স্মৃতি পিপীলিকা

লোপা মমতাজ:

দেশের বাইরে এ রকম ভয়াবহ বিপদে পড়লে কী করা উচিত, তা আমার জানা ছিল না। বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমি তখনও এক নাদান বালিকা। আর এটা ছিল আমার দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ। দেশটা নেপাল। আমি নাইট ক্লাবের এক বাথরুমে আটকা। আমার পেছন পেছন বাথরুমে একটা মেয়েও ঢুকেছে, তা টেরই পাইনি! মেয়েটাকে আমি চিনি। একটু আগেই পরিচয় হয়েছিল। নাম যতি। এই নাইট ক্লাবের স্ট্রিপ ড্যান্সার। ও ঢুকেই ছিটকিনি লাগিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে- কারো তুম যো কারনা চাতিহো, কোয়ি বাত নেহি। এ কথা শুনে আমার শরীরের তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে গেছে। ও কী করতে বলে আমাকে! আমি ভেবেছিলাম, ও হয়তো ভুলে ঢুকেছে। বিষয়টা তা নয়।


ততদিনে আমি সমকামিতা, ফিমেল টু ফিমেল সেক্স সম্পর্কে ভালোই জানি। কিন্তু আমি তো তাকে শুধু বাথরুমটা দেখিয়ে দিতেই বলেছিলাম। ছিটকিনি লাগিয়ে ভেতরে চলে আসতে বলিনি। ভয়ের চোটে আমার শরীর কাঁপছিল। হুট করে ও আমার হাতটা ধরে বসল। কেউই তো জানে না আমি বাথরুমে। এখন আমার কী হবে? একটু পরেই তো স্ট্রিপ ড্যান্স শুরু হওয়ার কথা। ওইটা দেখব বলেই তো নাইট ক্লাবে আসা। কত শুনেছি এই স্ট্রিপ ড্যান্সের কথা; মুভিতেও দেখেছি। কোন ভূতে পেয়েছিল আমাকে কে জানে! নেপালের জনপ্রিয় পর্যটন স্থান নাগরকোট দেখার ইচ্ছা হয়নি; অন্নপূর্ণার চূড়াগুলো দেখার ইচ্ছা হয়নি; বৌদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনি দেখারও ইচ্ছা হয়নি। না পোখরা, জানকপুর, খুম্ব, চিতন জাতীয় উদ্যান, পাটান, বাখতাপুর, কাকানি, কিরতিপুর, কোপান মঠ, সাঙ্খু। নেপালের এত কিছু দেখা বাদ দিয়ে দেখতে মন চাইল স্ট্রিপ ড্যান্স!

এখানে আসার আগের দিন রাতে কী ঝাড়া লেখাপড়াই না করলাম! যাব একটা ওয়ার্কশপে জয়েন করতে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার শিশু ও নারীর অধিকারকে এগিয়ে নিতে, লিডিং মিডিয়া পেশাদারদের জন্য ছিল এই কর্মশালা। যেহেতু এটা ছিল ইউনিফেম দক্ষিণ এশিয়ার আয়োজনে, সেহেতু ধরেই নিয়েছিলাম খুব ভালো ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। দেশে যেসব বিদেশির সঙ্গে কাজ করি, তারা তো কাজ করতে করতে এক সময় এখানকার লোকাল পিপলদের মতোই হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। ওদের সঙ্গে কথা বলা কতটা সহজ তার
একটা উদাহরণ দিই।

২০০৭-এর শুরুর দিকের কথা। আমি তখন একটি আইএনজিও’র চাইল্ড মিডিয়ার দায়িত্বে। আমাদের ফরেনার বস এলেন প্রোগ্রাম দেখতে। তাকে কাঁঠাল খেতে দিয়েছি। তো, বস জিজ্ঞেস করলেন, লোপা, হোয়াট ইজ দ্য নেম অব দিস ফ্রুট? মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়লো। কিছুতেই কাঁঠালের ইংরেজি নাম মনে করতে পারছি না! সঙ্গে লিচুও দিয়েছিলাম। বসকে বলতে থাকলাম- দ্য নেম অব দিস ফ্রুট ইজ লিচি। বস বললেন, ইয়া আই নো দ্যাট। ওয়েট, লিচি ইজ স্মল অ্যান্ড কাঁঠাল ইজ বিগ ইন সাইজ বাট বোথ লুক সেম। তিনি তখন লাফ দিয়ে বললেন, জ্যাকফ্রুট। আমি বললাম, ইয়েস। ঝামেলা শেষ। কিন্তু এখন যেখানে যাচ্ছি, সেখানে তো আরও ছয়-সাতটা দেশের মানুষ থাকবে। তবে সেটাও কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো আমার সঙ্গে বাংলাদেশের আরও তিনজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব যাবেন। তাদের কথা ভেবেই আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। বাই দ্য ওয়ে, বাথরুমের ঘটনাটা ভুলে যাইনি, আবারও সেই বাথরুমে ফিরবো। তার আগে ঘটনার একটু ইন্ট্রোডাকশান দিয়ে নিলাম। তো আগের দিন লাগলাম ইংলিশ গ্রামারের পেছনে-

