সালমা লুনা:
আচ্ছা বলুন তো এই দেশে একেবারে ডালভাতের মতো একঘেঁয়ে ঘটনা কোনটি? কোন খবরটি রোজকার খবরের কাগজে কমন থাকে? কোন খবরটি আপনি খুব মনোযোগ দিয়েই পড়েন এবং সেটি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবেন? খবরের কাগজের কোন খবরটি দৈনিক পড়ে আপনি আপনার পাঁচ মাস থেকে পঁচিশ বছর বয়সী কন্যার দিকে চেয়ে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন?
আমি আপনি সবাই জানি সেই হৃদয় বিদারক অথচ ডালভাতসম রোজকার একঘেঁয়ে ঘটনাটি হলো – ধর্ষণ!
এইদেশে ধর্ষণ করে খুন করে লাশ জলে স্থলে ফেলে রেখে যায় চেনা অচেনা ক্ষমতাহীন বা ক্ষমতাবানেরা। এইখানে শিশুদের নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করে, কখনো কেটে ছিঁড়ে ফেলে দেয় কখনো মেরে ঝুলিয়ে দেয়, বা বস্তায় ভরে বাথরুমে লুকিয়ে রাখে।
আমরা দুইদিন লেখালিখি করি। একদিন অপরাজেয় বাংলায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়াই, আরেকদিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে। ফেসবুকে ক্রোধী বাণী দেই।
তারপর সব চুপচাপ।
তারপর আবার আরেকটি ধর্ষণ। আরও কোন রক্ত হিম করা তোলপাড় করা কাহিনী।
আবার দাঁড়ানো। শাসকের রুদ্ধদ্বারে ঘা দিতে, সমাজের সকলের কর্ণকূহরে কলরব পৌছে দিতে একটা নতুন কোন ভাবনা ভাবা হয় । অতঃপর সেই নতুন কিছুও কারো মগজে তেমন কোন আলোড়ন তুলতে পারেনা।
বাংলাদেশের মানুষ দিব্যি খায়-দায়, ঘুমায়, নিয়মিত কাজ করে, কাগজে পড়া ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা পাশে সরিয়ে রেখে প্রাত্যহিক কর্ম করে। আর আমাদের আইন তার নিজের গতিতে চলে।
এইভাবেই চলছিলো।
ইতিমধ্যে ধর্ষকরা সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। তাদের সাহসও বেশ বেড়েছে। দেশবিদেশের আলোচিত ধর্ষণগুলো তাদের নজর কেড়েছে। পাশের দেশের খোদ রাজধানী শহরে এক শিক্ষিত নারীকে বাসে ধর্ষণ এবং তারপর নৃশংসভাবে হত্যার পর এইদেশের ধর্ষকরা আনন্দিত হয়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলো। তারাও এই ধর্ষণবান্ধব দেশে বাসে ধর্ষণের উৎসব শুরু করে দিয়েছিলো।
আমার জানা এবং খবরের কাগজে পড়া চারটে ঘটনা যার সবকটাই ছিলো গরীবগূর্বা অশিক্ষিত গার্মেন্টস কর্মী। এবং যতদূর মনে পড়ছে এই ঘটনাগুলো ছিলো সাভার রোডে এবং একটা সম্ভবত নারায়ণগঞ্জে। বেচারারা সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় ক্লান্তিতে বাসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তারই খেসারত দিতে হয়েছে কয়েকটি নারীলোলুপ হায়েনা দ্বারা শরীরে ও মনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে। যার একটিমাত্র ঘটনার অপরাধী ধরা পড়েছিলো সাভারে।
এরপর বড় ধরনের দৃষ্টি কাড়ে টাঙ্গাইলের বাসে রূপা ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনাটি।
সেই অপরাধীরা ধরা পড়ে বিচারের অপেক্ষায় থাকলেও বাসে এইরকম ঘটনা থেমে যায়নি।
এবার খোদ নগরীতেই।
এবং ভিকটিম মধ্যবিত্ত নারী। ছাত্রী। এবং বেশীরভাগই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
কিছুদিন ধরেই অবাক বিস্ময়ে প্রায় প্রতিদিন ফেসবুকে পড়ছিলাম মেয়েগুলোর পোস্ট। তারা বাসের নামও বলেছে প্রজাপতি লাব্বাইক ইত্যাদি।
অনেকেই সেগুলো শেয়ার করছে। ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিভ্রাট। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায়নি। তারা বলেছে, তাহলে মেয়েরা অভিযোগ করছে না কেন? দিনে দুপুরে নগরীর ব্যস্ততম রাস্তাগুলোয় এ কী করে সম্ভব!
সম্ভব। এবার তো বোঝাই গেলো সম্ভব। এবার অভিযোগও এসেছে।
উত্তরা ইউনিভার্সিটির একটি মেয়ে তুরাগ বাসে হেলপার এবং অন্যান্যদের দ্বারা নিগৃহীত হতে হতে বেঁচে গিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ঘটনা জানালে তার সহপাঠীরা ফুঁসে উঠে। তারা গোটা কয়েক তুরাগ বাসের চাবি নিয়ে তাদের ওই রাস্তায় চলা বন্ধ করে দেয় এবং ওই অপরাধীদের ধরিয়ে না দিলে তারা বড় আন্দোলনে যাবে বলে জানিয়ে দেয়।
এটা শুধু উত্তরা ইউনিভার্সিটি নয়, এটা সকল ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদেরই দাবি হওয়া উচিত। কেননা অনেক মেয়েই চাকরি করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় সন্ধ্যায়ও ক্লাস থাকে। জীবিকার প্রয়োজনে সন্ধ্যা বা রাতে মেয়েদের একলাও বাসে চড়তে হচ্ছে।
এই যে আজ তারা তাদের সহপাঠীদের জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদিও এটা তাদের আরো অনেক আগেই দাঁড়ানো উচিত ছিলো। তাদের গরীব গার্মেন্টস কর্মী বোনের জন্য। গ্রামের অদেখা কিশোরী মেয়েটির জন্য। পাশের বাড়ির ছোট বাচ্চাটির জন্য। দাঁড়ানো উচিত ছিলো সারাদেশে লাগাতার ঘটতে থাকা নারী নিপীড়ন, যৌন হয়রানী আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে।
ছাত্ররা সবসময় নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের সবসরকম দুর্বিপাকে। গর্জে উঠেছে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। দাবী আদায়ের আন্দোলনে থেকেছে সকলের সামনে।
আজ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাসে নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। নিশ্চয়ই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সারাদেশে নির্বিচারে ঘটতে থাকা ধর্ষণের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠবে।
আমরা সেই আশায় আজ তাদের সাথে একাত্ম হচ্ছি।
আর শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই কেন। তাদের সাথে একজোট হতে হবে বাংলাদেশের ধর্ষণবিরোধী প্রতিটি সুস্থ বিবেকবান মানুষকে।
আমরা ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি, ফাঁসি চাই। ন্যুনতম সময়ের মধ্যে ধর্ষণের বিচারকার্য সম্পন্ন করা হবে এইটি চাই।
পাশের দেশ ভারতে একটি আট বছরের যাযাবর বালিকার ধর্ষণের পর রাতারাতি সেখানে আইন পাশ হয়েছে বারো বছরের নিচে কেউ ধর্ষিত হলে সেই ধর্ষককে ফাঁসি দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতি সই করেছেন সেই বিলে জেনেছি আমরা।
পাশের দেশকে দেখে ধর্ষকরা শিখলো বাসে ধর্ষণ করা যাচ্ছে শিক্ষিত নারীদের। এখন আমাদের মাননীয়রাও তো তাদের শাসকদের কাছে কিছু শিখুন! এইদেশে তো পাঁচ মাস, পাঁচ বছর কোন শিশুই বিকৃত পুরুষের লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
তাই বলছিলাম, হে মাননীয়রা। ছাত্রসমাজ যখন গর্জে উঠেছে এইসব যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তখন আপনারাও নড়েচড়ে উঠুন। ছাত্ররা রাস্তায় নামলে তো আবার তাদের জামাতি-বামাতি ট্যাগ লাগাতে চান আপনারা সকলে। সকল আন্দোলনকে সরকারকে ঠেলে ফেলে দেয়ার আন্দোলন ভাবেন।
গণতান্ত্রিক দেশেও আন্দোলন হয়, দাবিদাওয়া জানায় নাগরিকরা শাসকের ভুল ধরিয়ে দিতে। শাসককে সুপথে পরিচালিত করতে। অত ভয় পেলে কি চলে?
তাই আসুন আপনারাও ধর্ষণের বিরুদ্ধে, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলুন। দ্রুত একশন নিন। আইনের সংস্কার করুন।
আজ যদি ছাত্র সমাজ ফুঁসে উঠে, তাদের সাথে সারাদেশও গর্জে উঠে, তখন তো আবার বলবেন যে, ওরা স্বাধীনতা বিরোধী। তখন আর কাজ হবে না বোধ হয়। কারণ এইটা কোনো রাজনীতির খেলা না! আর এইটা পাকবাহিনীর অধীন বা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশও না। এক জিনিস বারবার লোকে খাবে না। তারা গলা তুলে বলে উঠবে – এইটা ধর্ষকের বা যৌন নিপীড়কদের দেশ না। এইটা স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা আমাদের স্বাধীনতা ধর্ষকের কাছে জিম্মি রাখবো না।
এই যে দেশটাকে ধর্ষকের অভয়ারণ্য বানাচ্ছেন, ইতিহাস কিন্তু ক্ষমা করবে না।