সুচিত্রা সরকার:
তিতলি,
জানি, তুমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছো। তাই মার্চের তীব্র গরমের পর এখন বর্ষাদিনেও তোমার কোনো সাড়া নেই।
তখন আসতে চাইছিলে। বাঁধা দিলুম। কী করি বলো সোনা! সাধ আর সংগতি কুলোলো না। সাত-পাঁচ ভেবে কিনারা করলাম এই। ভেবো না খুব নিষ্ঠুর আমি। তোমার জন্য সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা জল বরাদ্দ ছিল। যাক সে কথা।
একটা খারাপ খবর আছে তোমার জন্য। বলতে পারো এ তোমার মায়ের সিদ্ধান্তের পক্ষে অমোঘ যুক্তি।
শহরটা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রাজা-রানীকে চিনতে পারছি না। সান্ত্রি মশাইয়ের পোয়া বারো।
একটা গান গুনগুন করেছিলাম! মনে আছে? ডি. এল. রায়ের?
মামনি, এখন থেকে সংক্ষেপেই অনেক কিছু বুঝে নিতে হবে। ডি. এল মানে দ্বিজেন্দ্র লাল। আর এস. ডি মানে শচীন দেব।
ডালপালা ছেড়ে মূল গল্পে ফিরি। ডি. এল রায়ের এমন দেশটি কোথাও খুঁজে… গানটা শুনে তুমি জানতে চেয়েছিলে, ‘মা কেন এমন দেশ আর কোথাও পাবো না? তুমি কি আর খুঁজেছো কোথাও?’
আমি দেশপ্রেমে অন্ধ। তোমাকে কীসব বলেছিলাম। বুঝিয়েছিলাম। তুমি তো জানো, তোমার মায়ের অনেকগুলো তাল গাছ আছে। সবগুলো এক পায়ে খাঁড়া।
আজ বলছি সত্যি, এমন দেশটি আর কোত্থাও পাবে না।
কেন? কেন? কেন?
মনে নেই গত বছরের কথা? তারেক মাসুদের মামলাটার কথা? ওই যে পরিবহন মালিকরা ক্ষেপে গেল। তারপর এক নারীর উপর ট্রাক উঠিয়ে দেয়ার আরেক মামলায় ফাঁসি হয়ে গেল আসামির!
তারপর কী হলো? ওরা ডেকে দিল ধর্মঘট। সারা দেশজুড়ে। তোমার মা রিকশায় করে কল্যাণপুর গেছে পরীর মতো ডানা উড়িয়ে। আর ফেরার পথে ভেবেছিলাম, ‘দেশ পাহারায় সদা প্রস্তুত লোকজন’ তাদের নিজস্ব গাড়িগুলো নামিয়ে দেবে! জনকল্যাণে!
হাহ্।
সেসব কিছু নয়। চললো বৈঠক। আজগুবি সব পরিবহন নিয়ম বরাদ্দ হলো জনগণের জন্য।
তারপর আরেকটা ঘটনা। ওই যে গয়নাওয়ালার-ছেলেটা ধর্ষণ করলো এক পার্টিতে-সেখানেও কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোলো। অবৈধ সোনা দানার বিস্তর ছড়াছড়ি! এরাও ধর্মঘট ডেকে দিল। সোনার দোকান বন্ধ!
তাতে যার যাবার, তার গিয়েছে। তোমার মায়ের কচু হয়েছে। সে সোনা পরে না। তবু ভাবো ব্যাপারখানা। দোষ ধরতে গেলেই, দুর্বল জায়গায় আঘাত!
তারপর ধরো চিকিৎসার ভুলে রোগী মারা পড়লো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সব সময় ‘আঠারো বছর বয়স’। জানো তো! মাথা গরম! ঝাঁপিয়ে পড়লো অনিয়মের বিরুদ্ধে।
ব্যস! আর যায় কই! চিকিৎসা টিকিৎসা বন্ধ। আই.সি.ইউ র রোগীরা কী করছিলো তখন?
তারপর আবারো বৈঠক করে তাদের মানানো গেল।
হঠাৎ করে ছ’ সাত মাস আগে চালের দাম বেড়ে গেল। ষাট থেকে সত্তর। চল্লিশেরটা উঠে গেল ষাটে।
খুব লেখালেখি হলো। টিভিগুলো পেয়ে গেল ‘গরমাগরম’ কপচানোর আইটেম (আইটেম মানে হলো বিষয়বস্তু। বাবু এবার ইংরাজিটা একটু শেখো টেখো)।
এখন কপচানো বন্ধ। পত্রিকাগুলোর ইস্যু ভিন্ন। তবে এখনও জনগণের বাজারে গমন বন্ধ হয়নি। তারা থলি ভরে বাড়ি ফিরছে। হয়তো তারা সকলেই আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেছে। নইলে ‘চল্লিশের চাল ষাটে, এতো হুজ্জতি হলো। এবার যে সত্তরের ঘরে উঠলো, প্রজা নিশ্চুপ কেনো?