Tense is the concept of time which may be present, past or future.

কোনো কাজ সম্পাদনের সময়কে :tense বা কাল বলে। Tense দ্বারা সময়কে উল্লেখ করা হয় এবং যা বর্তমান, অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ হতে পারে।

Example:-
I eat rice. (present)
I ate rice. (past)
I will eat rice. (future)

ঠিক করেই রেখেছি গ্রামার মেনে ইংরেজিতে কথা বলব। না পারলে চুপ থাকব। তবু কোনো বাঙালির সামনে ভুলভাল ইংরেজি বলে নিজের মান-সম্মান খোয়াবো না। পরদিন পেল্গনে ওঠার আগেই সবার সঙ্গে দেখা। যে তিনজন সঙ্গে যাবেন, তাদের আগে থেকেই চিনতাম। আজ প্রথম কথা হলো। শুরুতেই দেখা হলো টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব নওয়াজীশ আলী খানের সঙ্গে। উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা নিয়ে দুই একটা আলাপচারিতা হলো, তারপর চুপ। এলেন প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম ফারুক ভাই। তিনি তখন সম্ভবত সমকালে ছিলেন। কথা বলেই মনে হলো, বেশ আড্ডাবাজ। তার পরপরই এলেন প্রথম আলোর মানসুরা হোসাইন। কথা বলার তেমন সুযোগ পেলাম না। ভেবেছি, প্লেনে উঠেই কথা বলবো। কিন্তু তিনি প্লেনে ওঠার পর থেকেই কান্না শুরু করেছেন। তা সে যেমন তেমন কান্না নয়। হিচকি দিয়ে দিয়ে কান্না। কারণটা একটু পরেই জানতে পারলাম। তিনি তার দুধের বাচ্চাকে দেশে রেখে যাচ্ছেন, তাই তার বাঁধভাঙা কান্নার জোয়ার। ফাঁকে একটু বলে রাখি, এটা ছিল আমার প্রথম উড়োজাহাজ যাত্রা। জানালার পাশে বসব বলে ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু মানসুরা আপা কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বসে পড়েছেন জানালার পাশে। তাই চুপচাপ পাশের সিটে বসে পড়লাম। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। কর্মশালা চলার সময়টুকু বাদ দিয়ে তিনি পুরো জার্নিতেই কেঁদেছেন।

কর্মশালার চাপ কমলো দুই দিন পর। আনন্দের ব্যাপার হলো, আমি দুই দিনই পুরোপুরি মৌনব্রতর মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি। ভেতরে এত কথা, বলতে গিয়েও গিলে ফেলছি অনেক কিছু। যখনই কিছু বলতে যাই তখনই দেখি, আমার একপাশে নওয়াজীশ আলী খান অন্যপাশে গোলাম ফারুক ও মানসুরা হোসাইন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর আমি তখন সব কথা ভুলে যাচ্ছি। অথচ দিল্লির একটা টিমকে দেখলাম, তাদের একজন মাত্র ভালো মাত্রায় ইংরেজি বলতে পারে। অন্যরা হিন্দিতেই কথা বলে যাচ্ছে। ওই একজনই হিন্দি কথাগুলো ইংরেজিতে আনুবাদ করে যাচ্ছে। মনে মনে বললাম, ওরা কত অর্গানাইজড! আমারও তখন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। এত কথা মনের মধ্যে সামলাতে না পেরে আমি সেই কথাগুলো অনর্গল ফারুক ভাইকে বলে যাচ্ছি, আর উনি তা শুনে বলছেন, আরে, আপনি বলেন না কেন? এ তো দারুন পয়েন্ট; আলোচনায় উঠে আসা দরকার। আমি তাকে কীভাবে বোঝাই, লজ্জায় আমার গলা দিয়ে কোনো কথা বের হয় না।

