ইমতিয়াজ মাহমুদ:
একটা কুৎসিত দৃশ্য দেখেছি গত কয়েকদিন ধরে। একটা হোঁদল কুতকুত ধরনের মোটাসোটা মোল্লা, পরনে ঐরকম দাড়ি টুপি আর মোল্লাটাইপ পোশাক, হাতে একটা মেগাফোন নিয়ে অভব্য ভঙ্গিতে নাচতে নাচতে গাইছে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ আর তার সাথে একদল লোক শ্লোগান ধরছে ‘শেখ হাসিনার বাপের নাম’। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে জমায়েতটা দেখলাম। মাইক হাতে লোকটা নেতৃত্ব দিচ্ছে, পেছনে বেগম খালেদা জিয়ার ছবিওয়ালা ব্যানার। সাথের লোকগুলি এমনিতে সাধারণ মধ্যবিত্ত টাইপ। নারী-পুরুষ দুইই আছে। আর ঐ মাইকওয়ালার ঠিক পাশেরজনের পাশেরজন বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ খাটো ধরনের শার্টপ্যান্ট পরা লোকটি শ্লোগানের সাথে সাথে অশ্লীল ভঙ্গিতে নিতম্ব দুলিয়ে নাচছে।
এইটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই নাই। প্রথমত রুচিতেই বাঁধছিল। তার উপরে একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল যে এখানে বাংলাদেশে যারা বিএনপির নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী সোশ্যাল ইন্টেলেকচুয়াল এক্টিভিস্ট ইত্যাদি আছেন ওদের অন্তত কেউ কেউ প্রতিবাদ করবেন, আর হয়তো বলবেন যে না, এইটা আমাদের কথা না। আরেকটা প্রত্যাশাও ছিল যে আমাদের তরুণরা হয়তো এই শ্লোগান আর কুৎসিত দৃশ্যটার প্রকৃত মন্দ দিকটা নিয়ে কথা বলবেন।
না, এর কোনটাই হয়নি।
দৃশ্যটার নোংরামির দিকটা না হয় আর না বললাম। শ্লোগানটা নিয়ে কথা বলি চলেন। ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনা বাপের নাম’ এই শ্লোগানটার মানে কী? এইটার মানে কি এই যে শেখ হাসিনা হিন্দু বা তাঁর পিতা হিন্দু বা এইরকম কিছু? আমাকে কি কেউ মেহেরবানী করে বলতে পারেন শেখ হাসিনার পিতা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর নাম যদি শেখ মুজিবুর রহমান না হয়ে হরে কৃষ্ণ হরে রাম হতোই, সেটাতে নিন্দার কী আছে?
আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ বিএনপি করেন বা বিএনপিকে সমর্থন করেন এইরকমও আছেন। ফেসবুকেও আছেন। আপনাদেরকেই বিশেষভাবে জিজ্ঞাসা করি, একজন মানুষ যদি হিন্দু হয়, বা তাঁর পিতা যদি হিন্দু হয়, সেটাতে দোষের কী আছে বা অযোগ্যতার কী আছে বা তাকে নিন্দার কী আছে? কেন আপনারা এই শ্লোগানটা দিচ্ছেন? কেন আপনারা এই শ্লোগানটা শুনে মুচকি মুচকি হাসছেন? আপনাদের শ্লোগানের কথাগুলি সত্যি বলেই ধরে নিচ্ছি কিছু সময়ের জন্যে। ধরে নিলাম শেখ হাসিনা হিন্দু, বা তাঁর পিতা হিন্দু, বা ওরা হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছেন, বা ওদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান ছাড়া অন্য কিছু। তাতে অসুবিধা কী?
আপনারা কি বলতে চাইছেন যে হিন্দু হওয়া মানে আপনাদের চেয়ে মানে কিনা মুসলমান হওয়ার চেয়ে ছোট হওয়া? মুসলমান না হওয়া মানে কি এই দেশে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে অযোগ্য হয়ে যাওয়া? মুসলমান না হওয়া মানে কি একজন দুষ্কৃতিকারী হয়ে যাওয়া? মুসলমান না হওয়া মানে কি অপরাধী হওয়া? ভেবে বলেন, স্পষ্ট করে বলেন।
শোনেন, এই যে চরম সাম্প্রদায়িক শ্লোগানটা, এটা বিএনপিরই শ্লোগান। সাদা কাপড় পরা বিএনপি নেতারা হয়তো এইভাবে নোংরা ভঙ্গিতে কথাটা বলেন না, কিন্তু এই শ্লোগান শুনে প্রতিটা বিএনপি নেতারই অন্তরে ঐরকম অশ্লীল ভঙ্গিতে নিতম্ব দুলে উঠেছে। এইটার উপর ভর করেই, অর্থাৎ মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার উপর ভিত্তি করেই ওদের রাজনীতি গড়ে উঠেছে।
শুধু বিএনপি নয়, আমাদের দেশের অনেকগুলি রাজনৈতিক দলই এই সাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী। এদের সাথে চীনপন্থি বা মওলানা ভাসানি সমর্থক লোকজনও আছে। এরা মনে করে বাংলাদেশটা হচ্ছে মুসলমানদের দেশ, এখানে হিন্দু হওয়া বা অন্য কোন ধর্মের বিশ্বাসী হওয়া বা ধর্মে অবিশ্বাসী হওয়া অপরাধ।
আর আফসোসের কথাটা কি জানেন? এইরকম লোকের সংখ্যা আমাদের দেশে নেহায়েত কম না। এরা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আওয়ামী লীগেও আছে।
বঙ্গবন্ধুকেই কেবল মনে পড়ে। ১৯৭২ সনের মার্চ মাসে এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দুর করা অনেক কঠিন কাজ, অনেক সময় লাগবে এটা করতে। সময় তো আর বঙ্গবন্ধুকে আমরা দিলাম না। আর এখন ফাজিলগুলি এইসব কুৎসিত ইয়ে করছে, আর সেগুলিও আমাদের দেখতে হয়।