শামীম রুনা:
ভয়াবহ রকম অসুস্থবোধ করছি। বার বারই পাথুরে সি বিচে তাসফিয়ার মুখ থুবড়ে থাকা ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা তাসফিয়াকে আমি ঠিক চিনতে পারি না, আমার প্রিয় ভাগ্নীটির মতো লাগে পেছন থেকে। আমার আদরের ভাতিজির মতো লাগে, আমার মেয়েদের মতোনও লাগে। ওরা সবাই এরকম ড্রেস পরে, ওরা ইংলিশ মিডিয়াম বা ইংলিশ ভার্সন অথবা বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করে।
এরা সবাই বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের সন্তান। ওরা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে, স্মার্ট ফোন তো বিজ্ঞানের যুগের একটি ডিভাইস ছাড়া আর কিছু না। ওদের কেউ কেউ পরিবারের অগোচরে লুকিয়ে ডেটিংও যেতো বা যায়। আমরাও বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি বলে নিজের প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, বা অন্য কারোকে হেল্প করতে সঙ্গী হয়েছি।
গতকালই একজনের ফেবু স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, এখনও এমন অসংখ্য প্রেমিক আছে যারা ভালোবাসার মানুষটির বিন্দুমাত্র ক্ষতি চায় না। আমি এখনও বিশ্বাস করি, বিশ্বাসঘাতকের চেয়ে প্রেমিকই বেশি আছে, প্রেমিকরা দেবদাস হয়ে যেতে পারে, রোমিও হতে পারে, কিন্তু অথেলো হতে গেলেও ওরা ভয়ে শিউরে ওঠে, প্রেমিক কখনও ধর্ষক বা খুনি হতে পারে না।
আমার দুই মেয়ে, পনেরো আর চৌদ্দর সংখ্যার ঘরে বয়স। গত শনিবারেও ওরা দু’জন আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়েছে। টাকা বাঁচানোর ধান্ধায় বাসে উঠনি, দূরের মার্কেটে গিয়েছে পায়ে হেঁটে। সব জমানো টাকায় জাপানিজ রেস্টুরেন্টে দুই বোন গল্প করতে করতে সুশি খেয়েছে, আমি এখন লিখতে লিখতে ওদের কিশোরী মুখের সে হাসি আর আনন্দ দেখছি।
এই শহরে ওদের মতো টিনএজার ছেলেমেয়েরা শনিবারে এ-ই করে বেড়ায়, হয় সাইকেল, স্কুটি বা পায়ে হেঁটে মার্কেট, বন জঙ্গল, কী বিভিন্ন একটিভিটিস পার্কে নিজেদের মতো করে হৈ চৈ আর আনন্দে মেতে উঠে। এভাবেই তো কৈশোর আর তারুণ্যের সময় কাটানোর কথা।
দেশ ছেড়ে বিদেশ আসার সময় আত্মীয় স্বজনরা পই পই করে সাবধান করে দিয়েছিলো, মেয়ে দুইটা বড় হচ্ছে, সাবধানে রাখি যেন। এসব দেশের কালচার-টালচার নাকি ভালো না। মেয়েদের বেয়াদপ হয়ে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বলতে পারছি না, মেয়েরা কতোটা আদবদার হয়েছে, তবে ওরা নিজেদের দায়িত্ব নিতে শিখছে, ভয়হীন পথ হাঁটা শিখছে। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের পছন্দ-অপছন্দ বলতে পারছে- এসব তো মানুষের মৌলিক অধিকার।
আমারও ডিউটি অনেক কমেছে, দেশে থাকার সময় ওদের স্কুলে আনা নেওয়া, কোচিং-এ আনা-নেওয়া করে আমার নিজস্ব শিক্ষা-ক্রিয়েটিভিটি আর কর্ম দক্ষতা সবই বেঘোরে মারা পড়ছিল। যা আমাদের দেশের অধিকিংশ শহুরে শিক্ষিত নারীর নিত্যদিনের রুটিন। বাচ্চার নিরাপত্তার কথা ভেবে ভেবে নারীদের কর্ম দক্ষতা ক্রিয়েটিভিটি সবই নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও কতোটা পারছে মেয়ে কী ছেলেদের নানান রকম ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে!