যাকগে, কিছু বলতে না পারায় নিজেকে ফেইলিওর হিসেবেই ধরে নিলাম। আর তাই ভাবলাম, আমার সেকেন্ড অপশনকে তো আর ফেইল করানো যাবে না। ১ নম্বরটা ছিল ওয়ার্কশপ ভালোভাবে শেষ করা। আর ২ নম্বরটা হলো নাইট ক্লাবে গিয়ে স্ট্রিপ ড্যান্স দেখা। ওয়ার্কশপ শেষে বুঝলাম, আমার মতো এমন গোপন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিল্লির মেয়েরা আর আফগান ছেলেরা তো দেখলাম আরও আগানো। ইতিমধ্যে ওরা সব খবর বের করে ফেলেছে। সেই সঙ্গে ওয়ার্কশপে আসা এক নেপালি বাবুকেও ফিট করে ফেলেছে। মনে তো লাড্ডু ফুটছে অথচ ভাব নিয়ে বললাম, আমাদের জন্য জায়গাটা সেভ তো? যত যাই হোক, আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি, সেটা তো ভুলে গেলে চলবে না। নেপালি যিনি তাকে তো আমার পুরোই বাঙালি মনে হলো। ১০০% সেভ বলে বিনা দাওয়াতে এক বিয়েতে নিয়ে আমাদের খাওয়াল। তার পর বিন্দাস মুডে নাইট ক্লাবের দিকে যাত্রা শুরু হলো। প্লিজ, আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করবেন না, আর কোনো বাঙালি এই চুপি চুপি যাত্রায় সঙ্গে ছিল, কি ছিল না।

নিচের সব দোকান বন্ধ, দোতলা থেকে হিন্দি আর নেপালি পপ গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। আমরা একটা ক্লাবের বিশালদেহী গেটকিপারকে ক্রস করে ভেতরে ঢুকলাম। গেটকিপারদের দেখতে ভয়ঙ্কর মনে হয়। তবে ওরা হাসলে ওদের বাচ্চাদের মতো লাগে। যাই হোক, আগেই সব ঠিক করা ছিল। ৩০০ রুপির একটা করে বিয়ার কিনে বসব সবাই। এটাই সবচেয়ে লোয়েস্ট প্রাইসের ড্রিঙ্কস। আমরা তাই করেছি। হলঘরটা ‘দ’ আকৃতির। আমরা সবাই একদম শুরুতে গিয়ে বসলাম। মানে দ’য়ের প্রথম টানে। ৩০০ রুপির জল চলে এলো। পরীর মতো মেয়েরা আমাদের হাতে গ্লাস তুলে দিল। থ্যাঙ্কু বলার সঙ্গে সঙ্গে সবার গালে একটা করে চুমু! কী রোমাঞ্চকর! আমাদের এই গ্রুপে আমিই সবচেয়ে ছোট ছিলাম, তবে মেয়েরা সবাইকে সমান অ্যাটেনশন দিচ্ছিল। আর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে কিছু নিয়ম বলে যাচ্ছিল- ১, আমরা যে সারিতে বসা তাতে সব দেখা যাবে কিন্তু ছোঁয়া যাবে না; ২. দ’য়ের দ্বিতীয় সারিতে বসলে স্টেজের কাছে গিয়ে নাচা যাবে, নিচে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সঙ্গে নাচাও যাবে তবে ধরা যাবে না; ৩. দ’য়ের শেষের সারিতে যে স্পেসটা সেখানে বসে ড্রিঙ্কস নিলে মেয়েরা কোলে বসে সার্ভ করবে, চাইলে তারা চুমুও দেবে। যদি গেস্ট চায় তবে গেস্টদের সঙ্গে বসে ড্রিঙ্কও করবে। কথাটা হিন্দিতে বলে ইংরেজিতে রিপিট করলো। আমরা নিয়মগুলো বুঝেছি সূচক মাথা নাড়লাম। ওরা যাওয়ার পর স্টেজটা দেখছি।

