কয়লার ময়লা না যায় ধুলে

তামান্না ইসলাম:

ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা অনেকের কাছেই ডাল-ভাত, তাই না? আমরা কেউ সুন্দর মুহূর্ত ধরে রাখতে চাই স্মৃতির পাতায়, কেউ অন্য কারো সাথে ভাগ করে নিতে চাই আনন্দ, কেউ লোক দেখাতে চাই, কেউ সুখী হওয়ার ভান করতে চাই। এই উদ্দেশ্যগুলোর কোনটাই কিন্তু খুব সাঙ্ঘাতিক রকমের অপরাধ নয়।

কেউ কেউ আছে প্রতি মুহূর্তে যত্রতত্র ছবি তুলে। তারপর সেই ছবি পোস্ট করে অনেকের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটাকেও আমি অপরাধ মনে করি না, এটা এক ধরনের সামাজিক মেলামেশার অংশ হয়ে গেছে এখন। কিন্তু এই ছবি তোলার সময় আমরা কতটা সাবধান থাকি?

আমরা সাবধান থাকি এই নিয়ে যে ছবিটা সুন্দর হচ্ছে কিনা, কিন্তু আমাদের চারপাশে কী আছে সেটা নিয়ে না। এই ছবিগুলো পোস্ট করার পর আমাদের বন্ধু ছাড়াও সেগুলো আর কে কে দেখতে পাচ্ছে সেটা নিয়েই বা ভাবে কয়জন! আমার স্বীকারোক্তি, আমি অতোটা ভাবতাম না। এইজন্য প্রায়শই আমার বরের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে।

হয়তো বাচ্চাদের স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে গিয়েছি, আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে ছবি তুলছি, আমার বাচ্চা গান করছে, নাচছে , পুরস্কার নিচ্ছে। আশে-পাশে আরও দশটা বাচ্চা আছে একই ছবিতে। আমি কখনই ভাবি নাই, এই বাচ্চা বা তার বাবা, মা কী চায় ওদের ছবি আমি শেয়ার করি? আমি কখনো ভাবি নাই, আমার মেয়ের পাশের মেয়েটি হয়তো বেশি স্বাস্থ্যবতী (সেক্সি কথাটা লিখতে খারাপ লাগছে মেয়ের বান্ধবীদের নিয়ে, কিন্তু শব্দটা আসলে তাই হবে), সেই ছবি দেখে মানুষ শুধু কুচিন্তা করেই ক্ষান্ত হবে না, উচ্চশিক্ষিত কিছু ফেসবুক বন্ধু, বা বন্ধুর বন্ধু এই লাগামছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে তা নিয়ে রসালো আলোচনা করতেও হয়তো দ্বিধা করবে না।

আমি এগুলো কিছুই ভাবতাম না সেইদিন পর্যন্ত যেদিন আমি নিজে দেখলাম আমার এক ফেসবুক বন্ধু একটি ছবি পোস্ট করেছে যে তারা বেড়াতে যাচ্ছে। স্বামী, স্ত্রীর নির্দোষ সেলফি। ভীষণ স্বাভাবিক, তাই না? তাদের পেছনে একটি মেয়ে ছিল সেই মুহূর্তে, সেটাও স্বাভাবিক। মেয়েটা না জেনেই তাদের ছবিতে ঢুকে গেছে। হ্যাঁ, সে তরুণী। হয়তো মাঝারি মানের সুন্দরী (ফিগার ভালো), আর পরনে পশ্চিমা পোশাক, খুব সাধারণ ধরনের, জিনস আর মনে হয় ফতুয়া বা শার্ট। এরকম ছবি আপনারা হরহামেশা পোস্ট করেন না? আমি কিন্তু করি। কারণ আমি জানতাম না সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মেয়ের ছবি নিয়ে কী পরিমাণ রসালো আলোচনা চলতে পারে। বলতে পারেন, মেয়েটি তো জানছে না, অসুবিধা কী?