ইউরোপে এসে বসবাস শুরু করার পর থেকে মেয়েদের জন্য দৈনিক বাড়তি সময় দেয়া থেকে আমি মুক্ত। মেয়েরা নিজের মতো করে সকালে স্কুল বাস, কী পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়া করে। কালচার স্কুলে যায়, ঘন হয়ে পড়তে থাকা তুষারের দিনে রাত করে ওরা একা একা হয় কালচার স্কুল, কী ফুটবল ক্যাম্প শেষ করে বাসায় ফিরে। আমি বাংলাদেশী মা বলে প্রথম প্রথম অযথা ভাবতাম, এখন অভ্যস্ত হয়ে আসছি দিনে দিনে। এখানে জীবনযাত্রাই এমন, রাষ্ট্র সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রেখেছে। তা না হলে মানুষের মতো এমন হিংস্র প্রাণীর কাছ থেকে এতোটা সভ্য আচরণ কী করে পাওয়া যায়!
হয়তো কথা আসতে পারে, রাষ্ট্র তো মানুষেরই সৃষ্ট, হ্যাঁ; রাষ্ট্র আমাদের তৈরি, মাঝে মাঝে আমরা নিজেরাও তো নিজেদের শাসন করি, নিজেদের শুদ্ধি করি। আমাদের দেশের এখন কড়া এক শুদ্ধি অভিযান ভীষণ রকম প্রয়োজন।
এই যে একের পর এক এতো নারী শিশুর প্রতি অমানবিক নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে, কই এসব নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো দায়-দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্র যন্ত্রের ভেতর বাস করেও ভয়াবহ এক অনিশ্চিত জীবন যাপন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সকালবেলা সুস্থ-সবল একজন মানুষ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বলতে পারে না সে ঠিকঠাক বাসায় ফিরে আসবে কী আদৌ ফিরতে পারবে! দুর্ঘটনা ঘটতে পারে কদাচিৎ, তবে দৈনিক ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা কতোটা যৌক্তিক জানি না। যা বাংলাদেশের নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
দৈনিক ঘটে যাওয়া অসংখ্য দুর্ঘটনার ভেতর নারীর প্রতি ভয়াবহ সহিংসতা আমাদের দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতো খুন ধর্ষণ কোনো একটির যদি যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক বিচার রাষ্ট্র করতো, তাহলে এসব ক্রাইম অনেকাংশে কমে আসতো। আমাদের দেশের রাষ্ট্রপ্রধান একজন নারী। মন্ত্রীদের মুখের বরাতে প্রায় শুনি, দেশে সকল ছোট-বড় ডিসিশান তাঁর একার তত্ত্বাবধানে নেয়া হয়। দেশ সম্পর্কে তিনি সবকিছু জানেন, মানে সব খবর তাঁর জানা আছে। নারীদের প্রতি এমন সহিংসতার বিষয়ে তিনি তবে এতো অজ্ঞ কেনো! বাংলাদেশের নারী আজ কোথাও তো নিরাপদ নয়, ঘরে- অফিসে-রাস্তায়-বাস-ট্রেন, কোথাও না।
দেশ ছেড়ে আসায় আমার মনের ভেতর একটি দুঃখবোধ সব সময় জড়িয়ে থাকে। কিন্তু যখন এই সব অমানবিকতা সহিংসতা দেখি, মনে হয় আমি আর কখনও ফিরে যাবো না বুড়িগঙ্গার শহরে। কিন্তু তারপরও দুঃখবোধ আমাকে ছেড়ে যায় না। দেশের মানবিকতার দৈন্যতা দেখে অন্তরাত্মা ভয়ে কেঁদে ওঠে। ওই দেশে আমার প্রিয়জনরা থাকে। খুব সাধারণ কিছু মানুষ থাকে।
তাসফিয়ার মা বাবাকে সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার নেই। তবে যেখানে থাকুক, তাসফিয়া যেন কিশোরীর উচ্ছ্বাস আর আনন্দে ভালো থাকুক।