‘আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে’

তসলিমা নাসরিন:

আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। যে অপরাধই যে লোকই করুক না কেন, কারো মৃত্যুদণ্ড হোক চাই না। যেই না বললাম, অমনি খবর করা হলো ‘তসলিমা বলেছেন ধর্ষকরাও মানুষ, তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে’। আমি প্রায়ই বলি, মানুষ জাতের মতো নিকৃষ্ট জাত আর নেই। তাহলে মানুষ তাও আবার ধর্ষক — তাদের প্রতি আমার এতো দরদ উথলে উঠলো কেন? সারা জীবন ধর্ষণের বিরুদ্ধে লিখলাম, আর এখন এক হেডলাইনেই আমার লড়াই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা । মিডিয়ার কী পাওয়ার! বাপ্রে বাপ।

মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কি শাস্তি নেই দুনিয়ায়? সেই শাস্তি দাও অপরাধীকে।
সবচেয়ে ভালো হয় , মানুষকে যদি শিক্ষিত আর সচেতন ক’রে গড়ে তোলা যায়। অপরাধ যে কারণে হচ্ছে, সেই কারণটাকে যদি নির্মূল করা যায়। এই কাজটি কেউ করতে চায় না। সবাই সোজা পথটি ধরতে চায়। সোজা পথটি হলো, অপরাধীকে মেরে ফেল। চোখের বদলে চোখ নিয়ে নাও। খুনের বদলে খুন। এর নাম কিন্তু বিচার নয়, এর নাম প্রতিশোধ। এটি করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়। জনগণ ভাবে অপরাধ দমনে সরকার বিরাট এক ভূমিকা নিয়েছে।

অপরাধীর জেল হলে এমন তো হতে পারে, সে ভালো মানুষ হয়ে জেল থেকে একদিন বেরোবে। নিরপরাধকেও তো কত মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। জেলে থাকাকালীন যদি প্রমাণ হয় মানুষটি নিরপরাধ, তখন অন্তত ভুল শোধরানোর সুযোগ পাওয়া যায়।

১৪০ টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে। বাকি দেশগুলোও করবে। সবচেয়ে কম অপরাধ কোন দেশে হয়? যে দেশগুলোয় মৃত্যুদণ্ড নেই। সবচেয়ে বেশি অপরাধ? যে সব দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে। অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে মানুষ? প্রমাণ পাওয়া গেছে, একেবারেই না।

খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি মানুষ আর খুন করবে না? ঠিক করবে। কিন্তু সমাজের মানুষকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুললে খুনখারাবির সংখ্যাটা কমে যায়। একই রকম ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলেও পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে না। পুরুষ তখন ধর্ষণ বন্ধ করবে যখন মেয়েদের ধর্ষণের বস্তু হিসেবে তারা আর দেখবে না। অলরেডি এই নষ্ট নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের শিখিয়ে ফেলেছে যে মেয়েরা ধর্ষণের বস্তু, এই শেখাটা মাথা থেকে দূর করতে হবে। ব্যস, তাহলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে। নতুন করে কাউকে আর নতুন কিছু শেখাতে হবে না, শেখাতে হবে না যে মেয়েরাও মানুষ, তাদের শ্রদ্ধা করো ব্লা ব্লা।

(লেখকের ফেসবুক থেকে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.