এই সেই স্টেজ, যেটা আমি অনেক মুভিতে দেখেছি! লম্বা একটা পাইপ, ওটা ধরে কেমন করে শরীর ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মেয়েরা নাচে। মাত্রই একটা মেয়ে নেচে গেল। তাকিয়েই থাকলাম, চোখ আর সরে না। সরলেই তো মিস। দেখলাম নাচতে নাচতে কীভাবে শরীরের ভেতর থেকে উঁকি মারে শরীর! একটা মেয়ের থেকে কিছুতেই আমার চোখ সরছে না। একটু আজব লাগছে, তাই না? কোনো পুরুষ নয়; একটা মেয়ে আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করছে। তার পর একটা ছেলে নাচল। দুর্দান্ত নাচ। বলিউডের ঋত্বিক, শাহরুখ ফেইল ওর কাছে। তারপর গ্রুপ নাচ হলো। এভাবে চলতে থাকল অনেক রাত পর্যন্ত। স্ট্রিপ ড্যান্স হবে সবার শেষে। ওটাই এই ক্লাবের বিশেষ আকর্ষণ।

পরীর মতো যে মেয়েটা শুরুতে নেচেছিল, যাকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম; ও নিচে নেমে এলো। এর-ওর সঙ্গে কথা বলছিল। আমি আবারও মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে আছি। এ তো দেখি জীবনানন্দের- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য! মেয়েটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, ম্যা যতি (জ্যোতি) হু, কেয়া তুম মুঝসে বাত কারনা চাতিহো? আমি তো দাঁড়িয়ে গেলাম। ওর হাতটা ধরে বললাম, আপ বাহুত আচ্ছা নাচ করতা হায়। ও আমার পাশেই বসে পড়লো, আমিও বসলাম। নিজে থেকেই বললো, ওর বাড়ি ভারতে ছিল। এখন এখানেই থাকে। এখানেই ওর ভালো লাগে। আমরা আসি, ওদের নাচ দেখে আনন্দ পাই; তাতেই ওর আনন্দ। আমি হিন্দি আর বাংলা মিলিয়ে যতিকে বললাম, জানো আমার বহুত ইচ্ছে থা এয়সা নাচ দেখনেকা। আজ তা পূরণ হুয়া। ও এইবার উঠলো। বললো, কিছু দরকার হলে যেন যতিকে ডাকি। পাশে তাকিয়ে দেখি গ্রুপের আমরা তিনজন মেয়ে ছাড়া বাকিরা হাওয়া। সব আকর্ষণ গিয়ে জমা হয়েছে ক্লাবের শেষ অংশে। সুন্দর সুন্দর মেয়েরা একেক জনের কোলে বসা। চুমু খাচ্ছে, জল খাচ্ছে। আমি আর ওদিকটায় গেলাম না। একটু পরই শুরু হবে স্ট্রিপ ড্যান্স। আমি তা দেখার অপেক্ষায়।

ভাবলাম, শুরুর আগে একটু বাথরুমটা সেরে নিই। যতিকে খুঁজছি। একটা মেয়ের কাছে জানতে চাইলাম, যতি কোথায়? বলল, শেষের দিকে আছে। কেন দরকার, জানতে চাইলে বললাম বাথরুমে যাব। মেয়েটা তখন ড্রিঙ্কস সার্ভ করছিল, একটু ওয়েট করতে বলে চলে গেল। একটু পর এসে বলল, আও মেরে সাথ। বাথরুমের দরজাটা দেখিয়ে দিল। বাথরুমে ঢুকে ঘুরে যেই ছিটকিনি লাগাতে যাব দেখি যতি বাথরুমের ভেতর! ছিটকিনি লাগাচ্ছে! এই মেয়ে এখানে কেন? আমি বললাম, তুমি? হাঁ, ম্যায় যতি। আরে তুমি যতি হও, দাঁড়ি হও; কমা-কোলন বা ড্যাশ- তাতে আমার কী? তুমি আমার সঙ্গে বাথরুমে ঢুকছ কেন? যতি আমার হাতটা ধরে বলল, ‘কারো যো কারনা হ্যায়।’ ও কি আরও ছোট জামা পরেছে নাকি? নাচন-কোদন ছাড়াই আমি ওর লাল প্যান্টি দেখতে পাচ্ছি। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! শরীরটা পুরাই হিম হয়ে যাচ্ছে। ভয়ের চোটে বুক এমন ধড়ফড় করছে, কিছুতেই আর থামছে না। হায় হায়! আমার এখন কী হবে? কাল যদি ওয়ার্কশপে জয়েন করতে না পারি? যদি জোরাজুরি করে? বাংলাদেশে যদি এ খবর চলে যায়?

