ইয়াফেজ তিমুর:
আজ আপনাদের আমি আমার ব্যর্থতার গল্প শোনাবো – মানুষ হবার চেষ্টা করতে করতে কিভাবে আমি অ-পুরুষ হয়ে গেলাম, কিভাবে আমার পুরুষ জনম বৃথা হলো – সেই গল্প।
‘আর পারছি না গুরু, সেই নার্সারি থেকে শুরু’র মতো আমার এই আপাদমস্তক অপুরুষ হওয়ার ইতিহাসও আমার বয়সের সমান প্রাচীন। সেই ছোটবেলায় শিখেছিলাম শিস বাজাতে নেই, এটা অভদ্র কাজ। এমনই উর্বর আমার মস্তিষ্ক যে পুরো কৈশোর কাটিয়ে দিয়েও শৈশবের এই শিক্ষা যে ভুল, তা বুঝতে পারিনি, আর তাই রাস্তায় শিস দিয়ে সমবয়সী কিশোরী অপ্সরীদের দৃষ্টি আকর্ষণের পুরুষালি আচরণ রপ্ত করতে পারিনি কখনোই। মন্দ কাজ বলে শিস বাজানো শেখার চেষ্টাই করিনি, আর তাই আমি আজ তিরিশের কোঠা পেরিয়েও শিস না বাজাতে পারা এক অপুরুষই রয়ে গেলাম।
কেবল এতোটুকু হলেও হয়ত আমার পৌরুষ মেনে নিত। ‘একা পথে চলা চুমকি’দের দৃষ্টি আকর্ষণের কেবল শিসই একমাত্র পন্থা নাকি? ‘হাতের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট’ গুঁজে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে গুলতানি মারতে মারতে চুমকিদের উদ্দেশ্যে কত মিষ্টি কথাই তো ছুড়ে দেয় সুপুরুষ কিশোর আর তরুণেরা। কিন্তু এখানেও আমার পারফর্ম্যান্স লবডঙ্কা। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে শ্যেন দৃষ্টির মুরুব্বির চোখে হাতে সিগারেট নিয়ে ধরা পড়ে ‘অসভ্য বেয়াদব ছেলে’ হয়েছি বটে, কিন্তু মেয়েদের সুমিষ্ট বাক্যবাণে বিদ্ধ করে ‘পুরুষ’ হতে পারিনি।
এভাবে পদে পদে নিজের শারীরতত্ত্বীয় ‘পুরুষ’ পরিচয়ের প্রতি আমি বয়ে এনেছি কেবলই ‘লজ্জা’। ফার্মগেটের ভীড়ের মাঝে আমার হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারে না নারীর ‘কোমল ভরাট শরীরের’ বিশেষ স্থান, বাসে বসে আমার কনুই হয়ে উঠতে পারে না আমার পাশে বসা নারীর অস্বস্তির কারণ, সারা দিনের যুদ্ধ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে আমার ভাণ্ডারে জমা পড়ে না রাত কাটানোর উপযোগী ‘পুরুষালী’ কোন বীরত্বের স্মৃতি।
আমি চায়ের কাপের আড্ডায় কিংবা হলের ছাদে বসে নেশাতুর চোখে সহপাঠী বান্ধবীদের নিয়ে আদি রসাত্মক কৌতুক করতে পারিনি ভার্সিটি জীবনে, সেও কেবল আমার পৌরুষের অক্ষমতায়। আজো অফিসের বারান্দায় সিগারেটের ধোয়ার ফাকে সহকর্মীদের রসালো আড্ডা থেকে নীরবে সরে যাই কাজের অজুহাতে, তাও কেবল আমার পুরুষত্বের কমতি আছে বলেই, অপুরুষ ছাড়া কে পারে এমন আকর্ষণীয় ‘শরীরসর্বস্ব’ নারী সহকর্মীর দেহবল্লরীর কল্পনাসুধা পানে বিরত থাকতে?
