তানিয়া মোর্শেদ:
অল্প সময়ের জন্য ফেইসবুকে এসে যেদিন জেনেছি, বিউটি অনার কিলিঙের শিকার নিজের বাবার হাতে, সেদিন ভেবেছি, আমাকে কিছুদিনের জন্য হলেও সবকিছু থেকে দূরে থাকতে হবে। নিজের যুদ্ধটাতেও বিশেষ সুবিধে করতে পারছি না। ব্যাকের ব্যথা এখন গত বৎসরের মতো প্রতিনিয়ত। সিটিস্ক্যান বলছে, ব্যাকের স্পট কিছুটা বেড়েছে। ফেইসবুক, বাংলাদেশের টিভির খবর, সারাবিশ্বের খবর, সবকিছু কোথাও, কাউকে কোনভাবেই সামান্যতমও ভালো থাকতে দেয় না। কেবলমাত্র চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক হলেই ভালো থাকা সম্ভব।
গত দু’দিন মাঝে মাঝে ফেইসবুকে এসে বোঝার চেষ্টা করেছি, কোটার আন্দোলন কী কোটা সংস্কারের আন্দোলন, না পুরোপুরি কোটা তুলে দেবার আন্দোলন! এতোটাই মতপার্থক্য দেখলাম যে এখনও পুরো নিশ্চিত নই, পথে নামা আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের কথা বলেছে, না কোটা তুলে দেবার কথা বলেছে?
মানুষ মানুষের, সমাজের, দেশের ভালোর জন্য আইন, নিয়ম করে। কিছু কিছু আইন, নিয়ম সর্বকালের জন্য। যা সব সময়ের জন্য সবার জন্য মঙ্গলময়। আবার কিছু নিয়ম, এমনকি আইন সময়ের সাথে সাথে সংস্কারের দাবি রাখে।
পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই, প্রায় বলছি, কারণ সব দেশের কথা জানি না, পিছিয়ে থাকা তা যে কারণেই হোক না কেন, জনগোষ্ঠীর জন্য বাড়তি কিছু সুবিধা বা কোটা থাকে। এটা করা হয় সমাজ-রাষ্ট্রে বৈষম্য দূর করা, কমানোর জন্য। সময়ের সাথে সাথে এই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কোনো কোনো গ্রুপ এই তালিকা থেকে বের হতে পারে, আবার অন্য কোনো গ্রুপ যুক্তও হতে পারে।
এক সময় সবদেশেই নারী শিক্ষা-কর্মক্ষেত্র সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত ছিল। সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু দেশে নারী সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসছেন। তবে সেইসব দেশেও সব নারীর অবস্থান এক নয়। অবস্থান ভাবতে হলে নারী কোন বিত্তে, কখনো কোন ধর্মে, কখনো কোন রেইসে, কখনো কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, তা ভাবতে হয় এখনও। আবার অনেক রাষ্ট্রেই উচ্চবিত্ত-উচ্চ শিক্ষিত-ধর্মীয় ও রেইসের দিক দিয়ে সংখ্যাগুরু নারীর অবস্থান থেকে সেই রাষ্ট্রের বিত্তহীন-অশিক্ষিত- ধর্মীয় বা রেইসের দিক দিয়ে সংখ্যালঘু পুরুষ সুবিধাবঞ্চিত অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে এই সুবিধাবঞ্চিত পুরুষ সবদিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানের সেই নারীর থেকে শিক্ষা-কর্মক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা বা কোটার দাবি রাখে। এভাবে প্রতিটি নারী বা পুরুষের জন্য আলাদা করে নিয়ম করা খুব কঠিন। সেজন্য গ্রুপ করে কোটা বা বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়।
গ্রুপের কারণে এক পর্যায়ে দেখা যায়, কোনো ব্যক্তির বাড়তি কোটার প্রয়োজন নেই, তবুও তিনি তা পাচ্ছেন, আবার যার প্রয়োজন তিনি পাচ্ছেন না। কোটা সংস্কার তখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে এখনও নারী কোটার প্রয়োজন আছে, তবে তারও সংস্কার প্রয়োজন। শহুরে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের নারী যিনি একজন পুরুষের সমান শিক্ষার সুযোগ পান, তিনি কেন কোটার মাধ্যমে কাজে ঢুকবেন? হ্যাঁ, শহুরে মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্তের নারীও সমাজ-রাষ্ট্রে এমনকি নিজ পরিবারেই অনেক সময় বৈষম্যের শিকার হোন। সেই সব বৈষম্য দূর করার জন্য ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে অন্য ভাবে। কোটা দিয়ে নয়। কাজেই নারী কোটা কাদের জন্য নয়, আর কোন নারীর জন্য এই কোটা, তা সংস্কার করতে গবেষণা প্রয়োজন।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু (যে কোনো কারণে) জন্য কোটা পদ্ধতি সব সময়ের দাবি। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও যুদ্ধাহত পরিবারের জন্য কোটা অবশ্যই থাকবে। তবে সময়ের সাথে তা সংস্কার প্রয়োজন হলে করতে হবে। যেমন নারী কোটার ক্ষেত্রে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে যেমন যুদ্ধে গেছেন, তেমন গ্রামের অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবার থেকেও গেছেন। তাঁরাই সংখ্যায় বেশি।
শহরের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত পরিবারের শহীদ বা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবার সম্পূর্ণ পথে বসেছেন যুদ্ধ শেষে, এমনটিও অসংখ্য। যুদ্ধ শেষে তাঁদের সবার জন্যই রাষ্ট্রের কিছু করা ছিল অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু দুঃখজনক তা ঘটেনি। সবচেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন গ্রামের অশিক্ষিত-বিত্তহীন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে তো আবার মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার, এই পরিচয়ের জন্য বিশেষভাবে টার্গেট হতেন।
আবার মুক্তিযোদ্ধা তো নয়ই, রাজাকারদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে সব ধরনের সুবিধা ভোগ করেছে, এখনও করছে এমন সংখ্যায় অনেক। এখনও খবরে আসে মুক্তিযোদ্ধা পথের ভিখিরি, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। আবার এমন মানুষের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আছে, যার রাজাকার পরিচয় প্রমাণ দেবার মানুষ এখনও বেঁচে আছেন।
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কারা কোন প্রজন্ম পর্যন্ত কোটার সুবিধা পাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করার আগে প্রশ্ন করুন, এখনও সময় আছে কিনা বঞ্চিত-অবহেলিত-অসুস্থ কোন মুক্তিযোদ্ধাকে জীবনের শেষ সময়ে কিছুটা ভালো রাখার? আর মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার সময়ের দাবি হলে করতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর পরিবার যেন বঞ্চিত না হোন, কোনো রাজাকার তো বটেই, মুক্তিযোদ্ধা নন এমন কেউ যেন এই কোটার সুবিধা না পান, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
আর যে নারীর কোনো কোটার প্রয়োজন নেই, তিনি যেন কোটার সুবিধা নিজে থেকেই না নেন, সেই শিক্ষায় আলোকিত করুন কন্যা সন্তানকে।