতে। নরসিংদীতে তাদের বেশ ভালো অবস্থাই। গোত্রটাও এক। ছেলের নাম প্রতিম দাস। বাবা অসুস্হ, নার্সিং এ বিএসসি করার ইচ্ছা থাকলেও এখন সম্ভব না, আর নিজের যেহেতু কোন পছন্দ নেই, বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো চিত্রা। বেশ ভালো রকমের পণ আর গয়না গাটি দিয়ে সাজিয়ে ওরা বিদায় দিলো চিত্রাকে।
কিছুদিন নরসিংদীতে থেকে ঢাকায় আসলো প্রতিমের সাথে। তবে ঢাকায় এসে চিত্রা বুঝতে পারলো তার স্বামী আসলে কোন চাকরি করে না। সে একজন দালাল। কখনো পাসপোর্ট অফিসে দালালি করে, আবার কখনো জমির দালালি, এই বাটপারি করেই তার চলে। সাথে আছে রাতভর মদের নেশা। পণের তিন লাখ টাকা শেষ করে এখন সে চাইছে ওর বাবার দেয়া সাত ভরি সোনার গয়না। চিত্রা কোনোভাবেই সে গয়না দিবে না প্রতিমকে, আর তা নিয়ে প্রতিম ওকে চড়ও মেরেছে দুই তিন দিন। তাও দিবে না সে।
উপায়ন্তর না দেখে চিত্রা ওর বাসার কাছে মুগদা এলাকাতেই একটা হাসপাতালে চাকরি নিলো। যেহেতু সেবিকার কাজ, রাতে ডিউটিও থাকে তার। যেদিন নাইট ডিউটি করে বাসায় আসে, সেদিন ঘরে আসতে না আসতেই প্রতিম বিচ্ছিরি ভাষায় গালাগাল করতে থাকে চিত্রাকে, যেন সে কোন অসামাজিক কাজ করে এসেছে। অথচ মেয়েটি সারা রাত যে মৃত্যু পথযাত্রী একজন মানুষকে আরো একটি দিন বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো কে বোঝাবে ওই নেশাখোরটাকে।
জীবনের প্রতি অতীষ্ঠ চিত্রা আর কানে নেয় না প্রতিমের গালাগাল। সে বাসায় আসে, ঘরের কাজ করে সামান্য একটু বিশ্রাম নেয়, আবার কাজে যায়। ওর আয়ের নির্দ্দিষ্ট টাকা দিয়েই চলছে সংসারটা। এভাবে কেটে গেলো আড়াইটি বছর। চিত্রা গর্ভবতী হলো। ছয় মাস পর্যন্ত চাকরি করে ওর শরীর আর দিচ্ছিলো না। হাসপাতালে ওর কাজের বেশ সুনাম। তাই তারা কথা দিলো আবার ফিরে আসলে ওকে ওরা কাজে নিবে। অতঃপর চিত্রা চলে গেলো মার কাছে ডুকরা গ্রামে, বাবা বিগত হয়েছে বছর খানেক। চিত্রা এসেছিলো তখন মাত্র তিনদিনের জন্য।
প্রথম প্রথম প্রতিম সপ্তাহে একবার ফোনে খোঁজ নিলেও আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়ে যায়। এতোটাই নিষ্ঠুর সে যে তাকে তার সদ্য জন্মানো ছেলের কথা জানানো হলেও সে আসে না দেখতে। আসলে ব্যাপারটা অন্য। প্রতিম মোটা অংকের পণ নিয়ে আরেক খানে বিয়ে করেছে চিত্রাকে না জানিয়ে। আর এখন জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে চিত্রা রাত করে বাইরে থাকতো, ডিউটির নাম করে সে একটা বাজে মেয়ে। চিত্রার শ্বশুর বাড়ি তো দূর, ওর দাদারাই বিশ্বাস করেছে এইসব কানাঘুষা খানিকটা।
এবার ছেলে রজতকে নিয়ে জীবন শুরু হলো চিত্রার। প্রতিম আর খোঁজ করে না, সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আস্তে আস্তে দাদারা ওকে আর ছেলেকে বোঝা ভাবতে শুরু করলো। মালা দাস নির্বিকার, কিছুই বলার নেই তার। দাদাদের কাছে সাহায্য চাইলো বিএসসি করবে বলে। দাদাদের সোজা কথা, বিয়ের সময় সে যা পাওয়ার পেয়েছে, আর কোন কিছুতে তার অধিকার নাই, আর এটাই তাদের নিয়ম। এই বাড়িতে থাকতে চাইলে পেটে ভাতে থাকতে হবে ছেলে নিয়ে, আর কোনো কিছুতে দাবি করা যাবে না। মালা দাস কিছুই বলে না, সনাতনী চিন্তার এই মহিলা ছেলেদের কথাতে মৌন সম্মতি দেয়।
চিত্রা যে হাসপাতালে চাকরি করতো সেখানে এক ডাক্তার আপা ছিলো, অনেক নামী গাইনীর ডাক্তার। চিত্রাকে খুব পছন্দ করতো। একদিন চিত্রা উনাকে ফোন দিয়ে সব বললো। ডাক্তার নাজমীন তাকে ঢাকা যেতে বললো। ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে চিত্রা ঢাকা গেলো, কথা দিয়ে গেলো মাসে মাসে ছেলের খরচের জন্য টাকা পাঠাবে। চিত্রা ঢাকা গিয়ে দেখা করলো ডাঃ নাজমীনের সাথে। উনি চিত্রাকে উনার সার্বক্ষণিক সহকারি করে নিলো, সিজারিয়ান অপারেশনের সময় সে ম্যাডামের সাথেই থাকে।
নাজমিনের এক বৃদ্ধা চাচী আছেন, তার সেবার জন্য বাসাতেই শিফটে নার্স কাজ করে। চিত্রার স্হান হলো সে বাড়িতে, রাতে থাকার আর সেই বৃদ্ধার সেবা করার। মাসে একদিনের জন্য বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসে, আর ছেলেটাকে দেখে আসে চিত্রা। বড় কষ্ট হয় তার সন্তানকে সে জন্ম দিলো, অথচ তার একটু একটু করে করে বেড়ে উঠার সময় সে পারছে না কাছে থাকতে, রজত বড় হলে বুঝবে তো মায়ের সীমাবদ্ধতাটা?
চিত্রার জীবন চলে যন্ত্রের মতো। তাও সে স্বপ্ন দেখে সামনে সে বিএসসি করবে নার্সিং এ, দেশের নামকরা হাসপাতালে ভালো বেতনে চাকরি করবে, রজতকে ঢাকায় এনে রাখবে, ভালো স্কুলে পড়াবে, অনেক বড় ডাক্তার বানাবে। চিত্রা স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সে জানে না স্বপ্নের বাস্তবায়ন কোনদিনও হবে কিনা!
তবে সে এও বিশ্বাস করে তার দৃঢ় মনোভাবের জন্য আজ সে এক আদর্শিক পেশায় নিয়োজিত আছে, নিজের ছেলের খরচ বহন করতে পারছে। আর তাই সে নিজেকে বিশ্বাস করে সে পারবেই তার জীবনের বাকি স্বপ্নগুলোকেই বাস্তবে রূপ দিতে।