তানবীরা তালুকদার:
দুই বাংলা’র প্রাত্যহিক জীবনে ভাষা রীতি (প্রমিত নাকি কথ্য), খাদ্য রীতি (পোস্ত আর কালো জিরার বাড়াবাড়ি, না পেঁয়াজ-রসুনের কড়াকড়ি), মেট্রো-ট্যাক্সি-টানা রিকশা না সিএনজি চালিত অটো, সাইকেল রিক্সা আর সিটিং বাস সার্ভিস এ রকমের বহু জিনিসে বহু পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রীতি রেওয়াজ, ঐতিহ্য এবং ধর্ম রক্ষার মৌলবাদী মানসিকতার সাদৃশ্য কিন্তু লক্ষ্যণীয়।
কখনও কোনো মেয়েকে কোনো বখাটে যুবক উত্ত্যক্ত করার অপরাধে শুনেছেন কোনো মুরুব্বী রাস্তায় বা বাসে এগিয়ে এসেছে? কোনো মেয়েকে নির্যাতন করার সময় তারা কি আদৌ বাড়ি থাকে? কোনো মেয়ে ধর্ষিণের হলে তাদের পাওয়া যায় ত্রি-সীমানায়? ভিড়ে’র মাঝে যখন মেয়েদের গায়ে হাত পরে, তখন চাচা মিয়া বা কাকাবাবু’রা কোথায় থাকে? উল্টো মেয়েদেরই ধরে তারা চার কথা শুনিয়ে দেবেন। সন্ধ্যেবেলা কেন বাড়ি থেকে বেরিয়েছো? একা বের হও কেন? জিন্স কি মেয়েদের পোশাক? ওড়না কোথায়! সামলে চলতে পারো না?
প্রকাশ্যে দুটো ছেলেমেয়ে হাত ধরে চলা তাদের চোখে অশালীন, চুমু খাওয়া অপরাধ। এমনকি পার্কে বসে গল্প করলেও তাদেরকে পুলিশ ধরতে আসে। ধর্ম, সংস্কৃতি, শালীনতা, সমাজের “নৌকাডুবি” একেবারে যাকে বলে ভরাডুবি হয় তার। অথচ যত্রতত্র থু থু ফেলা, মলমূত্র ত্যাগ করা, এমনকি মেয়েদের দেখিয়ে যখন বখাটেরা জিপার খুলে রাখে, এবং ঘুষ খাওয়া মোটেও অপরাধ নয়, চুমু খাওয়া অপরাধ! বিচিত্র সভ্যতাবোধ!
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাই বার বার বলতে হয়, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।
ভাবছেন ছন্নছাড়াভাবে কী বকে যাচ্ছি! ঐ যে বলছিলুম, পাশের বাড়ি’র ঐ কাকাবাবু’র কথা আর কী! বিতর্ক প্রিয় বাঙালি যে কোনো একটা বিষয় পেলে বিতর্কে নেমে পড়ে, আর সাথে সাথে জমে ওঠে ফেসবুক। এই মুহূর্তে “প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া আর না খাওয়ার” বাঙালি কৃষ্টি কালচার !!!! নিয়ে ধুন্ধুমার লেগে রয়েছে। যেন এর ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিরাট কিছু অর্জন নির্ভর করছে।
একে হয়তো বলা যায়, নেই কাজ তো ফেসবুক ভাজ। একদল মানুষের আলোচনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, বাঙালীদের শত শত বছরের পুরনো সংস্কৃতি, পবিত্র ঐতিহ্য “চুমু”র মতো একটা অপবিত্র জিনিস যোগ করে সে পবিত্রতা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। বাঙ্গালীরা বছরের পর বছর চুমু খাওয়া ছাড়াই বংশ বৃদ্ধি’র কাজটি করে যাচ্ছে। গাউছিয়া, বইমেলা, বৈশাখী মেলার ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া বঙ্গ পুঙ্গবদের বাংলাদেশি সংস্কৃতি চেতনা এখন ফেসবুকে তুঙ্গে অবস্থান করছে।
বাস্তবতা হলো, সংস্কৃতি, ভাষা এগুলো কখনো এক জায়গায় আটকে থাকে না। জীবন বহমান, তার সাথে বয়ে যায় সময়। সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতি, ভাষা এগুলো বদলে গেছে এবং সামনে আরো যাবে। সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সাহিত্য, পোশাক, খাবার, গান যা কিছুকেই ধরি না কেন, পঞ্চাশ বছর আগের জায়গায় যেমন আমরা আজ আর নেই, পঞ্চাশ বছর পরও জীবন এখানে থেমে থাকবে না।
পঞ্চাশ বছর আগে হিজাব ছিলো না, জিন্সও ছিলো না সেভাবে, ভ্যালেন্টাইন ডে ছিলো না, এখন এসব বাইরের জিনিস এসে আমাদের জাতীয় জীবনে জড়িয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর পরে আরো বহু জিনিস আমরা তুলে নিবো বাইরে থেকে, এই পরিবর্তন রোধ করা অসাধ্য। নতুন পুরাতনের কিংবা রেওয়াজ ভঙ্গের এই লড়াই চিরন্তন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর হয়তো দুজন তরুণ-তরুণী বাইরে কোথাও চুমু খেলে সেটা চোখ আর মনকে এতো জোরে ধাক্কা দিবে না। তাই গেলো গেলো হায় হায় রবও হয়তো তখন থাকবে না। কোন দিন এই দেশে এই নিয়ে এতো হৈ চৈ হয়েছে জেনে তারা হয়তো তখন আর্শ্চয হবে। জীবনের এতো স্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে কেন এতো বির্তক ছিলো তার কারণটাই হয়তো তারা খুঁজে বের করতে পারবে না।
এক সময় বাবা মায়ের সামনে “প্রেম ভালবাসা” শব্দ গুলো মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা গর্হিত ছিলো। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এখন বাবা মা অনেক ক্ষেত্রে নিজেই জিজ্ঞেস করে, “তোমার নিজের কোন পছন্দ আছে?” এক সময় বাড়িতে লুকিয়ে ছেলেরা সিগ্রেট খেতো। আজকাল বাবা নিজ থেকে বলে, যা করার আমাকে বলে করো, দরকার হলে ভাল ব্র্যান্ড এর সিগ্রেট আমি কিনে দিবো, বাজে জিনিস খেয়ে ফুসফুস নষ্ট করো না। আগে অনেকে বাবা-মাকে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে যেতো, এখন পুরো পরিবার একসাথে সিনেমা দেখতে যায়। শাশুড়ি-বউ একসাথে কেনাকাটা করতে কিংবা সৌন্দর্য চর্চা করতে রূপ চর্চা কেন্দ্রে যায়। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে, দেখুন তো পাশে চেয়ে, চেনা জগতটা বদলাচ্ছে কী না?
যারা নিজেদের যুক্তির পক্ষে ঝোল টানতে বার বার বিদেশিদের পারিবারিক বন্ধন আর তাদের সংস্কৃতি ধরে টেনে বাপ বাপান্ত করছে, তাদের বিনীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করছি, কোনো বিদেশিকে শুনেছেন ভাইয়ের গলায় ভাই সম্পত্তির লোভে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে? বাসে, মার্কেটে সুযোগ পেলে মেয়েদের গায়ে হাত দিতে? অসুস্থ বাবা-মাকে অবহেলা করতে?
বিদেশি বলতে এখানে পাশ্চাত্যকে বোঝানো হচ্ছে ধরে নিচ্ছি, আরব বা আফ্রিকাকে নয়। পাশ্চাত্য যেহেতু সমস্ত অপকর্ম আড়াল করার জন্যে ঢাল হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে না, তাহলে তাদের সমাজ ব্যবস্থা টিকে আছে কীসের ওপর? তাদের নীতিবোধ আর তাদের দায়বদ্ধতা তাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে এতো নিরাপদ আর অটুট করে রেখেছে বিদেশ থেকে শত শত লোক তাদের এই শৃঙ্খলার সুফল ভোগ করার জন্যে দিন-রাত এখানে পাড়ি দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
যতো বার সৎ, নিরাপদ, উন্নত জীবন যাপনের দেশের তালিকা হয়, তারা সর্বোচ্চ স্থানটি দখল করে থাকে, কী সে মন্ত্রের জোরে? সারা জীবন শুনে এসেছি বিদেশে যা ইচ্ছে তাই করা যায়, কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, একজনের বিনা অনুমতিতে অন্যজন তার গায়ে হাত দেয়া এখানে আইনত দণ্ডনীয়, কেউ সেই সাহসও করে না। আর ছোটবেলা থেকে এদেরকে এভাবে সহবত শেখানো হয় যে তারা এটা কখনো ভাবনাতেও ঠাঁই দেয় না। অথচ অটুট পারিবারিক বন্ধনের গৌরবমণ্ডিত সম্মানিত ব্যক্তিরা বাংলাদেশে তা অহরহই করে, বাঙালি কিংবা পাহাড়ি কাউকেই ছাড়ে না।
বিদেশি বাবা মায়েরা যেমন বাচ্চাদের সামনে “চুমু” খায় না, ঠিক তেমনি বাচ্চারাও তাদের বাবা মায়ের সামনে “চুমু” খায় না। প্রত্যেক স্বাভাবিক বিদেশি তাদের স্বাভাবিক জীবন স্বাভাবিক ভাবেই যাপন করে, ঠিক যেমন দেশি মানুষেরা করে।
প্রতিদিন এই আলোচনা পড়তে যেয়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল মানুষের বিভিন্ন ফরম্যাটের রক্ষণশীলতার বিভিন্ন মূর্তি দেখতে পাচ্ছি। সবিনয় জিজ্ঞাসা, এতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী আসলেই এটা? যার ইচ্ছে হবে সে চুমু খাবে, আর যার বাধো বাধো ঠেকবে সে খাবে না, দেখতেও যাবে না। তাই নয় কি? বিষয়টার সাথে কী কোথাও “ব্যক্তি স্বাধীনতা” ব্যাপারটি জড়িয়ে নেই? স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে ভারতবর্ষ, পূর্ণ বয়স্ক একজন ব্যক্তি মানুষ এ দেশে কবে স্বাধীন হবে? তার নিজের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব তার নিজের। যা দিয়ে কারো ক্ষতি হচ্ছে না তা করতে বাধা দেয়ার অন্যেরা সবাই কে?
বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি নিয়ে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পরা দেখে কবি আবুল হাসানের কবিতার শিরোনাম মনে পড়ে যায়, “একদিন সবকিছু ইস্যু হয়ে যায়” …… হ্যাঁ বাঙালির হাতে পড়লে সমস্ত কিছু ইস্যু হয়ে যায় বটে, কিন্তু কেন? দেশে কী আর কিছু নেই আলোচনার করার মতো?
জয় হোক তারুণ্যের।