অথবা হতে পারে প্রত্যেকের বাড়িতে একটা করে যক্ষের (মানে পরে বলবো) ধন আছে। না হলে প্রজার পিঠ এখনও দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। তাই শহরটাকে বেনিয়ারা পেয়ে বসেছে।
সবক’টা গোষ্ঠী বুঝে গেছে, জনগণ নরম। তোমার মিষ্টি গালের মতোই কোমল। তোমার গালে চলে আদর। আর জনগণের উপর অত্যাচার। বুঝে গেছে তাহারা।
তাই বলছি, এ শহর তোমার মায়ের নয়। তোমার তো আরো নয়!
সেদিন ছেলেরা রাস্তায় নেমেছিল। সেই আঠারো বছর যাদের বয়েস! অনেক কালের দমিয়ে রাখা পুঞ্জীভূত মেঘকে তারা বৃষ্টি করে ছেড়েছিল। বর্ষণে রাস্তার কাঁদা ধুয়ে গেছিল। টিয়ারসেল ঠুকুস-ঠাকুস।
বন্দুকের নলে পেতে দেয়া বুক।
তারপর যেই কে সেই! ষড়যন্ত্র। আন্দোলনের বিরুদ্ধে। হীরক রাজা নমুনা হিসেবে দু’একটা ইঁদুর মেরে ঝুলিয়ে রাখলো বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে!
তাই দেখে আমরা ভয়ে অস্থির। রাজা সুখে নিদ্রা যান।
এই সুযোগে এসো মা-মেয়েতে কবিতা পড়া চলুক!
ভালো কথা, যে দুটো বই পাঠানো হলো কুরিয়ারে, পড়েছো? একটা মুহাম্মদ জাফর ইকবালের। হুম মহাকাশে মহাত্রাস।
এখন বাংলাদেশেই মহাত্রাস। স্বয়ং তিনি ছোরার স্পর্শ পেয়েছেন। তবে সুসংবাদ এই, তুমি তাঁর আরো নতুন বই পড়তে পারবে, এ কারণে তিনি এ যাত্রায় গঙ্গা পার হননি।
সদ্য সদ্য একটা বিখ্যাত ধারায় আরো কয়েকজন ফেঁসে গেল। ব্যাপারখানা এই, তাদের মতের সঙ্গে এক পক্ষের মত মেলেনি। অমিল হলেই এদেশে শূলে চড়ানো হয়। চড়ানোর কৌশল ঠিক করাই আছে।
এদেশে- ওদেশে, সারা এশিয়ায় এখন ধর্মের খুব বাড়-বাড়ন্ত। তার কোপে কে বাঁচে, কার মৃত্যু লেখা আছে, কে জানে!
আসছে পঁচিশে বৈশাখ। আসছে রবি’র দিন। মনে আছে সোনা? গেল বারের আগের বার। পঁচিশে বৈশাখে ছায়ানটে গেলাম। তুমিও লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সঙ্গে। অন্তরাত্মা হয়ে।
তাসের দেশ দেখলাম তিনজনে। বাড়ি ফিরে আমি চারটা লাইনই গুনগুন করছিলাম। কি বলো দেখি!
হুম।
চলো নিয়ম মতে… দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো।
তুমিও যথা নিয়মে চৌকস। উত্তর দিয়েছিলে-হেরো অরণ্য ওই, ওথা শৃঙ্খলও কই, পাগল ঝরণাগুলো দক্ষিণও পর্বতে।
সেদিন তোমায় তার ফিরতি জবাব দিইনি। আজ বলছি মা, ওদিক চেয়ো না। যাবার প্রশ্নই উঠে না। শহরে আজ বেজায় বাষ্প!
ভয় করছে? তাহলে তোমার ঠোঁট কাঁপছে কেন মা? অভিমানে?
কেঁদো না সোনা। সুদিন ফিরুক। সকলে প্রাণ খুলে হাসুক। তোমার কবিতার বইগুলোও রোদের ঝিকমিক লাগুক। তোমাকে নিয়ে আসবো এ শহরে।
যে শহরে সোডিয়াম আলোয় এক সময় প্রেম ছিল। প্রাণ ছিল। প্রেরণা ছিল। ততদিন ভালো থেকো। চিঠি লিখো মাকে, অভিমান ভুললে!
ইতি
তোমার মা
০২.৫.২০১৮
রাত ১১. ৪৫ মিনিট
লালবাগ, ঢাকা