সুচিত্রা সরকার:
বলে রাখা ভালো, রাজনীতি মানে আজকে আমরা যা দেখছি, তা নয়। রাজনীতির মানে ছিল অন্যরকম, অন্য কিছু। রাজনীতি মানে ছিল মানুষের জন্য। রাজনীতির মানেটা হতে পারতো, মানুষেরতরে কিছু একটা করার জন্য প্রবল আকাঙ্খা।
বদলে ভোটের আগে ও পরে আমরা যে মারামারি, হৈ-হুল্লোড় দেখে অভ্যস্ত, তা গণমানুষের জীবন মসৃণ করতে নয়। এ রাজনীতি শুধু ব্যক্তিকে চূড়োয় তোলে। আর অকৃত্রিম অন্ধকারে পড়ে থাকে জনজীবন। ভাগাড়ে!
তাই সেরকম রাজনীতি যেহেতু নেই, (যতটুকু আছে, মানুষের সম্পৃক্ততা কম সেখানে) তাই পুরো রাজনীতি নিয়ে মানুষের মনে বাস করছে চরম ভয় আর বিরক্তি। গণমানুষের কাছে রাজনৈতিক মানেই নচ্ছার, পাজি আর দস্যুর দল। তাদের সে বিশ্বাসে চিড় ধরাবো, তেমন কিছু করে উঠতে পারছি কই!
তার উপর আসল কথাটি হচ্ছে, আজ বসেছি জনগণের বোঝার উপর শাকের আঁটি তুলতে। রাজনৈতিক নারীদের নিয়ে ভাবাতে!
এখানেই একটা বিশেষ দ্রষ্টব্য বসে যেতে পারে- আর এগোতে না চাইলে সরে পড়ুন। আর ভাবনাটা যদি সত্যি আপনার মনের কাছাকাছি বসতে পারে, তবে তাদের নিয়ে ভাবুন। রাজনীতি করা, মাঠের রোদে পোড়া সেই মেয়েগুলোকে নিয়ে। যারা চিরকাল বিপ্রতীপ সময়ে বাস করে।
এ সমাজে পুরুষ রাজনীতি করলে, তাও পাতে তোলা যায়। এলাকায় ডাকাবুকা, ডাকসাইটে। বিয়ের সময় পাত্রীপক্ষের কাছে বুক ফোলানোর এজেন্ডা। নারী রাজনৈতিক কর্মীর সেসব ‘ভাগ্যে’ জোটে না।
একটা বই পড়েছিলাম। অনেক অনেক বইয়ের মধ্যে ওটা পেয়ে গিয়েছিলাম। রাজনৈতিক নারীর অদ্ভ্যুদয়। সেখানে কয়েকটা লাইন দাগ কেটে আছে মনে-একজন রাজনৈতিক নারী, সমাজের আর পাঁচটা মেয়ের মতো বেড়ে ওঠে না। সে অন্যদের চেয়ে বেশি ভাবে সমাজ নিয়ে। জগত-জীবন নিয়ে। অন্যদের চেয়ে বেশি ডানপিটে। বেশি অনুভূতিসম্পন্ন। এরকম কিছু বৈশিষ্ট্য আর সময় মিলেই মেয়েটাকে নিয়ে যায় রাজনীতির কাছে।
অতঃপর সভা। মিছিল। মিটিং।
‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষ জন!’
টিয়ারসেল, অন্ধকার কালো ধোঁয়া।
‘হট মিটিং এ চোঙা ফুঁকেছি, গেট মিটিং এ গলা ভেঙেছি, চিনছি শহর গ্রাম।
স্লোগান দিতে গিয়েই আমি সবার সাথে আমার দাবি প্রকাশ্যে তুললাম।’
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্বভাব যে মেয়ের, অতঃপরের পর, তার কD হলো? মেয়েটি পরিবার থেকে আলাদা হতে শুরু করলো। মেয়েটির চেতনায় সে বুঝতে শুরু করলো, পরিবর্তনটা দরকার পরিবার থেকে। ব্যস! বেঁধে গেল। বাঁধিয়ে রাখলো একটা সাইনবোর্ড তার পরিবার! ওর কথা অতো ধরে লাভ নেই- ও মেয়ে বখে গেছে। ও মেয়ে যে রাজনীতি করে! সেই থেকে শুরু হয় রাজনৈতিক মেয়ের বিপ্রতীপ জীবন।
সবে সবে প্রীতিলতা, সিমোন, রোকেয়া, ওরিয়ানা পড়েছি। একটু একটু করে ঠাওড় করতে পারছি, মেয়েরা কেন পণ্য, কীভাবে পণ্য, কখন পণ্য।
সেরকম একদিন বিশাল অজগরের মতো একটা মানববন্ধন হলো। মুক্তাঙ্গনে। চেহারা ছবি ‘ভালো কোটা’য় সাংবাদিকরা জেঁকে বসলো। বা দাঁড়িয়ে গেল আমারই সামনে। ছবি তুলবো না। কারণ আমার ছবি বিক্রি করে আন্দোলন চলুক, চাই না। বন্ধুরা বললে, প্রচারটা দরকার। সাংবাদিক বললে না কিছু। রেগে গেলেন। গোঁ ধরলেন। বললেন, তুললে ওরটাই তুলবো, নইলে আমরা ফিরে যাবো। সভাপতি এলেন। গজরালেন। ‘বিশ্ব সুন্দরী নাকি? অতো দেমাগ ইত্যাদি ইত্যাদি’।
ধমকালেন। অনুনয় করলেন। বালিকা তখনো যে ভয় পায়। তাই মাথা নত।
পরদিন একটা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার তৃতীয় কলামে দুই ইঞ্চি একটা ছবি মানববন্ধনের। শুধু আমার মুখটা। নিচে একটা ক্যাপশন। সেই ‘মিষ্টি মার্কা’ ছবিটা সাংবাদিক এসে দিয়ে গেছিল। এতো ভালো ছবি, কাছে রাখাটা কর্তব্য!
