কাহাদের বিরুদ্ধে লড়িলাম?

শেখ তাসলিমা মুন:

এবার বলি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। তাঁদের পরিবারের কথা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা না বলি। সেসব বলে কোনো লাভ নেই। থার্ড জেনারেশন যুদ্ধ করে যাচ্ছে শুধু পরিবারের আয়ক্ষম ব্যক্তিটি চলে যাওয়ায় যে যুদ্ধ তাঁদের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি টানতে টানতে।

এবার ধরুন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ পরিবারের থেকেও তাঁদের অবস্থা বেশি কষ্টের। পরিবারের আয়ক্ষম মানুষটিকে যখন বছরের পর বছর অসহায় পঙ্গু হয়ে বসে থাকতে হয়, ধুঁকতে হয়, সেই পরিবারটির জন্য অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়ানো কতটা কঠিন কেবল ভুক্তভোগীরা জানে।

এ পরিবারগুলো কোনদিন কোনো সুবিধা পায়নি। তারা কেবল হতাশার ভেতর ডুবে থেকেছে। খুব বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি জিয়া এবং এরশাদের দলে যোগ দিয়ে বলেছে, ‘৭১ এ আমারা ভুল করেছিলাম!’ বিশ্বাস করুন, আমার নিজ কানে শোনা। একটু সুবিধা পাওয়ার জন্য। অভাব বড় ভয়ানক বিষয়!

আমাদের শহীদ পরিবারদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’ দু’ভাগ হয়েছিল কেন বলি? এক গ্রুপ সুবিধার কাছে বলি হয়ে গিয়েছিল। নাম-ধাম বলবো না। তারা কেউ কেউ মিডিয়াতে। কষ্ট এবং বেদনায় মাথা নিচু করি।

মূলত এমন একটি ধারণা আমাদের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে হয় আদর্শবানরা মার খেয়ে খেয়ে ধুঁকবে, নতুবা তারা নীতি হারাবে। মধ্যবর্তী কোনো পথ যেন নেই। ছিল না। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কথাই যখন বলা যেতো না, আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াদের আবার সুবিধা! পারলে সারা জীবনের জন্য শব্দটি উঠিয়ে দেয় তখন! ২০১২ সালেও অনেককে বলতে শুনেছি, ৪০ বছর আগে হয়ে যাওয়া বিষয়ের আবার বিচার কী? টেলিভিশনে, নাটকে মহাজন নাট্যকাররা এসব রোলে অভিনয়ও করেছেন। পরিষ্কার মনে আছে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে ভাতা টাতা তো রীতিমতো ‘দুর্নীতি’!

স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসছে তাও কিন্তু কম দিন না। তারা হেফাজতপুজো করছে। গ্রামে গ্রামে মসজিদ মাদ্রাসা বানাচ্ছে। আর কিছু এমপি-চেয়ারম্যান লাগামছাড়া টাকা কামাচ্ছে। মাগার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়া মজাক কমে নাই।

একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা যদি ওঠে তাহলে বলতে হয়, কোন অর্থনৈতিক অবস্থার? মুক্তিযোদ্ধারা তো কেবল একটি শ্রেণী ছিল না! হতদরিদ্র অবস্থার ভেতর থেকেও মানুষ তখন যুদ্ধ করেছিলো। নেংটি পরা জনও রাইফেল হাতে নিয়েছিল। গ্রামের নাপিত মানুষটাও যুদ্ধে গেছিলেন। তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। কারও যক্ষ্মা। কারও ক্যান্সার। কেউ রিকশা চালান ৭০ বছর বয়সে। কেউ ভিক্ষা করেন।

সেবারও দেশে গেলে একজনকে দেখলাম বুকের হাড় গোনা যায় এমন রুগ্ন। মুখে হাড় আর চোখের গর্ত ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মাসে ছয় হাজার টাকা পাবে এই আশায় প্লাস্টিকের ভেতর একটি এপ্লিকেশন ফর্ম নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতেছেন। তার সার্টিফিকেটে সমস্যা আছে জন্য তিনি ভাতা পাচ্ছেন না। তবে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে, সেই রাজাকার জনরা বহাল তবিয়তে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাসে ছ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন। যিনি সার্টিফিকেট সরবরাহ করছেন, তার বাড়িতে অট্টালিকা উঠেছে।

