স্বৈরাচারের লিঙ্গপরিচয় থাকে না

আর রাজী:

গত ত্রিশ বছরে দু’টো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভেতর থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের হলের পরিস্থিতি। থাকার-খাবার-সুযোগ-সুবিধা অতি নিম্ন মানের। আজও রাতে দুঃস্বপ্নে হল-জীবনের ভেসে যাওয়া বাথরুম-টয়লেট মোকাবিলা করি আমি। খাবার কক্ষের নোংরা-দুর্গন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে। এসব পরিস্থিতি বদলায়নি। বদলায়নি হল-ব্যবস্থাপনার চিত্র। বরং পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে। যুগের পর যুগ অধিকাংশ হল দখলে রেখে চলেছে কিছু রাজনৈতিক গুণ্ডা। তাদের কথাই হলের আইন।

আবাসিক হলে আসন-বরাদ্দের একটা আয়োজন আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকা ঝুলিয়ে দিয়েই হল কর্তৃপক্ষ কাজ শেষ করে ফেলে। যার যোগাযোগ ও/বা শক্তি আছে সে হলে উঠতে পারে। বাকিদের ভিন্ন ব্যবস্থায় পাড়ি দিতে হয় শিক্ষাজীবন। কিন্তু যারা হলে স্থান পায় তারা আসলে ঠাঁই পায় নরকে। এই অবমাননার জীবন রক্ষায় সবার আগে বিসর্জন দিতে হয় ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতা। “জুলুম যার, হল তার”- এই রীতি মেনে নিয়েই হলে থাকতে হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে।

ছাত্রজীবনে দেখেছি এই জঘন্য পরিস্থিতির পাহারাদার বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষকরা। শুনতে পাই, প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হলের কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধেই যান না। মাস্তানদের বিরুদ্ধে রা-টি করেন না। যখন যে পক্ষের দখলে হল, শিক্ষকরা সেই পক্ষের রক্ষক হয়ে যান। কেবল অনিয়ম-অন্যায়-জুলুমের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সহায়তা করে যান তারা। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নির্যাতনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে, হাত-পা ভেঙে দিলে কিংবা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কারণে কালেভদ্রে হলগুলোর নির্যাতনের খবর আমরা যা জানি, তা ওই নরকগুলোর বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সামান্য অংশ। নানান কুকর্ম করার, ক্ষমতা প্রদর্শন আর ক্ষমতা বিস্তারের এক অবাধ ক্ষেত্র হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। নানান কারণে শিক্ষার্থীরা হলে থাকতে বাধ্য হয়। এদের জিম্মি করেই চলে ক্ষমতার মহড়া। যারা এই নির্যাতন পরিচালনা করে তারা সবাই হয়ে ওঠে এক একটা ক্ষুদে স্বৈরাচার। সে তখন ছাত্র বা ছাত্রী থাকে না, হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, জিএস, এজিএস, কখনো কেবল নেতা বা নেত্রী! এরা প্রতিদিন আবাসিক শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বকে, স্বাধীনতাকে জুতায় পিশে চলে, মিছিল করায়, গেস্টরুম করায়, অবাধ্য হলে কান ধরে উঠবস, চড়-থাপ্পড়-লাথি সব চলে। মুখ বুজে সহ্য করে থাকতে পারলে, শিক্ষার্থীরা থাকে; নইলে হল ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্য কোথাও।

একবার মাঝ রাতে এক নেতার ক্যাডাররা আমায় আমার কক্ষ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে বলেছিল- “নেতা যদি বলে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠছে, তুই তাই কইবি। কথা কস ক্যান হারামজাদা?” এই গুন্ডারা কেউ নারী না, পুরুষ না, এরা ক্ষমতার অংশ জানোয়ার। মাঝে মাঝে এদেরই ওপর ক্ষিপ্ত হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যেমন সমস্ত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে হয় বিপ্লব। বিপ্লব নিত্য হয় না, প্রতিরোধ নিত্য গড়ে উঠে না কিন্তু ঘৃণা তাদের দিকে প্রতিমুহূর্তে ছুঁড়ে দেয় হলের শিক্ষার্থীরা। ঘৃণা যদিও ওই পাষণ্ডদের কোনোভাবেই স্পর্শ করে না। যদি আকস্মিক কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় কোনো দিন তাদের কারও গলায় জুতার মালা ওঠে, যদি নিত্য নিগৃহীত শিক্ষার্থীদের হাতে সে লাঞ্ছিত হয়, তখন হেসে ওঠে নিষ্পেশিত হাজারও হৃদয়।

মনে রাখা দরকার, স্বৈরাচারের কোনো লিঙ্গপরিচয় থাকে না। স্বৈরাচারের এক মাত্র পরিচয়- সে স্বৈরাচার। পরাস্ত হলে করুণা বা বিচার তার ভাগ্যে জোটে না। অনেক সময় সে তা চাইতেও পারে না। যদি সে বিচার দাবি করে, তার আগে অনুষ্ঠিত হতে হয় তার নিজের সংঘটিত সকল অপকর্মের বিচার। কিন্তু কোনো স্বৈরাচারেরই তা মনে থাকে না।

দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বৈরাচার তৈরি করার নেপথ্য-নায়করা চিরকাল সব কিছুর ঊর্ধ্বে রয়ে যায়। এমন কি ঘৃণা থেকেও রেহাই পেয়ে যায় তারা। কেবল দুইটা বেশি পয়সা আর থাকার জায়গার বিনিময়ে অতিরিক্ত দায়িত্বের নামে এঁরা যুগের পর যুগ পাহারা দিয়ে চলেছে এই ক্ষুদে স্বৈরাচারদের!
যদি পরিস্থিতি বদলাতে হয় তাহলে এই নেপথ্যের অপনায়কদের দিকেই ছুঁড়ে দিতে হবে ঘৃণা, তাদেরকেও আনতে হবে জবাবদিহিতায়। সম্ভবত এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই পারে পরিস্থিতি বদলে দিয়ে তাদের অনকূলে আনতে। শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ আন্দোলন কি সে ভরসার কথা বলে?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.