তবুও আমি হয়তো পুরুষ হতাম, যদি সত্যিকার অর্থে ‘স্বামী’ হতে পারতাম – যদি পুরুষের মতো বাসর রাতে বিড়াল মেরে ‘বউ’কে জানিয়ে দিতাম ‘হু ইজ দা বস’। ‘বউ’ আমার হিজাব পরবে কি পরবে না, চাকুরি করবে কি করবে না, করলে কোথায় করবে, অফিসের কোন কলিগের সাথে কথা বলবে আর কার সাথে বলবে না, অফিসের কোন প্রোগ্রাম এটেন্ড করবে আর কোনটা না করে দ্রুত বাসায় ফিরে আমার জন্য রান্না করে তৈরি হয়ে বসে থাকবে আমার রাতের খিদে মেটানোর জন্য, এগুলো সবই স্বামী হিসেবে আমার ঠিক করে দেবার কথা ছিল।
স্বামী হতে হলে আমার ঠিক করে দেবার কথা ছিল বাপের বাড়ির কোন আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ থাকবে আর কার সাথে থাকবে না, ফেসবুক একাউন্টের তথ্য নিয়ে বন্ধু তালিকা পরিমার্জনও স্বামীর অবশ্য কর্তব্য। বছরে কয়বার কয় ঘন্টার জন্য বাবার বাড়ি যাবে, সেটার তালিকা না করে দিলেও যাবার আগে অনুমতি নেবার প্রয়োজনীয়তাটাও পই পই করে সেই বিড়াল মারতে মারতে শিখিয়ে দিলে তবেই না আমি স্বামী হতে পারতাম। কিন্তু আমার বয়সের সমান প্রাচীন অপৌরুষের কাহিনী কি আর এতো সহজে শেষ হবার? আর তাই আমার আদর্শ স্বামীও হয়ে ওঠা হয় না কেননা কৈশোরে পড়া রবি বাবুর সেই ‘হৈমন্তী’র বরের মতো আমিও আমার জীবনসঙ্গিনীকে ‘সম্পদ’ ভাবতে চেয়েছি, ‘সম্পত্তি’ নয়।
স্বামী হতে পারার ব্যর্থতা আমার পৌরুষের অভাবকে আরো প্রকট করে তোলে। আমার বউ তাই আমার অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে সরবে, আমারই সামনে আমার বাড়ির লোকেদের অসংগত আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে আর ‘অপুরুষ’ আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখি। তবে আমার বাড়ির লোকেরা তো আর আমার মতো ‘অপুরুষ’ নয়, তাই আমাকে কামরূপ-কামাখ্যার যাদুমন্ত্রে ‘ভেড়ুয়া’ বনে যাওয়া ‘না-মর্দ’ আখ্যা দিয়ে তারাই আমার বউকে উচিৎ ছবক আর আদব-লেহাজ শেখাবার দায়িত্ব তুলে নিতে চায় সগৌরবে নিজেদের হাতে। এবার আমার পৌরুষ নয়, মনুষ্যত্ব কথা বলে ওঠে আর তাই এই অন্যায় ছবক শেখাবার আবদারের বিরুদ্ধে ‘ভেড়ুয়া’ আমি দাঁড়াই আমার বউ এর পাশে। বউ এর হয়ে নিজের বাড়ির লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দিনে আমার পৌরুষের কবর খোড়া হয়ে যায়।
সেই কবরে আমার পৌরুষের লাশ নামিয়ে ফেলে এই সমাজ যেদিন আমি আমার জীবনসঙ্গিনীর উচ্চ-শিক্ষার্থে প্রবাস যাত্রায় তার সহযাত্রী হই আমাদের আত্নজা’র সঠিক বেড়ে ওঠার কথা ভেবে। মাটির নিচে পড়ে পড়ে পচে গলে যায় আমার পৌরুষ, পৃথিবীর মুক্ত আলো বাতাসে শ্বাস নেই ‘অপুরুষ’ আমি – একজন মানুষ হবার তাড়নায়।