‘মাকে আমার পড়ে না মনে ‘- ১

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

মা! মাগো, ওমা, মা!

ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে শহরটা। বৃষ্টির এমন একটানা মুখরতা চিরকাল আমার মন খারাপ করে দেয়। আমার ভালো লাগে রোদ ঝলমলে উজ্জ্বল দিন। তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা।
আকাশে মেঘ জমতে দেখলে তুমি সেই মেঘের সঙ্গী হয়ে যেতে। বৃষ্টি দেখার জন্য তোমার নিজস্ব প্রস্তুতি থাকতো, আয়োজন থাকতো। তুমি তখন মেঘের প্রেয়সী। নিবিষ্ট চিত্তে বৃষ্টির অঝোর ধারা উপভোগ করতে দেখেছি তোমাকে। হারমোনিয়ামে বসে গান গাইতে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানের কথা – সুরে উদ্ভাসিত হতো তোমার দিনলিপি।

তোমার স্পর্শে বাড়িটা বারো মাসই সবুজ থাকতো। তবুও বর্ষার সতেজ সবুজের প্রতি তোমার ভালোবাসাটা ছিল পক্ষপাতিত্বের পর্যায়ে। আমি বলতাম, “ওমা! তোমার গাছের পাতারা এমন চকচকে, মসৃণ কীভাবে হয়? মনে হয় যেন তুমি রোজ মুছে রাখো! ”

অবাক লাগে তুমি চলে যাবার পর থেকে এ বাড়ির প্রতিটি বৃক্ষ – তরু- তৃণলতা কেমন মলিন,বিবর্ণ! অথচ এমন নয় যে ওদের নিয়মিত পরিচর্যা হচ্ছে না। গতব ছর যে গাছগুলো ফলের ভারে নুয়ে পড়ছিলো, এবারে তাতে অনেক উঁকিঝুঁকি দিলে একটা দুটো ফলের দেখা মেলে।

তোমার কাজগুলোও একইরকম বিষণ্ণতায় ভুগছে। আগে তো কোনোদিন এ বাড়িটা এমন নিষ্প্রাণ ঠেকেনি! বরং নিষ্প্রাণ মরা কাঠ আর শুকনো ডাল – লতা- পাতারা প্রাণবন্ত হয়ে হেসে উঠেছে তোমার মমতায়। মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কে এমন আত্মার টান থাকে তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।

তোমার শোবার ঘরে মাথার কাছে জানালায় তাকালে গোলাপি ফুলে ছেয়ে থাকা কামরাঙা গাছটার কথা মনে পড়ে? পাকা কামরাঙার লোভে দুটো সবুজ লেজঝোলা টিয়া সাতসকালে হাজির হতো। সুযোগ পেলে বুলবুলি দুটোও কামরাঙায় ঠোঁট ডুবিয়ে বসে থাকতো। আমি চুপিচুপি ছবি তুলে তোমাকে দেখাতাম। তুমি একটু পরপর সেই ছবি দেখে আহ্লাদে আটখানা হতে। ওরাও আজকাল আর আসছে না, জানো তো! আসবে কী! গাছে কামরাঙা নেই, তোমার ঘ্রাণ নেই – তা কী ওরা বুঝতে পারে না?

তোমার মাথার কাছে যে কোকিলটা রাত দুটো থেকে ব্যাকুল সুরে ডাকতো, তুমি চলে যাবার পর বেশ কিছুদিন ডাকাডাকি করে ক্লান্ত হয়ে দূরের কোনো গাছে আশ্রয় নিয়েছে বোধ হয়।
নীল ফুলে সেজে থাকা অপরাজিতা ফুলের (তুমি যাকে নীলকণ্ঠ বলতে) ঝাড়টা শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচিয়ে তুলতে আমি সমানে বীজ নিয়ে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছি।

মাগো, তুমি তো প্রকৃতির মানসকন্যা। তাই তোমার গাছপালা, ঘাসফুলেরা তোমার না থাকাকে মেনে নিতে পারছে না। মাগো ওদের মতো আমরা নাকি আমাদের মতো ওরা – আলাদা করতে পারি না। আসলে একই মাতৃছায়ায় সহোদরের মতোই তো আমাদের বেড়ে ওঠা। বরং সন্তান হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে ওরাই এগিয়ে থাকবে। ওরা কেবল আনন্দেই ভাসিয়েছে তোমাকে, ভুলিয়ে রেখেছে জড় বিষাদ।

আমি নিজের কথা বলতে পারি,
হাজার হলেও মানুষ তো! সন্তান হিসেবে, মানুষ হিসেবে কত ভুলত্রুটিই না হয়েছে। তুমি মা, তুমি ক্ষমাশীল বলেই ফিরে আসার দরজাটা খোলা রেখেছো সারাজীবন। ভুল করে তো মায়ের কাছেই বার বার ফেরা যায় বলো! এমন বন্ধু আর কে আছে, মা!

মা! মাগো! পরান! সোনা! ওমা! শূন্য এই বাড়ির কোথায় তোমাকে খুঁজিনা বলো তো! আলমারিতে শাড়ির ভাঁজে, সবুজ পর্দার পেছনে, টিপ আর মালার ঝুড়িতে, তোমার কাজের জায়গায়, পুরনো চিঠিপত্তরের বাক্সে!
ঘুমোতে গেলে বিছানা- বালিশে আর আগের মতো ওম নেই জানো! ধোপাবাড়ি থেকে আনা চাদর পাতলেও আগের মতো ধবধবে লাগে না।
সব কেমন শুকনো, খটখটে, বেমানান ঠেকে।

তোমার এতোকালের সংসার আমার ওপরে দিয়ে চলে গেলে। শেষ চারটা মাসে তুমি বড় বেশি নির্ভর করে ফেলেছিলে আমার ওপরে, বড় বেশি নিশ্চিন্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়েছো যে, আব্বুকে আমিই দেখবো। হাতটা ধরে জানিয়ে গেছো –
“তুই আমার প্রসব বেদনার ঋণ শোধ করেছিস, ফুলেশ্বরী।”
তাই কী কখনো হয়, মাগো? পৃথিবীর কোনো সন্তানের পক্ষে এ ঋণ শোধ করা সম্ভব না। তাই তা শোধ করার চেষ্টাও সন্তানের জন্য ধৃষ্টতা। আমি আজীবন তোমার কাছে ঋণী থাকতে চাই।

শেষ দিনগুলোতে তোমার সঙ্গী হতে পারা, রাতদিন তোমাকে জড়িয়ে থাকা মুুুুহূর্তগুলো
আমার জীবনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তোমার মনের কাছাকাছি পৌঁছুতে আমার একটু আধটু না, অনেকটা সময় লেগেছে।
পথটা খুব সহজ ছিলো না।

(চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.