কাবেরী গায়েন:
১। শত শত শিক্ষার্থীর উপর দফায় দফায় হামলা হয়েছে। হচ্ছে। এইসব হামলা ন্যাক্কারজনক। নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। কারা হামলা করেছেন,খানিক দেখতে পাচ্ছি, সবটা না। অবিলম্বে এই হামলা বন্ধ করার অনুরোধ জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সবাই এগিয়ে আসবেন, তেমন আশা ছিলো। তবে উপাচার্য-বাংলো ধবংসের বিচার চাইবার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উপর হামলার বিচার চাইবার মত মানুষ বেশি দেখা যাচ্ছে না।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের বাড়িতে হামলা হয়েছে এবং ভাংচুরের যে ছবি দেখেছি তার তীব্র নিন্দা জানাই। প্রশ্ন হলো, উপাচার্য মহোদয়ের বাংলোতে যে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকেন, তারা তখন কী করেছেন? কাছেই থানা। এতোক্ষণ ধরে এই ধবংসযজ্ঞ চললো কীভাবে? তাহলে কি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুরক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যও নিরাপদ নন? প্রশ্ন না বাড়াই। বরং উপাচার্য-বাংলো এবং চারুকলায় ভাংচুরের বিষয়ে সরকার আন্তরিক তদন্ত করে দোষীদের বিচার করবেন, সেই মর্মে জোর দাবি জানাই। একই সাথে মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের বাসভবনে প্রহরা জোরদার করারও দাবি জানাই।
৩। কোন যৌক্তিক আন্দোলন নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে ভেতরে ঢুকে যাওয়া হঠকারী শক্তির উদ্দেশ্যমূলক আচরণে। এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে আন্দোলন পরিচালনায় খানিকটা বিচক্ষণতা আশা করি। যৌক্তিক এবং বাস্তব আন্দোলন নিজস্ব লক্ষ্যে ঠিক থাকুক, কোন স্বার্থান্বেষী রাজনীতির শিকার না হোক।
৪। গুজব দুই পক্ষ থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে। গুজবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আন্দোলন। ছাত্রমৃত্যুর গুজব, পায়ের রগকাটার গুজব যেমন ছড়াচ্ছে তেমনি ফটোশপ করা পোস্টারের ছবিও ছড়ানো হচ্ছে। বড় বড় সাংবাদিকও ছড়াচ্ছেন সেসব পোস্টার। ঘৃণা-বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে। ছড়ানো হচ্ছে মুখে কাপড়বাধা ছবি, যা আসলে ভারতের কোন আন্দোলনের ছবি।
৫। গণমাধ্যমের উপর চড়াও হওয়া এবং গণমাধ্যমের রাগ করে চলে যাওয়া এমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে, কোনটাই মানা যায় না। ব্যক্তিগত মোবাইলে/ক্যামেরায় তোলা রক্তাক্ত ছাত্রের ছবি ফেসবুকে না দেয়া পর্যন্ত যদি আমরা দেখতে না পারি, তবে বুঝতে হবে মূল ধারার গণমাধ্যমের দিনও নড়বড়ে হয়ে এসেছে।
৬। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাকোটা এক বড় ইস্যু, শিবিরের কোন নেতাকে অন্যতম মুখপাত্র দেখতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। এর প্রতীকী মূল্য ভয়াবহ। আশা করি, আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা খেয়াল রাখবেন।
৭। দেশের আন্দোলনে বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য স্বাক্ষর যোগাড়ের চেষ্টাও সমর্থন করি না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় বড় দেশের বড় নেতা, বড় মানবাধিকার সংগঠনের বড় লবি দেখা আছে। বরং তরুণদের সম্মিলিত আন্দোলনের উপর ভরসা রাখি। তারুণ্যের শক্তিই যথেষ্ট । যেমন হয়েছে আজ সুফিয়া কামাল ছাত্রীহলে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের আক্রমণের যে অভিযোগ ক্রমাগত শোনা যাচ্ছিলো, তার একটা টুকরো উন্মোচিত হলো।
৮। অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর মুখে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি শুনলে ভেতরে ক্ষরণ হয়। কিন্তু তাঁর অবদান এই দেশের জন্য এতোই বেশি যে সেই ক্ষরণটাকে গিলে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। অন্তত আমার থাকে না। আশা করি, তিনি তাঁর এই মন্তব্যের অসারতা নিজেই বুঝবেন।
৯। মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করে কোন শ্লোগান যেনো না তোলার সাহস কেউ পায়, সেটা দেখার দায়িত্বও এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থীদের। কেউ এমন হঠকারী শ্লোগান দিলে উপযুক্ত জবাব সে পাবে, সেই আশা রাখি।
১০। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-পুলিশ মুখোমুখি, এর চেয়ে বেদনার আর কিছু হতে পারে না। শিক্ষক চলেন জনগ্ণের টাকায়। পুলিশ চলেন জনগণের টাকায়। সেই টাকার যোগানদার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাতাপিতা। সেই টাকায় কেনা বুলেট, হোক রাবারের, শিক্ষার্থীদের দিকে তাক করা, এমন একটি দৃশ্যও দেখতে চাই না। আন্দোলনবিরোধী কেউ অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্দোলনকারীদের উপর, দেখতে চাই না আর।
কোটা সংস্কারের আন্দোলন যে যৌক্তিক তা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব কোটার সংস্কার করে এই অচলাবস্থার নিরসন করা হোক। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনের সাথে সবসময়েই সাথে আছি।