দেশ ছেড়ে আসার আগে আম্মা মিলাদ পড়িয়েছে। পাড়াতো সব খালাম্মাকে ডেকেছে। সবাইকে বলছে, বালা-মুসিবত দূর করার দোয়া পড়তে। আমি তো বুঝেছিলাম, আম্মা সবাইকে জানাতে চেয়েছে, তার মেয়ে অফিস থেকে বিদেশ যাচ্ছে। তাও আবার উড়াজাহাজে চড়ে! হায় আল্লাহ! আম্মা জানলে আমার কী হবে? মন চাচ্ছে নিজের গলা নিজেই চিপো ধরে মরে যাই। কোনো দোয়া মনে করতে পারছি না। হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বালা-মুসিবত দূর করার দোয়া- ‘বিসমিল্লাহ্‌?ই আল্লাহুম্মা জান্নিবনিশ শায়তানা ওয়া জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাকতানা… আরে এইটা তো সহবাসের আগের দোয়া। ইয়া আল্লাহ, আমার সঙ্গে কী হচ্ছে?

আমি আবার এই দোয়া কবে শিখলাম? আচ্ছা মনে পড়েছে- আল্লা-হুম্মা ইন্নি আউ-জুবিকা মিন আ’জা-বিল ক্ববরি। না না, এটাও না। এটা তো কবরের আজাব থেকে মুক্তির দোয়া! উফ্‌! মনে তো হচ্ছে, কবরের মধ্যেই আছি। মাথাটা কাজ করছে না। মাথার মধ্যে তো সারাক্ষণ শয়তানি বুদ্ধি ঘোরে; কাজের সময় কাজের কথা মনে আসবে কীভাবে? যতি আমার দিকে তাকিয়েই আছে। ইয়েস ইয়েস। বিপদ থেকে উদ্ধারের দোয়া মনে পড়েছে। দোয়া পড়া শুরু করেছি যেই, যতি আবার এসে আমার হাত ধরেছে। ওর হাতটা সরানোর শক্তিও পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, ও যদি আমারে কমোডে বসিয়েও দেয়, আমি মনে হয় বসেই পড়ব। ও আস্তে করে বলছে, ম্যায় হেল্প কারো? আমিও দেখি, ফিসফিস করে বলছি, নেহি। ও বলল, তো কারো যো কারনা হ্যায়। আমিও তারে সেই ফিসফিস করেই বলে যাচ্ছি, ম্যায় আম্মাকা এক আলাভোলা নাদান বাচ্চা হু। ম্যায় ইহা তো দেখনে কে লিয়ে আহি হু, কুছু করনেকো লিয়ে নেহি আতা হ্যায়। আপ গলাত সামঝতা হ্যায়। এইবার যতি খুব জোরে জোরে হাসছে আর বলছে, ঘাবরাও মাত, থোরা জোরসে বোলো। আমি তখন তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। ও তখন বলল, তো তুমনে মুঝে বুলায়া কিও? আমি তারে বললাম, আমি তো তোমারে বুলাই নাই। তোমারে ছাড়া কিসিকো চিনি না। বাথরুমটা নেহি চিনতা হায়। যতি বলল, ও ইয়ে বাত হায়? আচ্ছা ম্যায় যা রাহা হু, কোয়ি বাত নেহি। তুম হামারা গেস্ট হো। তুম খুশ হো তো হাম ভি খুশ। যাওয়ার সময় গালে একটা টোকা দিয়ে বলল, তুম বহুত কিউট হো। মাথাটা এবার একটু একটু কাজ শুরু করেছে। বাথরুম থেকে বের হলাম। দেখি আমার সঙ্গের দুইজন, ওদের নাম মনে নেই, আমার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলছে? উই হ্যাব টু লিভ নাও। আমি জানতে চাইলাম কেন? স্ট্রিপ ড্যান্স কি শেষ! বললো, না, বাইরে চলো, সব বলছি।

