ভারতে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীদের স্যালুট

সুপ্রীতি ধর:

অভিনন্দন ভারতের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীদের। শেষপর্যন্ত তাদের আন্দোলন রাষ্ট্রের টনক নড়াতে সক্ষম হয়েছে। দেশজুড়ে পরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনায় জোরালো আন্দোলন গড়ে উঠে, আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংশোধন করে ১২ বছরের নিচের বয়সী শিশুকে ধর্ষণকারীর সাজা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পাশাপাশি আরও কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার। এখানেই ভারতের সাথে আমাদের পার্থক্য।

এর আগেও ২০১২ সালে যখন দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডটি ঘটে, তখনও এমন ফুঁসে উঠেছিল সারা ভারত। দেশের বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, ছাত্রসহ আপামর জনগণ তখন নেমে এসেছিল রাস্তায়। ওই আন্দোলন এতোটাই তীব্র আকার নিয়েছিল যে, শেষপর্যন্ত খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকদের সাজার রায় ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এবং ধর্ষকদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি চারজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ওই একজনও তখন রেহাই পেয়েছিল নাবালক থাকায়। এ নিয়েও বিতর্ক উঠে।

শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ৪০ হাজার ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে ভারতে। এর মধেধ্য শতকরা ৪০ ভাগই ছিল শিশু ধর্ষণের ঘটনা।

জম্মু ও কাশ্মিরের একটি মন্দিরে সাতদিন আটকে রেখে আট বছর বয়সী আসিফা বানু নামের এক শিশুকে গণধর্ষণ ও পরে হত্যার ঘটনা ভারতকে উন্মাতাল করে তোলে। যেহেতু আগামী বছরই জাতীয় নির্বাচন, তাই কিছুটা চাপ রাজনৈতিকভাবেও ছিল মোদি সরকারের ওপর। তদুপরি জরুরি কেবিনেট মিটিং ডেকে সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয় সরকার। শুধু মৃত্যুদণ্ড সাজাই নিশ্চিত করেনি, সেইসাথে দ্রুততম সময়ে যাতে এই ধরনের ঘটনার মামলা নিষ্পত্তি হয় সেইরকম নির্দেশও দেয়া হয়েছে। থানাগুলোকে এই লক্ষ্যে ফরেনসিক কীটসহ নানারক প্রস্তুতি নিতেও বলা হয়েছে।

ফৌজদারী আইনকে সংশোধন করে দেয়া নির্বাহি আদেশে ১৬ বছরের নিচের বয়সী শিশুকন্যাকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথাও বলা হয়েছে।

মূলত দিল্লির ঘটনার পরপরই ভারতে ধর্ষণ আইনে কঠোরতা আনা হয়, আইন সংশোধন করে কঠিন শাস্তি বলবৎ করা হয়, তারপরও ধর্ষণ যেন নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আট বছরের আসিফার ঘটনা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ধর্ষকদের রক্ষায় ক্ষমতাসীন বিজেপির সমর্থন, উত্তর প্রদেশে একটি টিনএজ কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণের ঘটনায় বিজেপি এক আইনপ্রণেতাকে গ্রেপ্তার, এবং খোদ মোদির এলাকা গুজরাটে ১১ বছর বয়সী একটি শিশুর ওপর যৌন হামলার ঘটনা পুরো দেশজুড়ে আগুনে ঘৃতাহুতি ঘটে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সেই বিক্ষোভ।

পরিস্থিতি পুরোই বিপরীতে চলে যায় মোদি সরকারের। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখেই হোক আর ধর্ষণের ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই হোক, আইনে জরুরি সংশোধন আনতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বলা চলে, বাধ্য করা গেছে সরকারকে। এখন এর বাস্তবায়ন কতোটুকু হয়, তাই দেখার বিষয়। দুই মাসের মধ্যে ধর্ষণের বিচার সম্পন্ন করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশেও ধর্ষণ আইন কঠোর। তিন মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্নের নির্দেশের কথা আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর সুফল আজও পাইনি। তবে হ্যাঁ, চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার রূপার ঘটনায় উপুর্যপরি লেগে থাকায় একটা রায় আমরা পেয়েছি। কিন্তু এখানে যে হারে মহামারী চলছে ধর্ষণের, তা থেকে রেহাই পেতে গণআন্দোলনের বিকল্প কিছু নেই। কিন্তু সেই আন্দোলনটাই এখানে গড়ে উঠছে না। আর সবকিছু নিয়ে আন্দোলন হলেও, জনসমর্থন পাওয়া গেলেও নারী বিষয়ে অর্থাৎ ধর্ষণের প্রতিবাদে ৫০জন মানুষকে এক কাতারে আনাও মুশকিল হয়ে পড়ে।

এর কারণ হিসেবে আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলবো যে, আমাদের নারী সংগঠনগুলোর মধ্যে একতা নেই বললেই চলে। আর ধর্ষণকে শুধুমাত্র নারীর ইস্যু ভাবা বন্ধ না হলে এটা চলতেই থাকবে। একে জাতীয় ইস্যু হিসেবে ভাবতে হবে। একটি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা যখন ধর্ষণের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত, তখন উন্নয়নের কোন অংশ এই জনগোষ্ঠীকে আলোকিত করতে পারবে, তা আমার মাথায় ঢোকে না।

বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের। সবার সমর্থন, অংশগ্রহণ সেখানে প্রয়োজন। বিষয়টা নারীর একার নয়, যেহেতু সব পরিবারেই নারী আছে, মেয়ে আছে, কাজেই এটা সামাজিক, এবং রাজনৈতিক, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ প্রয়োজন ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, ধর্ষকের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা, এবং এই প্রতিবাদে পুরুষের শামিল হওয়া। তবেই যদি ভারতের মতোন কিছু ফসল ঘরে আসে।

আবারও ধন্যবাদ জানাই ভারতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকারীদের। আপনারা ঐক্যবদ্ধ হতে জানেন, এজন্য আপনাদের স্যালুট। আমরা ততোদিন নিজেরা নিজেরা খোঁচাখুঁচি করি, একে অন্যকে ল্যাং মারি, জাপটে ধরে রাখি যাতে অন্যরা  কিছুতেই কিছু না করতে পারে, এটাই আমাদের শিক্ষা। বড় কষ্ট হয় এসব দেখে এবং জেনে। ধিক্।

 

 

 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.