কিন্তু ভাবুন তো, তার কোন কমন ফ্রেন্ডের চোখে সেটা পড়তে পারে। পড়তে পারে তার বাবা, ভাই, স্বামী, বন্ধু যে কারো চোখে। তখন তার কেমন লাগবে? মনে রাখবেন, এই অন্যায় কিন্তু হচ্ছে সারাক্ষণ, এমনকি এটাকে ফান বলে চালিয়ে অনেকে অপরাধই ভাববে না। আপনিও এর শিকার হতে পারেন যে কোন দিন।

হয়তো বলবেন, আমি পশ্চিমা পোশাক পরি না, ওগুলো উগ্র। না আপনিও নিরাপদ নন। কিভাবে? এবার আরেকটি ছবির কথা বলি। একজন নামী আলোক চিত্রশিল্পী কিছুদিন আগে তার টাইমলাইনে একটা ছবি পোস্ট করেছেন। সম্ভবত লালবাগ কেল্লায় তিনজন আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা মেয়ে, তাদের সামনে তিনজন ছেলে। আমি এই ছবির মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু অনেকেই আধুনিকতা প্রমাণের জন্য দেখলাম বেজায় আহা, উহু করলো। অনেক মায়া ঝরলো, ইসলাম কীভাবে নারীকে এই যুগে এই পোশাক পরতে বাধ্য করছে, সেই মায়া কান্নাও হলো, হাসাহাসি হলো।

আর আমি অবাক হলাম। সেই শিল্পী বা আধুনিক শিক্ষিতরা কিভাবে শিওর হয়ে গেল মেয়েগুলোকে জোর করে এই পোশাক পরানো হয়েছে? আমি নিজে দেখেছি, ফ্যাশনেবল মায়ের মেয়ে হিজাব করছে, স্লিভলেস পরা মায়ের ছেলে বিয়ে করেছে নিকাব পরিহিতা মেয়েকে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, যেই মেয়ে নিজের দেহ ঢাকার জন্য বোরখা পরেছে, কোন ধরনের সভ্য মানুষের অধিকার আছে অনুমতি না নিয়ে লুকিয়ে ছবি তুলে পাবলিকে সেই ছবি ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির সেই অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করার?

ছবিটি তোলা হয়েছে খোলা মাঠে, তার মানে মাননীয় শিল্পী লুকিয়ে থেকে জুম করে ছবিটি তুলেছে, কারণ তারা বোরখা পরা, তাই তারা চিড়িয়াখানার প্রাণী। আহা, সমাজের উন্নতি করার জন্য শিল্পী সাহেব রিস্ক নিয়ে চুরি করে ছবি তুলেছেন, কত বড় বাহবার কাজ।

সুতরাং সাবধান, নারী তুমি যে বেশেই থাকো না কেন, লুকিয়ে থাকা ক্যামেরা এড়ানোর গ্যারান্টি নেই। অচেনা মানুষের সামনে তোমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আলোচনা এড়ানোর পথ নেই, তুমি না চাইলেও নেই। যারা তোমার অধিকার নিয়ে লাফায়, তারাও অনেক সময় তোমার অধিকার কেড়ে নেয় নিজেদের স্বার্থে।

এইবার আসি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে। দেশে যেয়ে উবার দেখে আমি ভীষণ আশান্বিত। পাঠাও দেখে আরও বেশি। তবে বার বার ভাবছি মেয়েদের কী হবে? আমি আধুনিক কিনা জানি না, তবে আমার ব্যক্তিগত চয়েস হলো, আমি জাপটে ধরে অচেনা পুরুষের সাথে মোটর সাইকেলে বসতে রাজি না। এটা আমার চয়েস, এই ব্যাপারে আমি কারো উপদেশের তোয়াক্কাও করি না। এখন আমার বর মজা করে সারা ঢাকা চষে বেড়ালো পাঠাও এ, আমি তো পারলাম না। কয়েকদিন আগে দেখলাম আমার চিন্তার অবসান করে আসছে ‘সেবা’ আর ‘বোন’ নামের দুটি অ্যাপ, যাতে মেয়েরা স্কুটি চালক।

আমি যে কী খুশি হয়েছি, সেটা আমিই জানি। আমার খুশিকে পণ্ড করে দিল যে খবরটি শেয়ার করেছে সে। তার ক্যাপশন ছিল সুড়সুড়ি দেওয়া। আর কমেন্টগুলো পড়ে আমার মনে হচ্ছিল, বাইক চালক তো নয়, কিছু বেশ্যা নিয়ে তারা কথা বলছেন এবং সবার জিভ দিয়ে লালা ঝরছে। এরা সবাই ভদ্রলোক, উচ্চ শিক্ষিত।

আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড সংখ্যা সীমিত। এর অন্তত ৩০-৪০% ভাগ ইঞ্জিনিয়ার। ৮০% বা তারও বেশি তথাকথিত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, নামী দামী ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটধারী। আমাকে যদি এগুলো দেখতে হয়, তাহলে আমরা কই যাবো? তাহলে আমাদের শিক্ষা আমাদেরকে কী শিখিয়েছে? শিক্ষা কী কোনদিন পারবে আমাদের মনের এই কয়লার ময়লাগুলো ধুয়ে দিতে?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.