কাউন্টারের সামনে অন্যরা দাঁড়ানো। ওরা বলল, টাকা শর্ট পড়েছে। যার কাছে যত আছে দাও। কত আর শর্ট পড়বে, এই ভেবে ব্যাগে হাত দিতে দিতে জানতে চাইলাম কত বিল আসছে? আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে কি-না ২৮ হাজার রুপি! মানে কী! কত খেয়েছ তোমরা? নাকি অন্য কিছু করে ধরা খেয়েছ? কারও মুখে কোনো রা শব্দ নেই। আর আমাদের নেপালি বাবুর মুখ তো একেবারে চুন। তার ভরসা পেয়েই না আমরা এখানে এলাম। ও তখন আমতা আমতা করে বলল, বিষয়টা আগে বুঝতে পারেনি। তা কোন বিষয়টা বোঝনি? আমাদের তো কথা ছিল, প্রত্যেকে ৩০০ হিসাবে ২১শ’ রুপিতেই বিল ক্লোজ করব। ওরা যে বিষয়টা বোঝেনি, সেটা শুনে আমি থ। কাহিনী ওই যতিকে দিয়েই শুরু। ও কারও একজনের কোলে বসে ড্রিঙ্কস করেছে আর ঠকাস ঠকাস চুমু খেয়েছে। এটা দেখে ওন্যদের মনেও লাড্ডু ফুটেছে। তারা বলেছে, আমরাও চাই। যতি কোনোরূপ বিরাম চিহ্ন না দিয়ে অন্যদের ডেকে এনেছে। মেয়ে তো নয় যেন একেকটা পরী! এসে কোলে বসেছে, চুমু খেয়েছে; সঙ্গে ড্রিঙ্কও করেছে। এদের যতবার জিজ্ঞেস করেছে- খাই? এরা বোকার মতো ততবারই বলেছে, খাও। ঘটনা হলো, টেবিলে যার পারমিশন নিয়ে মেয়েরা ড্রিঙ্ক করবে, বিলটা তার নামেই জমা হবে। কারও কারও কোলে নাকি দুইটা করেও এই পরী বসেছিল। নো ডাউট, এই পরীরা বেস্ট ওয়ান ড্রিঙ্কসটাই অর্ডার করেছে। আর বিলটাও এসেছে সেই হিসাবে। এখন স্ট্রিপ ড্যান্স শুরুর আগে বিলটা ধরিয়ে দিয়ে গেছে। কিচ্ছু করার নেই। বিল না দিয়ে বের হওয়া যাবে না। এত নাটকের ভিড়ে, এক ফাঁকে যতি আমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে কী কী সব বলল আমার তা কিছুই মনে নেই। শেষে ও যে কথাটা বলল, সেটা সাংঘাতিক! আমার হাতটা ধরে হাল্ক্কা একটু চাপ দিয়ে বলল, এইভাবে আর কখনও কারও হাতে চাপ দেবে না। এই চাপের মানে, তুমি আমাকে আহ্বান করছ। আর তুমি এটা আমার সঙ্গে দু’বার করেছ। শুনে আমি তো আঁৎকে উঠি!

দিল্লির এক প্রফেসর আর এক আফগানি মিলে দিল ২২ হাজার রুপি। বাকিটা সবাই মিলে পরিশোধ করলাম। স্ট্রিপ ড্যান্স না দেখেই বের হয়ে যাচ্ছি, আর যতি কিছু বলতে না দিয়েই ভেতরে চলে গেল। আমাদের যথারীতি হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা টাইপের অবস্থা। গাঢ় নিস্তব্ধতা নিয়ে আমরা হোটেলে যে যার রুমে ফিরে গেলাম।

সেই কবেকার কথা। এর পর বেশ কয়েকবার নেপাল গেছি। কত স্মৃতি এনকোড করেছি, কত ডিকোড! সেই পথ দিয়েও দিনের বেলা ঘুরে বেড়িয়েছি। খুব করে চেয়েছি যেন যতির সঙ্গে আর একবার দেখা হয়। ওর প্রতি আমার এই গভীর টানের কোনো রহস্য আমি জানি না। যতি হয়তো আমার কথা ভুলেই গেছে, কিন্তু আমি পারিনি। মনকে একটা কথাই শুধু বলেছি- সে ভোলে ভুলুক, আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না…।

(মূল লেখাটি দৈনিক সমকাল এর কালের খেয়াতে প্রকাশিত হয়েছে)

শেয়ার করুন: