অচেনা প্রতিবেশী অজানা সম্পর্ক

জহুরা আকসা:

আমরা প্যারিসের বাইরের একটি সরকারি কলোনিতে থাকি । আমাদের বিল্ডিং এর নিচতলার তিনটা ফ্ল্যাটে তিনজন বয়স্ক মানুষ থাকেন । এদের মধ্যে একজন নারী আছেন, যাকে সবাই ‘ম্যামি’ বলে সম্বোধন করে। ওই নারীর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবই আছে । কিন্তু তারা কেউ তেমন একটা আসে না । একাই থাকেন তিনি । হয়তো তার সময়ও কাটতে চায় না । খেয়াল করে দেখেছি, তিনি সবসময় সিঁড়িতে কান পেতে রাখেন । এতো নিঃসঙ্গতা কার ভালো লাগে? তাই তো কেউ উঠানামা করলে তার সাথে তিনি গল্প জুড়ে দেন ।

প্রথম প্রথম আমি তার সাথে গল্প করতাম না, আসলে তখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না । তাই তিনি ভীষণ রাগ করতেন । নানা ছুতায় আমার বাসায় এসে অভিযোগের সুরে ঝগড়া করতেন । অবশ্য পরে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি যে, তার সমস্যাটা কোথায় ? তখন থেকে আমিও উঠতে-নামতে তার সাথে একটু গল্প করি ।


এই বৃদ্ধ মহিলার পাশের ফ্ল্যাটে আরেকজন বৃদ্ধ থাকেন । সম্ভবত তার মানসিক সমস্যা আছে । লোকটির হয়তো একটাই মেয়ে । কারণ গত তিন বছর ধরে এই একজন মহিলাকে শুধু দেখেছি তার কাছে আসতে । মহিলাটি বিবাহিত এবং তার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে । তবুও তিনি ও তার ছেলেমেয়ে সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা- রাত সব সময় বৃদ্ধের কাছে আসেন । তার সেবাযত্ন করেন । হয়তো বাবার প্রতি তার দায়িত্ববোধ একটু বেশি! সাধারণত এইসব দেশে এমনটা দেখা যায় না ।

এই দুইজন বয়স্ক লোকের তুলনায় অপর ফ্ল্যাটে থাকা লোকটির বয়স একটু কম । এই লোকটি আসতে যেতে তার পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধা মহিলার খোঁজ নেন । কখনো কখনো তার জন্য খাবারও কিনে আনেন ! বাজারও করে দেন । না এদের কারোর সাথে কারোর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই ।

বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি বৃদ্ধ মহিলাটি তার পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধার সাথে থাকছেন । তার রান্না করে দিচ্ছেন ! খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন । আর বৃদ্ধার মেয়ে এলে তাকে তার বাবার শারীরিক অবস্থার আপডেট জানাচ্ছেন।

আমাদের উপরের ফ্ল্যাটে আরেকজন মহিলা থাকেন। যার মাথার চুলগুলি একেবারেই ছোট ছোট। তিনি কখনো মেয়েদের মতো কোনো পোশাক পরেন না । গত তিন বছরে তাকে কখনো সাজগোজ করতেও দেখিনি । এমনকি শরীরে কোনো গহনাও পরেন না । তিনি অবিবাহিত এবং তার একটি ছেলে আছে । তার রং কালো হলেও ছেলেটির চামড়া একেবারেই সাদা । কেন জানি, পোশাকে এবং জীবন আচরণে মহিলাটিকে আমার স্বাধীনচেতা বলেই মনে হয় । তার আচার ব্যবহার অতি চমৎকার । সবসময় হাসিমুখে কথা বলেন । আমাদের সবার খোঁজ খবরও নেন !

তার ছেলেটি আগে আমার দরজার সামনে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসে থাকতো। তদের বয়স তখন ১৭ কী ১৮ ছিল। আমি দরজা খুলেই তাদের প্রেমের দৃশ্য দেখতে পেতাম । আর নিজে নিজেই খুব লজ্জিত হতাম । ব্যাপারটা একদিন আমার স্বামীকে বললাম । সে উল্টো আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বললো, “তারা তো প্রেম করছে, খারাপ তো কিছু করছে না। তোমার এতো মাথা ব্যথা কেন?”

আমার মেয়ের জন্ম হওয়ার ৪/৫ মাস পরে এই অল্পবয়সী মেয়েটিও একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেয় । গত তিন বছর ধরে এই অল্পবয়সী ছেলে ও মেয়ে দুইটি “একটি প্রেমময় সম্পর্কে” আছে । যেই সম্পর্কে তাদের একটি ছেলে সন্তান হয়েছে । যেই সন্তান জন্ম দিতে মেয়েটিকে বিয়ে করতে হয়নি । না কোথাও বাবার নাম দরকার পড়েছে । আবার শিশুটিকে মানুষ করার জন্য তাদের তেমন টাকা খরচ করতে হয় না । কারণ তাদের সন্তানের খরচ সব সরকার বহন করছে । তারা দুইজন এখনও একসঙ্গেই পড়াশোনা করছে ! বেশ চমৎকার একটি সময় কাটাচ্ছে তারা!

এই বাড়িতে আরও একজন অবিবাহিত মহিলা থাকেন । তার ৮/৯ বছরের একটি মেয়ে আছে । এই মহিলাটি আবার খুব ফ্যাশনিস্ট । সবসময় সাজগোজ করে থাকেন । গায়ের রং কালো হলেও তিনি দেখতে বেশ চমৎকার । যখনই তার সাথে দেখা হয় আন্তরিকতার সাথে কুশল বিনিময় করেন । তিনি বেশ দায়িত্ববান । কারণ যেদিন আমাদের কলোনিতে আগুন লেগেছিল । সেদিন তিনি সারাক্ষণ তার মেয়ের সাথে সাথে আমার মেয়েটিরও হাত ধরেছিলেন ।

আমাদের ফ্ল্যাটে একটি আরবি বংশধর ফরাসি পরিবার থাকে । এই পরিবারের মহিলাটি চাকরি করেন । আর পুরুষটি নিজের গাড়ির গ্যারেজে কাজ করেন । দিনের বেশিরভাগ সময় পুরুষটি বাসায় থাকেন আর ঘরের কাজকর্ম তিনিই করেন । তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই বেশ মিশুকে । সবসময় আমার আর বাচ্চাদের খোঁজ নেন । একদিন মহিলাটি আমাকে ডেকে বললেন, “যদি কখনও তোমার স্বামী তোমাকে মারধর করে তাহলে আমাকে বলবে। আমি পুলিশ ডাকবো !” বোঝা গেলো তিনি তার এবং অন্যের অধিকার নিয়ে বেশ সচেতন ।

কিছুদিন আগে আমাদের পাশের ফ্লাটে একজন মাঝ বয়সী ডিভোর্সি মহিলা ছিলেন। তার দুইটি ছেলেমেয়ে ছিল, যারা সবাই বিবাহিত এবং আলাদা থাকতো। এক বছরের মধ্যে দেখলাম মহিলাটির সাথে একটি ছেলেবন্ধু থাকতে এসেছে । ছেলেটিকে দেখে মহিলার চাইতে ১০/১২ বছরের ছোট বলে মনে হতো। তিনি ঐ ফ্ল্যাটে থাকবেন বলে বেশ টাকা খরচ করে ফ্ল্যাটটি সাজালেন গোছালেন । কিন্তু বেশিদিন আর থাকলেন না । এর কিছুদিন পরে তিনি বাড়ি পাল্টালেন ।

আমাদের দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট তার চেয়ে ২৪ বছরের বড় একজন নারীকে বিয়ে করেছেন । তাও ভালোবেসে, প্রেম করে ! প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর এটা দ্বিতীয় বিয়ে । তার আগের ঘরের সন্তানও আছে । আমাদের আগে যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি যখন নির্বাচিত হোন, তখন তিনি তার বান্ধবীর সাথে থাকতেন । পূর্বের প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন স্ত্রী একই রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ঐ নির্বাচিত মন্ত্রিসভার একজন সদস্য।

এইসব দেশের শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ আর স্কুল কলেজের শিক্ষার আমাদের দেশগুলির চাইতে ভিন্ন । এইসব দেশে একটি ছেলেমেয়ে জীবনধারনে যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা পায়, তা আমাদের দেশে একেবারেই নেই । সামাজিক আর অর্থনৈতিক কারণে এদের চিন্তাভাবনা অন্য রকম হয় । তাই এদের কাছে সম্পর্কের ধরন এবং চর্চা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।

এইসব দেশের ওপেন রিলেশনশিপ, বিয়ে কিংবা লিভ টুগেদার কোনো কিছুর সাথে বাংলাদেশের নর-নারীর সম্পর্কের তুলনা করা সম্ভব না । এদের কাছে ওপেন রিলেশান মানেই একই সঙ্গে একাধিক সম্পর্ক নয় । বরং কাঠামোগত কোনো সম্পর্কে না জড়িয়ে নিজেদের মাঝে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা । যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি হলো ভালো লাগা, স্বচ্ছতা আর বিশ্বাস।

অন্যদিকে আমাদের দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হলো ধর্মীয় এবং সামাজিক বন্ধন। আমাদের দেশের সামাজিক সম্পর্কগুলি শুধুমাত্র দায়-দায়িত্বের মধ্যে বাধা থাকে । বেশিরভাগ সম্পর্ক একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না ।
আমাদের দেশে শিশু জন্ম হয় বাপের নাম দিয়ে । স্কুল কলেজ চাকরি সর্বত্র বাপ স্বামীর নাম লাগে । এমনকি নারীর কবর রেজিস্ট্রি করতে হয় স্বামীর নাম দিয়ে । তাই আমাদের দেশের সামাজিক সম্পর্কগুলির সাথে এইসব দেশের বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কের তুলনা অযৌক্তিক ।

নাগরিক হিসেবে উন্নত বিশ্বের মানুষরা এমনেই অনেক সচেতন । এছাড়াও তারা একে অন্যের অধিকারের ব্যাপারের অনেক যত্নশীল । তাই উন্নত বিশ্বের সামাজিক সম্পর্কগুলির মতো করে বাংলাদেশে সামাজিক সম্পর্কের চর্চা হলো শাকপাতা দিয়ে গরুর মাংস রান্নার মতো ।

তবুও বলি, পৃথিবীর সকল সামাজিক সম্পর্কগুলোই সুন্দর । আর এই সুন্দর সম্পর্কগুলি বেঁচে থাকুক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.