নাঈমা মৌ:
জীবনে যন্ত্রণার তো শেষ নাই, তাই যতটা পারি দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা হজম করেই চলি। কিন্তু মাঝে মাঝে হজম করাটা সত্যিই সম্ভব হয়ে ওঠে না। আজকে সে রকমই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে অফিসে এলাম।
শুরুটা ছিল ভীষণ এক দু:স্বপ্ন দিয়ে। ভোর চারটার দিকে ছেলেকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে। ধড়মড় করে উঠে পানি খাই। একছুটে বিছানা থেকে নেমে ছেলের ঘরে গিয়ে ওর মুখটা দেখি, শান্ত হই কিছুটা। কিন্তু পরে আর ঘুমাতে পারিনি। সকাল হয়ে যায়। উঠে ঘরের কাজ, বাজার, রান্না, নিজের অফিসের প্রস্তুতি সব সেরে বের হতে যাবো, আকাশ কালো করে অন্ধকার নেমে এলো। ব্যাস! বের হতে পারলাম না। হাঁ করে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বসে থাকলাম।
প্রায় একঘন্টা বৃষ্টি শেষে, আকাশ তার কালো মুখে একটু আলো ছড়াতেই তাড়াহুড়ো করে ছয়তলা থেকে নেমে এলাম। গেটে একটা খালি রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে দেখে খুশিই হলাম। না কি জিন্সের প্যান্ট-শার্ট, পায়ে কেডস পড়া আমাকে দেখে মাঝবয়সি রিক্সাওয়ালাই বেশি খুশি হলো, কে জানে!
যাই হোক। তার সেই জঘন্য চাহনি এড়িয়ে আমি তখন বাস পর্যন্ত পৌঁছানোর চিন্তায়। বলে রাখি, আমি থাকি মিরপুর ৬ নাম্বরে। সেখান থেকে মহাখালি যেতে হলে ১০ নাম্বার গোলচত্তরে গিয়ে বাসে উঠতে হয় অামাকে। এমনিতে ঝড় বৃষ্টি না থাকলে হেঁটেই চলে যাই। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে- আজ এই টেনশনে দ্রুত রিক্সাটায় উঠতে চাইলাম। বলা মাত্রই রিক্সাওয়ালাও রাজি হলো। তো, ছাতা গুটিয়ে যেই না রিক্সায় উঠতে যাবো, হুট করে কোত্থেকে এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলেন। আমি তো থ। মহিলাকে সুন্দর করে বললাম, এটায় আমি যাবো বলে ঠিক করেছি। আপনি! উনি অবাক হয়ে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি না আপনাকে বললাম যাবো! রিক্সাওয়ালা তখন তার পান খাওয়া ৩২ পাটি দাঁত বের করে আমাকে বলে ‘আমি ভাবসি উনি যাইবো না।’ কেমনটা লাগে! এমনিতে দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর সময়ের এই অপচয়। সহ্য হয়! একরাশ বিরক্তি নিয়ে হাঁটা ধরলাম।
কয়েকমাস আগে করা সার্জারির কারণে এখনও আগের মতো দ্রুত হাঁটতে পারি না। তাছাড়া বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি রাস্তা! পিছলে পড়ার ভয় তো আছেই। এদিকে অফিস দেরির চিন্তাটা ভেতরে ভেতরে বাড়তে থাকে।
যাই হোক। ১০ নাম্বারের মেইনরোডের ফুটপাত পর্যন্ত গিয়ে রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখে অসহায়বোধ করতে লাগলাম। দেখলাম, ফুটপাত থেকে নেমে বাসে উঠার জন্য যেটুকু দূরত্ব হাঁটতে হবে, সেটার পুরোটাই নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ডুবে আছে। অর্থাৎ বাসে উঠতে হলে আমাকে ওই পানিতে পা ডুবিয়ে মাঝ রাস্তায় গিয়ে তারপরেই উঠতে হবে।
গোসল করে বেরিয়ে এখন এই নোংরা পানিতে পা ডুবাতে হবে- ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠে, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে থাকে। জীবনটাকে অসহ্য মনে হয়। কিছুক্ষণ দম নিই আমি। নিজের সঙ্গে কথা বলে নিই ওই সময়টায়। বারবার নিজেকে বলি, ‘শান্ত হও মৌ। অফিসে যেতে হবে তোমাকে..’।
বাস্তবতায় ফিরে আসি। দেখি, একের পর এক বাস চলে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। কোনদিকে পানি কম সেটি বুঝতে ডানে-বাঁয়ে তাকাই। চোখে পড়ে একটু দুরে, ফুটপাতের বামপাশে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোর মাথা ঢেকে দেয়া পলিথিনের ছাউনিতে আশ্রয় নেয়া বিভিন্ন বয়সের একদল পুরুষ আমার দিকে ‘ক্যামন মজা’ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমি ইগনোর করি। এগিয়ে যাই সেইদিকেই। কারণ ও দিকটাতেই অল্প পানি। বাসে উঠা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। এগিয়ে গিয়ে লোকগুলোর পেছন ফিরে রাস্তা পার হবার উদ্যোগ নিই। অার ঠিক তখনই! তখনই মনে হলো, এক বালতি পানি কে যেন আমার ছাতার ওপর ঢেলে দিলো। পানির ভারে মুহূর্তেই ছাতা কাৎ হয়ে গেলো, আর আমি অনেকটাই ভিজে গেলাম। কী ঘটলো বুঝতে পেছনে ফিরে দেখি ৫০/৫৫ বছরের এক লোক ওই টং দোকানের মাথা ঢেকে রাখা পলিথিন কাৎ করে ধরে আছে। আর সেখানে জমে থাকা একগাদা বৃষ্টির পানিতে আমি ভিজছি। আমার এই অবস্থা দেখে তিনি হেসে লুটোপুটি। আর তার ডানে-বামে ভদ্র পোশাকের অন্য লোকগুলাও দারুণ এক সার্কাস দেখছে যেন!
উফফ! মুহূর্তেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। ওই লোকের কুৎসিত হাসি সহ্য করতে পারলাম না। বেহুঁশ আমি সোজা তার সামনে গিয়ে দুই গালে কষে দুই চড় মারি। মার খেয়ে হারামজাদা কাঁপতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকি শয়তানগুলা থমকে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়।
আমি বলি কেন করলি এইরকম, বল। কেন করলি? সে কাঁপতে কাঁপতে বলে আমি দেখি নাই, আপনেরে। আমি চিৎকার করে বলি দেখিস নাই আমাকে? বদমাইশ! সে তখন বিড়বিড় করে বলতে থাকে ‘আপনের মতো আমার একটা মেয়ে আছে।’ এইটা শোনার পর ইচ্ছে করে, ওরে জুতা পেটা করি। কিন্তু সেই ইচ্ছেটায় আপাত ক্ষান্ত দিয়ে বলি, তোর মেয়ে আছে আমার মতো? তো, সেই মেয়েকে রাস্তায় এভাবে অপদস্থ করিস তুই? চড় চলতে থাকে বৃষ্টির মতো। কতক্ষণ মারসি বদটারে মনে নাই।
এরপর কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলতে শুরু করি। মাথার মধ্যে কেবলই ঘুরতে থাকে অফিস দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিস দেরি হয়ে যাচ্ছে..