এবার সার্টিফিকেট দেওয়ার ধরন সম্পর্কে বলি। একজন মহিলা এসে মুক্তিযোদ্ধা অফিসে বসে থাকেন। বারবার বলেন, তিনি কীভাবে ৭১ এ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি কীভাবে রাইফেল লুকিয়ে রাখতেন পুকুরে। কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিতেন। তিনি একটা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট চান। তো, দায়িত্বশীল বলছেন, ‘আমাদের সার্টিফিকেট বন্টন হয়ে গেছে। আপাতত আমাদের হাতে আর সার্টিফিকেট নেই। আর আমরা মহিলাদের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেই না!” বিষয়টি শুনে আমি হা করে বসে থাকলাম।

সে গেল। বলছিলাম এই যে দরিদ্র শ্রেণী, তাঁদের জন্য কি কোনো বিনামূল্যে বা রেশনের ব্যবস্থা আছে? ওষুধের ব্যবস্থা আছে?

আচ্ছা ধরুন, সেটি করা হলো, কাদের হাত দিয়ে এগুলো তাঁদের কাছে পৌঁছুবে? চিন্তা করতে পারেন, এ নিয়ে কয় ধাপে বাণিজ্য হয়ে কাদের ভিটেয় ইট কোঠা ইমারত হয়ে যাবে? কাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় পড়তে যাবে? তাঁদের টাকায় কাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে? পড়ছে?
কিন্তু নামটা হবে এই সরকার মুক্তিযোদ্ধা এবং চেতনা ব্যবসা শুরু করেছে।

মুক্তিযোদ্ধার ফুসফুস কত আগে পোকায় খেয়ে ফেলেছে, জানেন? সেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের বয়স কতো জানেন? জানেন কি তারাও মরতে শুরু করেছে? একবার এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে ভ্যান চালাতে দেখে কেঁদেছিলাম। লেখাপড়া শেখেনি। মানুষ ভুলে গেছে তার বাবা শিক্ষক ছিল।
এখন তাঁদের নাতিপুতি নিয়ে কথা উঠছে। তারা অনেকে তাঁদের দাদা-নানাকে দেখেনি। ছোটবেলার জীবনে এটা কোনো বীরোচিত কাজ, সেটাও তারা শোনেনি।
তারা তাঁদের দাদা-নানার কাজের জন্য কোনো সুবিধা পাবে, সেটি বেশ চমকপ্রদ! সেটি একটি প্রশ্ন বটে! এটি কেমন দুর্নীতি দুর্নীতি গন্ধে ভরা।

তারা আর কী অবদান রেখেছে এ দেশটির জন্য? নোপ! কিছু নয়।
তবে তারা ভুগেছে অনেক! সেটি ভুলে যাবেন না। তারা পিছিয়ে গেছে এবং পিছিয়ে আছে অনেক পরিবার থেকে, এটা সত্য। এ পরিবারের একজন যুদ্ধে গিয়েছিল জন্য দেশটি আজ দেশ। কিন্তু তারা দুর্বল থেকে গেছে সমাজে রাষ্ট্রে।
এ পরিবারগুলোকে কি সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীতে ফেলা যাবে?
প্রশ্ন, এটা কী সম্মান, না লোভ এবং সুবিধার লালসা জাগানো কোনো পদ্ধতি? এটা কী সম্মান না আরও ‘ছোট’ করা? ‘করুণা’ গোষ্ঠী করে তোলা? কারণ একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে সুবিধাবঞ্চিত এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের জন্য এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। মূল কনসেপ্ট তারা যেন মেইন্সট্রিমের সাথে কোপ করতে পারে, পিছিয়ে না পড়ে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার কি সেটা ডিজারভ করে? সুবিধা, সম্মান নাকি করুণা?

তবে কী জানেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর দু যুগ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর উপর যে দুর্দশা নেমে আসে, সেটি আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। না, অন্য কোনো অপরাধ নয়, মুক্তিযোদ্ধা, এটাই ছিল তাঁদের একমাত্র অপরাধ। ডিসকোয়ালিফিকেশন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। দেশ ছাড়তে হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করেছি, অনেককে আদর্শ ত্যাগ করতে হয়! এগুলো কি মূল্য দেওয়া নয়? সে মূল্য দেওয়ার ক্ষতিপূরণ বলে কিছু আছে কি? থাকলে জানাবেন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.