পরদিনের পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী একটা উদ্ভট প্রস্তাব দিল। পত্রিকার ওই ছবিটা ওর দাদার বন্ধুর খুব মনে ধরেছে। বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে ওর মারফত। অবাধ্য ঘোড়া বশ করার আনন্দ বেচারাকে দিতে পারিনি।
এ সমাজ মানি না, সমাজ ভাঙতে হবে- সকাল বিকাল মিটিং চলে। বছর শেষে সম্মেলন। তো সেই সম্মেলনে গণ চাঁদা তোলা হবে। দল ঠিক হয়। প্রতিদিন সে উত্তোলনে উপস্থিত থাকতে হবে। দোকানে দোকানে গিয়ে বলতে হবে, আসছে অমুক দিন, অমুক ব্যাপার। সুতরাং …। আর পাঁচ জন বা ছয় জনের দল হলেও আমাকেই এপ্রোচ করতে হবে। কণ্ঠ ভালো, দেখতে ভালো, টাকা উঠছে।
বাড়ি ফিরে ক্লান্ত আমি দেখি পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। নারীবাদী বই বলা হয় যেগুলোকে, সেসবের পাতা উলটাতে গিয়ে দেখি, মনেও বিশাল একটা ফোসকা। টলটলে জল জমেছে তাতে।
তাই সেই মনের জল নিয়ে লড়াই শুরু হয় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়ে যাদের আপনার মতে হতো, তারাও শুরু করেছে বৈরী আচরণ।
এই যে কোটা আন্দোলন, খেয়াল করে দেখলাম, সংগঠনগুলোর পদবন্টনে দারুণ এক কোটা ব্যবস্থা। সদস্য, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ত্রাণ, সহযোগী সম্পাদক, সহ সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ- পদগুলো যেন তৈরিই হয়েছে নারীর জন্য। নারী থাকলে চোখ বন্ধ করে তাকে দিয়ে দাও। আর না থাকলে কোনো একটা মোটামুটি ‘অ্যাকটিভ’ কাউকে! শোভা বর্ধনে এর বেশি আর কী লাগে!
এই বেলা চোখটা একটু খুলুন তো আপনি! বা ইতিহাস ঘাঁটুন। কয়টা রাজনৈতিক দলের সভাপতি নারী? সংগঠনগুলোর বয়স তো মহাকাব্যতুল্য হতে চললো। বলবেন, নারীরা আনাড়ি, নারীরা অদক্ষ, নারীরা কমজোরি, নারীরা আবেগী ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর এসব ‘ছাতা মাতা’ সংজ্ঞায় নারীরা পড়ে যায় বলেই, যে নারী দলের কেন্দ্রে বাস করে, দলের মধ্যে তাকে নিয়ে শুরু হয় লড়াই। নারীকে উৎখাতের লড়াই। পুরুষ ভরকেন্দ্রে বাস করলে যে লড়াই, গ্রুপিং চলে না, তা নয়। তবে নারীর বিরুদ্ধে যেটা হয়, সেটাকে লড়াই বলে না। সেটা নির্লজ্জতা। রুচিহীনতার পরিচায়ক। তাই নেতৃত্বের মাঠে, নারীরা কোটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। কাঁহাতক এতো!
কারণ এরই মধ্যে তার ঘরের সঙ্গে সঙ্গে সমাজও সরব। ও মেয়ে মিছিল করে? ওই মেয়ে খ্যাপা মোষ? ও মেয়ে রাত-বিরেতে বাড়ি ফেলে। হাজারটা পুরুষের সঙ্গে চলে? শুধু চলে? নাকি শোয়া বসা-সব? পুরুষদের তো চেনাই আছে। ও মেয়েকে পাতে (পড়ুন ঘর) তুলবে কে?
সমাজের লড়াইটা সে লড়ে নিজের মতো করে। তাই কেউ সমাজের কাছে লুকোয় রাজনৈতিক পরিচয়। তারপর ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে যায় মাঠ থেকে। বা কেউ পরোয়া করে না সমাজকে। মাঠে পড়ে থেকে মার খায় ‘বাজে মেয়ে’র তকমা নিয়ে!
তাই ভাবি, সুদিন কি আসবে? যেদিন রাজনৈতিক নারীরা ঘরে- বাইরে নিন্দিত হবেন না? হোঁচট খাবেন না! বিশেষ চরিত্রের ইঙ্গিত পাবেন না!
আবার ভাবি, দিনটার দূরত্ব বেশ খানিকটা। যেতে হবে আরো দূরে। দ্বিগুণ, তিনগুণ শক্তি নিয়ে। কারণ পরিবারে, সমাজে, দলের ভেতরে রাজনৈতিক নারী যে লড়াইটা লড়েন, তা আদতে ‘তন্ত্রে’র বিরুদ্ধে লড়াই। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা একদল মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই। বুকে সাহস রাখা, প্রতিবাদের ভাষা চিনতে পারা নারীর, ক্ষমতায়নের লড়াই। শোষকের পতাকা টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলার লড়াই। লড়াইটা কঠিন। লড়াইটা যৌক্তিক। তাই আসুন স্লোগান তুলি!
২১.৪.২০১৮
বিকাল ৫.৩৩ মিনিট
লালবাগ, ঢাকা।